বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কৌতুহল
কাজী আফিফুজ্জামান সোহাগ: সবকিছু যদি ঠিক থাকে তাহলে ২০১৮ সালের শেষে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ হিসেবে সময় আছে মাত্র ৫ থেকে ৬ মাস। নির্বাচন মানেই বাঙ্গালীর কাছে আবেগ আর উচ্ছ্বাসের বিষয়। কিন্তু এবার কিছুটা ভিন্ন পরিবেশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
অতীত ইতিহাসের পাতা উল্টালে এ চিত্র একেবারেই মেলানো যাবে না। নির্বাচনের অন্তত দুই বছর আগে থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতি হয়ে ওঠে উত্তপ্ত, আমেজমুখর। অন্তত ইতিহাসের পাতা তাই বলে। তবে ইতিহাস তো সবসময় ধরে রাখা যায় না। এটা বদলায়,আবার বদলানোও হয়। নির্বাচন নিয়ে নতুনভাবে তৈরি হতে যাওয়া এ পরিস্থিতিতে বিস্ময়করভাবে খুশি মনে হচ্ছে বাংলাদেশের আপামর জনগণকে। এর যৌক্তিক কারনও রয়েছে। অতীত ইতিহাসে নির্বাচন পূর্ববর্তী অবস্থায় যেমন ছিলো আবেগ, উচ্ছ্বাস আর উদ্দীপনা তেমনি ছিলো হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ আর হরতালের ফুলঝুরি। এতে দেশ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তেমনি জনগণের নাভিশ্বাসও উঠেছিলো দৈনন্দিন জীবন-যাপনে। আগামী সংসদ নির্বাচন ঘিরে আপাতত এ ধরনের কোন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আর জনগণের স্বস্থিটা সেখানেই।
সময় বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে মানুষের স্বপ্নের ধরন। আগে দু’বেলা দু’মুঠো পেট পুরে খাওয়াকেই মনে করা হতো সর্বোচ্চ তৃপ্তি। এখন আর সেটা নেই। এখন স্বপ্নের জাল বিস্তৃতি হয়েছে। মানুষ তাদের আর্থিক সঙ্গতি দৃঢ় করতে সচেষ্ট হয়েছে। ৫টি মৌলিক অধিকারের বাইরেও বাংলাদেশের মানুষ এখন আকাংখায় উর্দ্ধমুখি। কিন্তু রাজনীতিমুখি জনগণ হঠাৎ করে তো আর রাজনীতি বিমূখ হয়ে পড়তে পারে না। হয়তো ধরণ পাল্টাচ্ছে কিন্তু মাথা থেকে রাজনীতি,নির্বাচন তো আর সরানো যায় না। তাই নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে আস্তে আস্তে প্রবল হচ্ছে এসব ইস্যু। দেশের দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টি বক্তব্য থেকে বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে কেমন হতে পারে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কেমন হতে পারে ওই নির্বাচনের রুপরেখা। সরকারি দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সংবিধানের আলোকে হবে আগামী নির্বাচন। এতে কোন দল আসলো কি আসলো না তা নিয়ে মাথ্যাব্যাথা আওয়ামী লীগের নেই। একই ইস্যুতে বিএনপির তরফ থেকে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে খোদ সংবিধান নিয়েই। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তো বলেছেন, কিসের সংবিধান? বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সংবিধান কেটেকুটে শেষ করে দিয়েছে। তাই নির্বাচন নিয়ে আলোচনার কোন বিকল্প নেই। বিএনপি যতই আলোচনার ধোঁয়া তুলছে আওয়ামী লীগ ততই প্রত্যাখান করছে। এক কথায় অনড় অবস্থান নিয়েছে আওয়ামী লীগ। ঠিক এরকম একটি পরিস্থিতিতে নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে তা নিয়ে বিতর্কের পাশাপাশি কৌতুহল দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশে এবং বিদেশে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা চলছে। কোন কোন ক্ষেত্রে গবেষনা চলছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আগামী নির্বাচন গনতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ। তবে নির্বাচনকালীন সরকার কী হবে? কেমন হবে? তার ধরন কেমন হবে তা সুস্পষ্টিকরন না হলেও ভেতরে ভেতরে আলাপ আলোচনা চলছে। বর্তমান সংবিধানের আওতায় হলেও তার স্বরূপ কি হবে তা এখনো নিশ্চিত নয়। রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দেবে বলে এক বছর পর্যন্ত তা ঝুলিয়ে রেখেছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাবন্দি থাকায় বিষয়টি এখনো ধোয়াশায়। নির্বাচনকালীন সরকার প্রসঙ্গে সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘সংসদ ভেঙে যাওয়া এবং সংসদ সদস্যদের অব্যবহিত পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তীকালে এই অনুচ্ছেদের (২) বা (৩) দফার অধীন নিয়োগদানের প্রয়োজন দেখা দিলে সংসদ ভেঙে যাওয়ার অব্যবহিত পূর্বে যাঁরা সংসদ সদস্য ছিলেন এই দফার উদ্দেশ্য সাধনকল্পে তাঁরা সদস্যরূপে বহাল রয়েছেন বলে গণ্য হবেন। এ ইস্যুতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, কিভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তা আমাদের সংবিধানে সম্পূর্ণভাবে বলা আছে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে। সেই সরকার সর্বোতভাবে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনায় সহায়তা দিয়ে যাবে। বিএনপি আরো বলেছে, বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী যদি সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাহলে সেই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। কারণ সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় নির্বাচনকালীন সরকারও হবে বিদ্যমান সরকারেরই অনুরূপ। এদিকে সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের উল্লিখিত ২ দফায় প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগ এবং ৩ দফায় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠের আস্থাভাজন ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের কথা বলা আছে। সেকারণে আগামী নির্বাচনের আগে সংবিধানের আওতায় একটি অন্তর্বতীকালীন বা সর্বদলীয় সরকার হতে পারে।
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সাম্প্রতিক দাবি অনুযায়ী ৫টি মন্ত্রণালয় বিএনপিকে দেয়ার চিন্তা ছিল। কিন্তু আসন্ন নির্বাচনের আগে তাদের ২০১৪ সালের মতো কোনো প্রস্তাব আর দেয়া হবে না বলে তিনি নিশ্চিত করেছেন। এর আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী আগামী নির্বাচনের আগে একটি নির্বাচনী মন্ত্রিসভা গঠন করবেন। আর তাতে তিনি যাকে খুশি রাখবেন, যাকে খুশি বাদ দিতে পারেন। ১২৩ অনুচ্ছেদ বলেছে, সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে (ক) মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে এবং (খ) মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে। তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার (ক) উপ-দফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, উক্ত উপ-দফায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না। এতসব বিতর্ক আর এতসব কৌতুহলের শেষ পরিণতি কি হবে তার জন্য হয়তো অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েকটি মাস। সমাধান যেটাই হোক না কেন বাংলাদেশের মানুষের শেষ পর্যন্ত আস্থা রাজনীতিবিদদের ওপরেই। কারন এই দেশটির জন্মের জন্য কৃতিত্বের বেশিরভাগ দাবিদার যে তারাই।