অবশেষে কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় পেলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা
তুহিন সানজিদ, নিউইয়র্ক: অবশেষে কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় পেলেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এস কে সিনহা)। এর আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু এখানে দীর্ঘ সময়েও ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ কোনো সিদ্ধান্ত না দেয়ায় নিউজার্সির বাড়ি বিক্রি করে তিনি ৪ জুলাই পালিয়ে কানাডায় চলে যান। এরপর সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন।
কানাডায় ঢোকার সময় সাবেক এই প্রধান বিচারপতির কাছে কোনো পাসপোর্ট ছিল না। গত ২৫ জুলাই বৃহষ্পতিবার কানাডা ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তার আবেদন গ্রহনের (Approval letter) হাতে পেয়েছেন বলে এস কে সিনহার একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র নিউইয়র্ক মেইলকে জানিয়েছেন।
সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনিই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম অমুসলিম প্রধান বিচারপতি। এর আগে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৯৯ সালের ২৪ অক্টোবর তিনি হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। ২০০৮ সালে আবারো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ১৬ আগস্ট তাকে আপিল বিভাগে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
তিনি সরকারের অত্যন্ত আস্থাভাজন হওয়ায় প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর থেকে সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। তবে বিচার বিভাগের ক্ষমতা খর্ব করার অভিযোগ এবং নিন্ম আদালতের বিচারক নিয়োগের প্রজ্ঞাপন প্রকাশ নিয়ে সরকারের তার বিরোধ শুরু হয়।
সর্বশেষ ২০১৭ সালের জুলাই মাসে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে সরকারের সাথে বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। ৩ জুলাই উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় বহাল রেখে রায় দেয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চ।
রায়ে প্রধান বিচারপতির কয়েকটি মন্তব্যে নাখোশ হয় সরকার এবং আওয়ামী লীগ। প্রধান বিচারপতির ‘অগ্রহণযোগ্য’ বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করার কথা বলে সরকার। কিন্তু এস কে সিনহা তার সিদ্ধান্তে ছিলেন অনঢ়।
২২ আগস্ট দায়িত্ব ছাড়তে এস কে সিনহাকে সময় বেঁধে দেয় আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা। তা না হলে তাকে অপসারণে আন্দোলনের হুমকি দেয়া হয়। বিভিন্ন সভা সমাবেশে প্রকাশ্যে বিষোধগার করতে থাকেন সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রীরা। ১৩ সেপ্টেম্বর ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং তার কিছু পর্যবেক্ষণের বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নিতে জাতীয় সংসদে প্রস্তাব গ্রহণ করে সরকার। এসময় বিচারপতি সিনহার তীব্র সমালোচনাও করা হয়।
বেঞ্চের কয়েকজন বিচারপতি একই সঙ্গে এজলাসে বসতে রাজি হননি। প্রতিবাদ আর নানামুখি চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত দেশ ছাড়তে হয় তাকে। বিদেশে বসেই পদত্যাগপত্র পাঠাতে হয়। ওই রায় প্রকাশের পর থেকে পাঁচ মাসের মধ্যেই ঘটে যায় সব ঘটনা।
২০১৭ সালের ১ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি সিনহা অসুস্থ্যতাজনিত কারণ দেখিয়ে এক মাসের ছুটি চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে একটি চিঠি দেন। পরে আরেকটি আবেদনে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত ছুটি চান তিনি। ১৩ অক্টোবর রাতে তিনি অস্ট্রেলিয়ার মেয়ের বাসায় যাওয়ার উদ্দেশে দেশ ছেড়ে যান। ছুটির আবেদনে অসুস্থ্যতার কথা লেখা থাকলেও দেশ ছাড়ার সময় তিনি অসুস্থ্য নন বলে সাংবাদিকদের জানান। ১৭ অক্টোবর তার স্ত্রী সুষমা সিনহাও অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে দেশ ছাড়েন।
এরপর গত বছরের ১১ নভেম্বর অষ্ট্রেলিয়া থেকে কানাডায় আরেক মেয়ের বাড়ি যাবার পথে যাত্রাবিরতি করে সিঙ্গাপুর দূতাবাসের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পাঠান বহুল আলোচিত এই প্রধান বিচারপতি। অষ্ট্রেলিয়া থেকে কানাডায় ছোট মেয়ে আশা সিনহার বাসায় উঠেন বিচারপতি সিনহা। সেখানে ভালোই সময় কাটছিল তার।
তবে বসবাসের জন্য কানাডার চাইতে যুক্তরাষ্ট্র বেশি পছন্দ হওয়ায় ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে সেখান থেকে নীরবে পাড়ি জমান নিউইয়র্কে। এখানে আসার পর নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন তিনি। তার নিভৃত জীবন যাপনের খবর প্রথমে নিউইয়র্ক মেইলে প্রকাশিত হয়। এরপর বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম তাকে নিয়ে সংবাদ প্রচার শুরু করে। এমনকি নিউজার্সিতে ভাইয়ের নামে বাড়ি কেনার ঘটনাও বেরিয়ে আসে।
সেখানে বসেই “এ ব্রোকেন ড্রিম” একটি বই লেখেন তিনি। বইটি মূলত তার আত্মজীবনী হলেও বিশেষ উদ্দেশ্যে একটি মহলের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সরকার বিরোধী বিভিন্ন কথা লিখেছেন বলে অভিযোগ করেন খোদ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর বেশ কিছুদিন সংবাদ মাধ্যমকে এড়িয়ে চলতে থাকেন এস কে সিনহা।
গত জুন মাসে প্যটারসন শহরের ১৭৯ জ্যাসপার স্ট্রিটের তিন তলা বাড়িটি বিক্রি করে দেন সাবেক এই প্রধান বিচারপতি। এরপর ফোর্ট এরি সীমান্ত দিয়ে কানাডায় চলে যান। এস কে সিনহার ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন, মূলত কানাডায় বসবাসরত তার ছোট মেয়ে ও স্ত্রী সূষমা সিনহার অনুরোধেই তিনি যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে করা তার রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন কি না সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি।
কানাডায় শরণার্থী হিসেবে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের দু’সপ্তাহের মধ্যেই ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তার আবেদন অনুমোদন করেছেন। বর্তমানে তিনি ছোট মেয়ে আশা সিনহার বাড়িতেই অবস্থান করছেন।