নাগরিকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করলো অস্ট্রেলিয়া
বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে যৌন নিপীড়ন থেকে সুরক্ষা দিতে পারার ব্যর্থতা শিকার করে নাগরিকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করলো অস্ট্রেলিয়া।
সোমবার অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টে শৈশবে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেন প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন। হাউস অব রিপ্রেজেন্টিটিভের গ্রেট হলে এদিন জড়ো হয়েছিলেন ৮০০রও বেশি মানুষ। তাদের সামনে দাঁড়িয়েই সারা বিশ্বের জন্য অনন্য এই ঐতিহাসিক নজির সৃষ্টি করলেন অস্ট্রেলিয়ার আইনপ্রণেতারা। এদিন বিরোধীদলীয় নেতাও একইভাবে নিপীড়িতদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
নাগরিকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বলেন, ‘কেন আমাদের শিশুদের জন্য আমরা ভালোবাসা-দেখাশোনা আর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারিনি? কেন তাদের বিশ্বাসের সঙ্গে বেঈমানি করা হলো? উত্তর দেওয়ার ভান করলে তা কেবল নষ্টামো হবে। আমাদের তাই ভুক্তভোগীদের কাছে নতমুখে দাঁড়াতে হবে। তাদের কাছ থেকে ক্ষমা চাইতে হবে।’
স্কট মরিসন বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমরা এক কঠিন প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে আছি। এমন এক প্রশ্ন, যা সামনে আনাই ভয়াবহ, উত্তর খোঁজার কথা নাইবা বললাম।’
তিনি বলেন, ‘স্কুল, গির্জা, শিশু সংঘ, স্কাউট, এতিম, ভরণ-পোষণ কেন্দ্র, স্পোর্টিং ক্লাব, গ্রুপ হোমস, দাতব্য সংস্থা ও পারিবারিক বাসাগুলোতে পদ্ধতিগত যৌন নিপীড়নজনিত অপরাধের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। অপরাধীরা যেখানেই ভাবে যে তারা পার পেয়ে যেতে পারবে এবং এসব প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাগুলো যদি এর অনুকুল হয় ও ধোঁকা দেওয়া যায়, তখন এ ধরনের যেকোনও জায়গায় নিপীড়ন হতে পারে। দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস, দশকের পর দশক এ নির্মম যন্ত্রণা মানুষকে সহ্য করতে হয়েছে।’
বিভিন্ন ভুক্তভোগীর বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে স্কট মরিসন বলেন, ‘যখন কোনও শিশু এ ব্যাপারে বলতো, তাদের কথা বিশ্বাস করা হতো না এবং দায়মুক্তি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। ভুক্তভোগীদের একজন আমাকে বলেছেন, তিনি তার শিক্ষককে তার যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার কথা জানানোর পর ওই শিক্ষকের হাতেও তাকে নিপীড়নের শিকার হতে হয়। আস্থা ভেঙে যায়, নিষ্পাপ মনের সঙ্গে ধোঁকাবাজি হয়, ক্ষমতা ও অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে সংঘটিত হয় অনৈতিক, অন্ধকার অপরাধ।’
উপস্থিত ভুক্তভোগীদের উদ্দেশ্য করে মরিসন বলেন, ‘আমরা আপনাদের বিশ্বাস করি।’
বিরোধীদলীয় নেতা বিল শর্টেনও ভুক্তভোগীদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা দুঃখিত যে শিশুদের ওপর যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের ঘটনা এখনও ঘটছে এবং তা ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবেনা বলে নিশ্চিত করার মতো এখনও তেমন কিছু করতে না পারায় এ পার্লামেন্টের সকল সদস্যের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করছি। অস্ট্রেলিয়ার অনেক শিশু এখনও অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ জীবন-যাপন করছে।’
