শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে অচল ঢাকা
কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচী কিংবা জাতীয় কোনো কার্যক্রম ছাড়া এই প্রথম বাংলাদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই বৃষ্টি ঝরেছে।
কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা ও বৃষ্টি বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদেরকে রাজপথে অবস্থান নেওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেনি। রাজধানীর প্রায় সবক'টি সড়কে অবস্থান করেছে শিক্ষার্থীরা। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই অবরোধ করেছে, স্লোগান দিয়েছে, বিক্ষোভ করেছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র বিক্ষোভে কার্যত অচল হয়ে পড়ে ঢাকা।
ঢাকা শহর জুড়ে আজও পাবলিক বাস খুব একটা চলাচল করতে দেখা যায়নি। অনেকে ব্যক্তিগত গাড়ি রাস্তায় বের করেননি। যারা রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বের হয়েছেন তাদের কেউ-কেউ বিড়ম্বনায় পড়েছেন।
রাজধানীর কুর্মিটোলায় বাসের চাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় চলমান ছাত্র বিক্ষোভের মধ্যে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে বুধবার রাতে জরুরী সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার দেশের সব স্কুল কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নোটিশ দিয়ে এমনকি অলিখিতভাবে শিক্ষার্থীদের ঘর থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু বাস চাপায় শিক্ষার্থীর প্রাণহানির প্রতিবাদ ও ন্যায় বিচারের দাবির তাড়নায় পঞ্চমদিনের মতো বৃহস্পতিবারও রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে অবস্থান নিয়েছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। ক্লাস না থাকলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত ড্রেস ও কাঁধে ব্যাগ নিয়েই বিক্ষোভে যোগ দেন তারা।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রাজধানীর উত্তরা, মৌচাক, মালিবাগ, মগবাজার, শাহবাগ, সাইন্স ল্যাবরেরি, গুলশান, রামপুরা, মহাখালী, ফার্মগেট, আসাদগেট, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নিয়েছে শিক্ষার্থীরা। গত বছর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আরোপিত ভ্যাট বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর আরেক দফা শিক্ষার্থীদের একতা দেখতে পেল দেশবাসী। এর মধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের একাত্মতা ছিল চোখে পড়ার মতো।
তবে সব কর্মসূচীকে ছাপিয়ে এবার কর্মসূচী যেন নতুন মাত্রা পেয়েছে। সবকিছু উপেক্ষা করে প্রতিদিনের মতোই নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার এবং ঘাতক বাসচালকের ফাঁসির দাবিতে বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে রাস্তা অবরোধের পাশাপাশি বিভিন্ন যানবাহনের কাগজ ও চালকদের লাইসেন্স পরীক্ষা করছেন শিক্ষার্থীরা। গাড়ির কাগজপত্র সব ঠিক থাকলেই কেবল গাড়িগুলোকে যেতে দিচ্ছেন তারা। বিশেষ করে পুলিশের গাড়ির লাইসেন্সও চেক করতে দেখা গেছে তাদের।
শিক্ষার্থীদের এই কর্মসূচীর কারণে পুরো দেশ কার্যত অচল। রাজধানীর তিনপাশে রয়েছে মহাসড়ক। যেগুলো দিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে ঢাকার যোগাযোগ হয়। সকাল থেকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কসহ সব মহাসড়কই পরিবহন শুন্য।
রাজধানীসহ দেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা অলিখিত ধর্মঘট পালন করছেন।
এদিকে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, মালিক-শ্রমিকরা আতঙ্কে রাস্তায় গাড়ি নামাননি। গাড়ি নামাতে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের অনুরোধও করা হয়।
প্রসঙ্গত, রোববার জাবালে নূর পরিবহনের দুই বাসের প্রতিযোগিতায় কুর্মিটোলায় বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়। আহত হয় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় দুই বাসের চালক ও সহকারীসহ গ্রেপ্তার হয়েছে পাঁচজন।
দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় ঘাতক চালকের মৃত্যুদণ্ড ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে সেই থেকে আন্দোলন করছে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। সরকারের পক্ষ থেকে বিচারের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষার্থীদের শান্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জানান, শিক্ষার্থীদের ৯ দাবি মেনে নিয়েছে সরকার।
কিন্তু শিক্ষার্থীরা সরকারের আশ্বাসে বিশ্বাস করছে না। তাদের মূল দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে তারা।
শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবি: নিরাপদ সড়ক, ঘাতক বাস চালকদের বিচার করাসহ ৯ দফা দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে আসছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। যে ৯ দফা দাবিতে বিক্ষোভ করছে শিক্ষার্থীরা সেগুলো হচ্ছে–
১. বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো ড্রাইভারকে ফাঁসি দিতে হবে এবং এই বিধান সংবিধানে সংযোজন করতে হবে।
২. নৌপরিবহন মন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার করে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে।
৩. ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ ও লাইসেন্স ছাড়া চালকরা গাড়ি চালাতে পারবেন না।
৪. বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেয়া যাবে না।
৫. শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএস ফুটওভারব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৬. প্রত্যেক সড়কে দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় স্পিডব্রেকার দিতে হবে।
৭. সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্রছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে।
৮. শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে থামিয়ে তাদের নিতে হবে।
৯. শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
এর সঙ্গে বৃহস্পতিবার থেকে নতুন দাবি যোগ হয়, নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের পদত্যাগ।