সিডনিতে বাঙালি কাঁথার রাজ সম্মান
কাউসার খান, অষ্ট্রেলিয়া থেকে: সিডনির ঝলমলে শপিংমলে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই চমকে ওঠলেন, দেখলেন নকশী নয়, নতুন কাপড়েরও নয়, নেহায়েত গ্রামগঞ্জের গরীব মানুষের কাঁথা ঝুলছে নামীদামী দোকানে। প্রাইস ট্যাগ লাগানো ৭০ ডলার, ৮০ ডলার। ‘কি দেখলাম’ এমন ভাবনা শুরুর আগেই দোকানের ভেতর থেকে বিক্রেতা সহকারী এসে আপনাকে বলবে ‘এ্যাই কাঁথা চায় তোমার’? তারপর শুরু করবে এ কাঁথা মানে আমাদের ওই গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের কাঁথার গুণ বৈশিষ্ঠ্য।
অবাক হবেন কারণ আপনার দেশের এই কাঁথা বা খেতা নিয়ে আপনি এত কিছু কখনোই ভাবেন নি আগে। আপনি আবার ‘থ’ হবেন নিঃসন্দেহে কারণ বাংলাদেশে থাকতে এই খেতাকে ‘গরীবের চাদর’ বলে জানতেন। শখে কিংবা পরিস্থিতির শিকার হয়ে এই খেতা ব্যবহার করে থাকলেও আপনি লজ্জা পেয়েছেন কখনো কখনো পাছে কেউ দেখে ফেলে কিনা এভেবে।
আর এখন গ্রাম বাংলার সেই চিরাচরিত হত দরিদ্র খেতা-ই সিডনিতে এসে ‘মেজর ট্রেন্ড’ পণ্য হিসেবে দ্রুত প্রচলিত হয়ে উঠছে শহরময়। যারাঁ ব্যবহার করছেন তাঁরা ভাবেন এ কাঁথা ব্যবহার আরামদায়ক এবং সময়ের সাথে আধুনিক ফ্যাশনও বটে। তাই একঘেয়ে চাদরের চেয়ে রঙচঙে রঙিন কাপড় ও সুতোয় আকর্ষণীয় খেতাগুলোর প্রচলনটা যেন হঠাত করেই বেড়ে চলেছে অস্ট্রেলীয় মানুষের কাছে। জড়োসড়ো বাঙালি ললনা-নারীদের সুখ-দুখের ব্যবহৃত সুতি শাড়ির এই খেতা উত্থান যেন অনেকটা গরীবের কপালে রাজসম্মানের মত। দোকানের প্রধান আকর্ষণ হয়ে বিক্রির জন্য মাথা উঁচু করে ঝুলছে সাদা মানুষের এই দেশে। হাতে তৈরি এই কাঁথাগুলো অনেকটা নরম হওয়াও দ্রুত প্রচলিত হওয়ার আরেকটা বিশেষ কারণ।
তবে সবার কাছে না হলেও কিছু কিছু মানুষের কাছে বাঙালি গ্রামগঞ্জের নারীদের ব্যবহার করা শাড়িতে মোটা দাগের সেলাই করা এই খেতা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে । সিডনির রয়েল রেন্ডউইক শপিং মলের ‘মিলি অ্যান্ড ইউজিন’ দোকানে দেখা মেলে এই খেতার। বাহারি সুতায় মোটা মোটা সেলাই করা রঙিন খেতা শোভা পায় ঘর সাজানোর বিদেশি এই দোকানটির প্রবেশদ্বারেই।
মিলি আর ইউজিন ঘর সজ্জায় পারদর্শী দুই বোন। সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ করতেই মিলি অ্যান্ড ইউজিন নামের ঘরসজ্জা সামগ্রীর দোকান খোলে তাঁরা। বেশ খ্যাতিও কুঁড়িয়েছেন অল্পদিনেই। শখের বশেই নানা দেশের ঐতিহ্যগত ঘরসজ্জা সামগ্রী সংগ্রহ করেন মিলি-ইউজিন বোনজুটি। আর সেই শখের কথা জেনেই তাঁদের এক বাঙালি বন্ধু উপহার দেন এ্যাই কাঁথা বা খেতা। দুই বোনেরই মনে ধরে যায় সাদাসিদে হাত সেলাইয়ের সূতি শাড়ির রঙিন এ কাঁথা শিল্পটি। এরপর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে কাঁথার আমদানি করা শুরু করেন তাঁরা। অস্ট্রেলিয়ায় আনার পর পুনরায় পরিষ্কার ও পরিশোধন করে ব্যবহৃত শাড়ির তৈরি কাঁথাগুলোকে বিক্রি জন্য প্রস্তুত করা হয়।
মূল্য নির্ধারণের পর তাদের দোকানে শোভা পেতে শুরু করে গ্রাম বাংলার হত-দরিদ্র এই কাঁথার রাজযাত্রা । রয়েল রেন্ডউইক শপিংমল ছাড়াও দোকানটির আরও শাখা রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে। প্রায় সব শাখাগুলোতেই স্থান পেয়েছে বাঙালির কাঁথাগুলো স্বসম্মানে। ৭০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার থেকে শুরু করে কাঁথাগুলো বিক্রি হয় ২২৫ ডলার পর্যন্ত।
অস্ট্রেলীয়দের জন্যে এ মূল্য অনেকটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া অস্ট্রেলিয়াতে এ কাঁথা তৈরি করতে খরচ হবে কয়েকগুণ কিন্তু তারপরও এ রকম আরামপ্রদ ও অকৃত্রিম হবে না বলে জানান দোকান সহকারী মার্ক । তিনি আরও বলেন, ব্যবহারের ফলে কাপড়ে যে নরম ও মসৃণতা আসে তা অস্ট্রেলিয়াতে কৃত্রিমভাবে করা সম্ভব নয়। এছাড়া অন্যদিকে, এখন যেমন অস্ট্রেলিয়ানরা দিন দিন প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠা অরগ্যানিক শাক-সবজি, মাছ-মাংসের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে, সেরকম গ্রামীণ বাংলার নারীদের হাতে তৈরি ব্যবহৃত সূতি শাড়ির বাহারি রঙের কাঁথা ব্যাপক আকৃষ্ট করছে এই অস্ট্রেলীয়দের।
বিদেশিদের মুখে এ কাঁথার গুণগান শোনা যায় প্রায়শই। বিশেষ করে ইউরোপ-অ্যামেরিকার বরফ পড়া দেশের তুলনায় অনেক কম শীতের দেশ এই অস্ট্রেলিয়ায় এই কাঁথার মূল্যয়ন অন্যরকম কারণ শীত ও গ্রীষ্ম কালের আগে-পরে কয়েক মাস ধরে এদেশে শীত থাকে স্বল্প আমাদের বসন্তকালের মত তখন এই কাঁথা ব্যবহার হয়ে উঠে অনবদ্য। ‘গায়ে দিয়ে অন্যরকম আরাম পাওয়া যায়, তাছাড়া কাপড়ে এমন রঙের মিশ্রণ দেখে মনে হয় আস্ত একটা শৈল্পিক ক্যানভাস গায়ে দিয়ে রেখেছি’ এই কাঁথা কিনতে কিনতে বলছিলেন এক বিদেশি ব্যবহারকারী।