অনুষ্ঠানে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ডের নাম উচ্চারণ করতেই করতালির শব্দে ভরে ওঠে সভাস্থল। জুলিয়া গিলার্ডই প্রাতিষ্ঠানিক শিশু যৌন নিপীড়নের ঘটনা তদন্তে ২০১৩ সালে শিশু যৌন নিপীড়নবিরোধী কমিশন গঠন করেন। এ কমিশন গঠন না করা হলে শত শত শিশু নিপীড়নের এসব ঘটনা হয়তো প্রকাশ্যে আসতো না এবং সংস্কারের প্রশ্নটি এক্ষেত্রে হয়তো বিলম্বিত কিংবা উপেক্ষিত থাকতো। সোমবার জুলিয়া গিলার্ডকে গ্রেট হলের মঞ্চে ডাকা হয়। এরপর ভাষণ দেন তিনি। জুলিয়া বলেন, ‘যেখানে আমি বসতে চেয়েছিলাম, সেখানে আমি বসেছি, নিপীড়নের শিকার মানুষ, তাদের পরিবার, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আজ আমি বসেছি। এ কক্ষে আজ আমাকে স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে যে মহা সম্মাননা আমাকে দিয়েছেন, তার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। এ আমার জন্য বড় প্রাপ্তি।’
ভুক্তভোগীদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে স্কট মরিসন যখন বিবৃতি পড়ে শোনাচ্ছিলেন, তখন সাবেক ও বর্তমান রাজনীতিবিদদের চোখেও ছিল অশ্রু। অনুষ্ঠানে উপস্থিত কাউকে কাউকে দেখা গেছে ভুক্তভোগী প্রিয়জনের নাম লেখা ব্যাজ পরে আসতে। ওইসব প্রিয়জন যারা নিপীড়নের শিকার হয়েছিল কিন্তু এখন জীবিত নেই অথবা অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেনি। সোমবার বিকেলের দিকে একটি প্রশ্নোত্তর-পর্ব রাখা হয়েছিল, তবে ভুক্তভোগীদের অনুরোধে তা একদিন পিছিয়ে দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানটি অস্ট্রেলিয়াজুড়ে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছে। ভিক্টোরিয়া থেকে ভ্রমণ করে ক্যানবেরার পার্লামেন্ট ভবন পর্যন্ত যারা আসতে পারেননি এবং সেখানকার অসুস্থ ও বৃদ্ধদের কথা মাথায় রেখে শহরটির চারটি এলাকায় অনুষ্ঠান দেখানোর আয়োজন করা হয়েছিল। নিউ সাউথ ওয়েলসের সিডনি অপেরা হাউসেও সম্প্রচারিত হয়েছে অনুষ্ঠানটি।
দশকের পর দশক ধরে অস্ট্রেলিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, স্কুল, স্পোর্টিং ক্লাব, গির্জা, দাতব্য সংস্থাসহ অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংঘটিত যৌন নিপীড়ন থেকে শিশুদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থতা স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়েছে। শিশু যৌন নিপীড়ন নিয়ে পাঁচ বছরের এক তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
পাঁচ বছর ধরে শিশু যৌন নিপীড়ন নিয়ে তদন্ত চালিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক শিশু যৌন নিপীড়নবিরোধী কমিশন। গত ডিসেম্বরে তদন্তের ফলাফল উপস্থাপন করে তারা। ওই প্রতিবেদনে কমিশন ৪০৯টি ঘটনার উল্লেখ করে। এরমধ্যে ১২২টি ঘটনাই সরাসরি কিংবা আংশিকভাবে কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঘটেছে। এরইমধ্যে ক্যাথলিক চার্চ ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংস্কার শুরু করেছে অস্ট্রেলীয় সরকার। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যে শিশুরা যৌন নিপীড়নের শিকার হয় এবং তাদের বক্তব্য উপেক্ষিত থাকে- সে কথা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করতে সোমবার ক্ষমা প্রার্থনা করে অস্ট্রেলিয়া সরকার।