মেলানিয়ার বাবা-মায়ের গ্রিনকার্ড পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘চেইন মাইগ্রেশনের’ তীব্র বিরোধী; কিন্তু তার স্ত্রী মেলানিয়া ট্রাম্প একজন অভিবাসী এবং মেলানিয়ার বাবা-মা এখন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন কার্ডধারী বাসিন্দা।
কিন্তু তারা কোন প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের ছাড়পত্র পেয়েছেন, এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে মার্কিন গণমাধ্যমগুলো।
ফার্স্ট লেডি মেলানিয়ার বাবা-মা যুক্তরাষ্ট্রের বৈধ ও স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে ছাড়পত্র পেয়েছেন এবং তারা নাগরিকত্ব পাওয়ার কাছাকাছি রয়েছেন বলে বিষয়টি সম্পর্কে অবগতদের বরাতে জানিয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউ ইয়র্ক টাইমস, সিএনএন।
যদিও মেলানিয়ার বাবা-মা কীভাবে এবং কখন তাদের ‘গ্রিন কার্ড’ পেয়েছেন তা জানাতে অস্বীকার করেছেন তাদের আইনজীবী, জানিয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট।
যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেলানিয়ার বাবা ভিক্টর কাভস ও মা আমালিজা কাভস খুব সম্ভবত পারিবারিক পুনরেকত্রীকরণ প্রক্রিয়াতেই যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের ছাড়পত্র পেয়েছেন, যে প্রক্রিয়াকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প উপহাস করে ‘চেইন মাইগ্রেশন’ অভিহিত করে আসছেন। তিনি এ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন।
ফার্স্ট লেডি ও তার পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করা নিউ ইয়র্কভিত্তিক আইনজীবী মাইকেল ওয়াইল্ডসের ভাষ্য, স্লোভেনিয়ার সাবেক বাসিন্দা কাভসরা গ্রিন কার্ড নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন।
তিনি বলেছেন, “আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, মেলানিয়া ট্রাম্পের বাবা-মা বৈধভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছেন। পরিবারটি প্রশাসনের অংশ না হওয়ায় তারা তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর অনুরোধ করেছেন, তাই এই বিষয়ে আমি আর কোনো মন্তব্য করবো না।”
কাভসদের অভিবাসন তথ্য সম্পর্কে জ্ঞাত এক ব্যক্তির ভাষ্য অনুযায়ী, কাভসরা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বের শপথ নেওয়ার অনুষ্ঠানের অপেক্ষায় আছেন। নাগরিকত্বের আবেদন করার আগে স্থায়ী বাসিন্দাদের সাধারণত গ্রিন কার্ড নিয়েই পাঁচ বছর থাকতে হয়।
কাভসরা কবে প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন তা স্পষ্ট না হলেও ২০০৭ সালের শেষ দিকে সরকারি নথিতে ভিক্টর কাভসের ঠিকানা ছিল ফ্লোরিডায় ট্রাম্পের পাম বিচের বিলাসবহুল মার-আ-লাগো অবকাশ কেন্দ্র।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারে ট্রাম্প অভিবাসনবিরোধী কট্টর অবস্থান নিলে তার শ্বশুর-শাশুড়ির যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে।
গত মাসে প্রেসিডেন্ট দশককাল ধরে চলে আসা পারিবারিক পুনরেকত্রীকরণ নীতিতে বাবা-মা ও সহোদরদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে থাকার পথ বন্ধ করার প্রস্তাব করলে বিষয়টি নিয়ে ফের আলোচনা শুরু হয়।
