মন্ত্রী বললেন, শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলে দায় প্রতিষ্ঠান প্রধানদের
বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় পুরো বাংলাদেশেই বিক্ষোভ করছে শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফেরাতে এবার কঠোর হুঁশিয়ারী দিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।
তিনি বলেছেন, শিক্ষার্থীরা আগামীকাল (সোমবার) থেকে আন্দোলনে নামলে তার দায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের নিতে হবে।
‘শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের বোঝাতে হবে। প্রধান শিক্ষক হয়ে যদি শিক্ষার্থীদের বোঝাতে না পারেন তাহলে প্রধান শিক্ষক হয়েছেন কেন’,- প্রশ্ন রাখেন তিনি।
‘শিক্ষার্থীদের অবশ্যই শিক্ষকদের কথা শুনতে হবে’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘মিথ্যা গুজবে শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। কোনো কোনো মহল এর সুবিধা নিতে পারে। তাই শিক্ষার্থীদের এখন ক্লাসে ফিরতে হবে, ঘরে ফিরতে হবে। তাদের দাবি সরকার মেনে নিয়েছে। তার বাস্তবায়নে কাজ চলছে।’
রোববার রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ঢাকা মহানগরীর সব কলেজের (সরকারি-বেসরকারি) অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষদের সঙ্গে জরুরি মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘তারা যে আন্দোলন করছে তা যৌক্তিক। আমরা তাদের দোষারোপ করছি না। তারা যৌক্তিক দাবিতে রাস্তায় নেমেছে। শিক্ষা পরিবারের সদস্য হিসেবে আমরা তাদের একা ছেড়ে দিতে পারি না।’
'শিক্ষার্থীরা অামাদের দেখিয়ে দিয়েছে দেশের সড়কে কীভাবে শৃঙ্খলা অানা যায়। কিন্তু এভাবে দীর্ঘদিন চলতে পারে না। যাদের কাজ তাদের করতে দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের এবার ঘরে ফিরতে হবে। ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তাদের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সে ব্যাপারে সরকার সজাগ রয়েছে। তাদের কোনো সমস্যা হোক সেটা অামরা চাই না',- বলেন তিনি।
সড়কে চালকরা নিয়ম মানেন না উল্লেখ করে নাহিদ বলেন, সড়কে অনিয়ম চলছে। তারা (চালকরা) নিয়ম মানে না। এমনকি সড়কে যেসব গাড়ি চলে সেগুলোই ঠিক না, ফিটনেসবিহীন গাড়ির ছড়াছড়ি। এগুলো চলতে পারে না।
পরিবহন খাতে যারা কাজ করে তারা বাইরের কেউ না উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারাও অামাদের দেশেরই জনগণ। তাদের সন্তানরাও রাস্তায় চলাচল করেন। সুতরাং এই অনুভূতি তাদের থাকা উচিত।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. মাহবুবুর রহমানের সভাপত্বিতে মতবিনিময় সভায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন, কলেজ পর্যায়ের ২৪২ অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ এবং স্কুলপর্যায়ে প্রায় ৫০০ জন প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন।
শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরিয়ে আনতে মতবিনিময় সভায় স্কুল ও কলেজ প্রধানদের পরামর্শ জানতে চাইলে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষকরা বলেন, সড়ক আন্দোলনে অনেক কথিত শিক্ষার্থী ঢুকে গেছে, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র তৈরি করে তারা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে। তাদের চিহ্নিত করতে হবে।
তারা বলেন, বর্তমানে সেসব শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত থাকবে তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ক্লাসে ফিরিয়ে আনতে হবে। অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ক্লাস শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান প্রধানদের মতবিনিময় করে বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে হবে। পরিবহন সেক্টরের সঙ্গে আলোচনা করে যান চলাচল স্বাভাবিক করতে হবে। শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া চালু করতে হবে। প্রধান সড়কগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা বাস সার্ভিস চালু করতে হবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে পুলিশি নিরাপত্তা বসাতে হবে। অপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষার্থীদের মোবাইল ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে। আর যাতে আন্দোলনের দিকে ধাবিত না হয়, সেজন্য প্রতিদিন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে।
প্রতিষ্ঠান প্রধানরা আরও বলেন, যারা আন্দোলনে উসকানি দিচ্ছে তাদের চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট তুলে দিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক করতে হবে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, মতবিনিময়ে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা যেসব পরামর্শ দিয়েছেন তাতে গুরুত্ব দেয়া হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষে যা করা সম্ভব তা বাস্তবায়নে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো, আর অন্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট হলে শিক্ষামন্ত্রী ওই মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেন।
তিনি বলেন, আন্দোলনে যুক্ত হওয়া শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে টিসি (ট্রান্সফার সার্টিফিকেট), জরিমানা করার গুজব ছাড়ানো হচ্ছে। কোনো শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। শিক্ষার্থীরা যাতে আন্দোলন ছেড়ে ক্লাসে আসে সেই নির্দেশনা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের দেয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত রোববার (২৯ জুলাই) দুপুরে কালশি ফ্লাইওভার থেকে নামার মুখে এমইএস বাসস্ট্যান্ডে ১৫-২০ জন শিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে ছিল। জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস ফ্লাইওভার থেকে নামার সময় মুখেই দাঁড়িয়ে যায়। তখন পেছন থেকে আরেকটি দ্রুতগতি সম্পন্ন জাবালে নূরের বাস ওভারটেক করে সামনে আসতেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। নিমিষেই বাসটি ওঠে পড়ে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের ওপর। চাকায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায় দুইজন। এ ছাড়া আহত হয় আরও ১৩ জন শিক্ষার্থী।
নিহত দুজন হলো- শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মিম ও বিজ্ঞান বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আব্দুল করিম রাজিব।
ওই ঘটনায় গত রোববার রাতেই নিহত মিমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ৩৩। এ ঘটনায় জাবালে নূরের তিনটি বাসের তিন চালক ও দুই হেলপারকে গ্রেফতার করে র্যাব।
আন্দোলনে নেমে নৌমন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবি করে শিক্ষার্থীরা। দাবিগুলো হলো- দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় দায়ী বেপরোয়া ড্রাইভারকে ফাঁসি দিতে হবে, নৌ-পরিবহনমন্ত্রীকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে, শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএস ফুটওভার ব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, প্রত্যেক সড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় স্প্রিড ব্রেকার দিতে হবে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্র-ছাত্রীদের দায়ভর সরকারকে নিতে হবে, শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে- থামিয়ে তাদের নিতে হবে, শুধু ঢাকা নয়, সারা বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে, ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ ও লাইসেন্স ছাড়া চালকরা গাড়ি চালাতে পারবেন না এবং বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেয়া যাবে না।