দীর্ঘদিন ধরেই ট্রাম্প এ পারিবারিক পুনরেকত্রীকরণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সরব। গত মাসে স্টেট অব দ্য ইউনিয়নের ভাষণে প্রেসিডেন্ট এ ‘চেইন মাইগ্রেশন’ পদ্ধতিকে আমেরিকানদের জীবনধারণ ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে অভিবাসী হওয়া ব্যক্তিরা কেবল তাদের স্বামী/স্ত্রী ও অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদেরই যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসার অনুমতি পেতে পারেন বলেও মত ট্রাম্পের।
ট্রাম্প সমালোচনা করলেও তার শ্বশুর-শাশুড়ি পারিবারিক পুনরেকত্রীকরণ পদ্ধতিতেই যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে বসবাসের অনুমতি পেয়েছেন বলে ধারণা অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের।
নিউ ইয়র্ক ইমিগ্রেশন ল ফার্মের অংশীদার ম্যাথিউ কোলকেন জানান, দুই উপায়ে ট্রাম্পের শ্বশুর- শাশুড়ি গ্রিন কার্ড পেতে পারেন। একটি হচ্ছে- তাদের মেয়ে মেলানি কিংবা চাকরিদাতা কারও জামিনের মাধ্যমে।
গ্রিন কার্ড পাওয়ার দ্বিতীয় উপায় হচ্ছে- এমন কোনো কাজের জন্য অন্য দেশের নাগরিকদের নিয়ে আসা, যা যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নাগরিক পারেন না।
কাভসরা দুজনই যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগেই অবসর নিয়েছিলেন বলে খবর মার্কিন গণমাধ্যমের। ৭৩ বছর বয়সী ভিক্টর কাভস স্লোভেনিয়ায় শোফার ও গাড়ি বিক্রেতার কাজ করতেন, ৭১ বছরের আমালিজা ছিলেন টেক্সটাইল কারখানার প্যাটার্ন মেকার।
অভিবাসীদের বাবা-মারও যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে থাকার উপায় থাকায় ফার্স্ট লেডি মেলানিয়ার জামিনেই ভিক্টর ও আমালিজা গ্রিন কার্ড পেয়েছেন বলে ধারণা মার্কিন ইমিগ্রেশন লইয়ারস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ডেভিড লিডপোল্ডের।
বিদেশিরা চাইলে শরণার্থী হিসেবে কিংবা অন্যান্য মানবিক কর্মসূচির মাধ্যমেও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের সুযোগ পেতে পারেন বলে ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটির বরাত দিয়ে জানিয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট। হোয়াইট হাউস এবং ফার্স্ট লেডির মুখপাত্র কাভসদের যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। কাভসদের যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে বসবাসের ব্যাপারে খোঁজখবরের মধ্যেই মার্কিন গণমাধ্যম ফার্স্ট লেডি মেলানিয়ার নাগরিকত্ব পাওয়ার ইতিহাসেও আলো ফেলছে।
মেলানিয়ার আইনজীবী ওয়াইল্ডস জানান, ১৯৯৬ সালে ফার্স্ট লেডি স্লোভেনিয়া থেকে প্রথম মডেলিংয়ের কাজে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। প্রথম দফায় তিনি দর্শনার্থী ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে আসেন, পরে পান কাজ করার অনুমতি। ২০০০ সালে ট্রাম্প মডেলিংয়ে ‘অসাধারণ দক্ষতা’ দেখানো মেলানিয়ার গ্রিন কার্ডের জামিনদার হন।
যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করার অনুমতি পাওয়ার আগে মেলানিয়াকে ১৯৯৬ সালেই ট্রাম্প ১০টি মডেলিং কাজের জন্য অর্থ দিয়েছিলেন বলে গত বছর এক প্রতিবেদনে জানা গিয়েছিল। যদিও কোন ‘বিশেষ দক্ষতা’র কারণে মেলানিয়া গ্রিন কার্ডের যোগ্য বিবেচিত হয়েছিলেন তা জানা যায়নি।
নোবেল পুরষ্কার জয়ীদের মতো বিশেষ ক্ষেত্রে দক্ষ ব্যক্তিরাই সাধারণত এ বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে থাকার অনুমতি পান।
ট্রাম্পের সঙ্গে পরিচয়ের কয়েক বছর পর ২০০১ সালে গ্রিন কার্ড পেয়েছিলেন মেলানিয়া, এরপর ২০০৬ সালে পান মার্কিন নাগরিকত্ব। মেলানিয়া যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসার পর তার বাবা-মাও স্লোভেনিয়া ছাড়েন, যদিও ২০০৭ এর আগেই তারা যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি নথিতে ওই বছরই ভিক্টর কাভসের ঠিকানা হিসেবে মার-আ-লগোর নাম আসে, তার নামে ফ্লোরিডাভিত্তিক মার্সিডিজ-বেঞ্জের একটি গাড়িও ওই সময়ই নিবন্ধিত হয়।
কেবল বাবা-মাই নন, মেলানিয়ার বড় বোন ইনেসও পরে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন। এখন তিনি নিউ ইয়র্কের পার্ক অ্যাভিনিউতে ট্রাম্পের মালিকানাধীন অ্যাপার্টমেন্টে থাকছেন।
ছেলে ব্যারনকে নিয়ে গত গ্রীষ্মে মেলানিয়া হোয়াইট হাউসে আসার পর থেকে তারা বাবা-মাকেও ওয়াশিংটনে নিয়মিত দেখা যেতে থাকে বলে ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
কয়েক বছর আগে ট্রাম্পের শ্বশুর-শাশুড়ি তাদের গ্রিন কার্ডের আবেদন কী অবস্থায় আছে, তা দেখতে সিনেটর চার্লস ই শুমারের দপ্তরে যোগাযোগ করেছিল বলেও এ বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি জানিয়েছেন। অভিবাসন প্রত্যাশীদের জন্য কাজ করা ডেমোক্রেট নেতা শুমারের মতো অনেকের কাছেই এ ধরনের অনুরোধ নিয়মিত আসে। ট্রাম্পের শ্বশুর-শাশুড়ির অনুরোধ বিষয়ে সিনেটে সংখ্যালঘু দলের নেতা শুমারের দপ্তর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
গত ৩০ জানুয়ারি স্টেট অব দ্য ইউনিয়নের ভাষণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অভিবাসন বিষয়ে তার চার-দফা পরিকল্পনার কথা জানান, যেখানে ‘চেইন মাইগ্রেশন’ বাতিল করে মেধার ভিত্তিতে অভিবাসী নির্বাচনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
“এখনকার ভঙ্গুর প্রক্রিয়ায় একজন অভিবাসীই কার্যত তার অসংখ্য আত্মীয়কে নিয়ে আসতে পারে। আমাদের পরিকল্পনায়, আমরা কেবল অভিবাসীর স্ত্রী/স্বামী ও অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানকে জামিনের প্রস্তাব করছি। গুরুত্বপূর্ণ এ সংস্কার কেবল আমাদের অর্থনীতির জন্য নয়, প্রয়োজন আমাদের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যতের জন্যও,” বলেন ট্রাম্প।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি টুইটারে ফের অবস্থান স্পষ্ট করেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, “আমাদের প্রয়োজন, ২১ শতকের মেধার ভিত্তিতে অভিবাসন প্রক্রিয়া। চেইন মাইগ্রেশন এবং ভিসা লটারি হল বাতিল প্রক্রিয়া, যেগুলো আমাদের অর্থনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে,”।
ডেমোক্রেটদের পাশাপাশি অনেক রিপাবলিকানও ট্রাম্পের এ অবস্থানের বিরোধিতা করছেন। গত সপ্তাহে রিপাবলিকান সাংসদ চার্লস ই গ্রাসলির একটি প্রস্তাব মার্কিন সিনেটে খারিজ হয়ে গেছে; হোয়াইট হাউসের সমর্থনপুষ্ট ওই প্রস্তাবে অভিবাসন বিষয়ে ট্রাম্পের পরিকল্পনাগুলোও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
নিউইয়র্ক মেইল/যুক্তরাষ্ট্র/২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/এইচএম