মধ্য আফ্রিকায় সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ প্রতিনিধি দলের ভিজিট
দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বমঞ্চে এখন সরব পদচারনা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর। আস্থা ও নিরাপত্তার প্রতীক হয়ে তারা কাজ করছেন। বাংলাদেশের জন্য বয়ে আনছেন গৌরব ও সম্মান। শান্তি ও মানবতা রক্ষায় লাল-সবুজের পতাকাকে তুলে ধরছেন স্ব-মহিমায়। সম্প্রতি দৈনিক মানবজমিনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক কাজী মুহা: আফিফুজ্জামান (কাজী সোহাগ) সেনাবাহিনীর একটি উচ্চ পদস্থ টিমের সঙ্গে গিয়েছিলেন মধ্য আফ্রিকায়। সেখানে সরেজমিনে দেখেছেন বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের কার্যক্রম। নিউইয়র্ক মেইলের জন্য তিনি লিখেছেন ১০ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আজ পড়ুন তার প্রথম পর্ব।
মধ্য আফ্রিকায় জাতিসংঘের শান্তি মিশনে কর্মরত বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের সার্বিক কার্যক্রম দেখতে গুডউইল ভিজিটে যায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ একটি প্রতিনিধি দল। দলটির নেতৃত্বে ছিলেন ১৭ পদাতিক ডিবিমনের জিওসি ও সিলেট এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল এস এম শামিম-উজ-জামান।
টিমের অন্য সদস্যরা হলেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাফিজ আহসান ফরিদ, কর্ণেল নুরুল হুদা, লে. কর্ণেল সিদ্দিকুর রহমান, মেজর মঈদুল হায়দার চৌধুরী, মেজর ইসমাইল কবির, মেজর সাকিবুল হক ও ক্যাপ্টেন খোরশেদ হাসান।
গত ২৭ জুন থেকে ৬ই জুলাই পর্যন্ত দলটি সেখানে অবস্থান করে। এর মধ্যে তারা বেশ কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করেন। বিশেষ করে জাতিসংঘের সঙ্গে শান্তিরক্ষী মিশন নিয়ে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেন তারা। পাশাপাশি মধ্য আফ্রিকাতে বাংলাদেশি মিশন পরিচালনায় আরও উন্নয়নে কি কি পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে তা খতিয়ে দেখে টিমটি। এছাড়া দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের কোনও সম্ভাবনা রয়েছে কি না তাও বিশ্লেষণ করা হয়। শান্তিরক্ষার পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয় গুডউউল ভিজিটের টিমের পক্ষ থেকে।
টিমের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রতিবছর নিয়মিত এ ধরণের গুডউইল ট্যুরে আসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি টিম। বর্তমানে মিশনে যারা কর্মরত রয়েছেন তাদের কাজের নানা দিক পর্যালোচনা করবে টিমটি। এছাড়া পরবর্তী মিশনে যে টিম কাজ করবে তাদের জন্য করণীয় কি হতে পারে তা নির্ধারণে এই টিম সুপারিশ তৈরি করবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ভবিষ্যতে মধ্য আফ্রিকায় শান্তি মিশনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরও কি কি কাজ করা যেতে পারে সে বিষয়টিও গভীরভাবে দেখা হবে। প্রতি বছর অপারেশনের জন্য অস্ত্রশস্ত্রসহ নানা ইক্যুপমেন্টের প্রয়োজন হয়। এসব সরবরাহ করে বাংলাদেশ। জাতিসংঘ এজন্য বাংলাদেশকে ভাড়া পরিশোধ করে। দ্বন্ধ-সংঘাত লেগে থাকা এসব অঞ্চলে সব সময় ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হয় মিশনে কর্মরত বাংলাদেশিদের। সংঘাতে জড়িতরা প্রতিনিয়ত আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হচ্ছে। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখানে বাড়াতে হচ্ছে আধুনিক অস্ত্রের মজুদ।
গুডউইল ভিজিটের টিমের সদস্যরা শান্তিরক্ষী মিশনে আধুনিক অস্ত্র সংযোজনের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখবে। প্রয়োজন অনুযায়ী তারা অস্ত্র সংযোজনের পরামর্শ দেবে। শান্তি রক্ষার স্বার্থে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা এখানে দিনরাত কাজ করছেন জীবনকে হুমকির মধ্যে রেখে। কারণ স্থানীয় পর্যায়ে বিবাদমান গ্রুপগুলোর মধ্যে যে কোন সময় বেধে যেতে পারে রক্তক্ষয়ী সংষর্ষ। তাই সব সময় পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে নিয়ে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হয় এখানে মিশনের কাজ করা ব্যক্তিদের।
এদিকে বাংলাদেশি সেনাবাহিনী যখন থেকে এখানে কাজ করা শুরু করে তখন থেকে এখানে বড় ধরনের কোনও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়নি বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশি সেনাবাহিনীর আলাদা ইমেজ তৈরি হয়েছে। প্রতি মুহুর্তে অসীম সাহসিকতা আর অদম্য মনোবল নিয়ে কাজ করায় এখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার যাত্রাকে অনেকটা সবল করে তুলেছে। শুধু শান্তি রক্ষা নয় স্থানীয় পর্যায়ে নানা ধরনের সামাজিক কর্মকান্ডেও অবদান রেখে চলেছে বাংলাদেশি সেনাবাহিনী।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আফ্রিকার অধিকাংশ দেশই সীমাহীন দারিদ্র্যের মধ্যে নিপতিত। সেই গরীবের মধ্যে আরও গরীব সেন্ট্রাল আফ্রিকা রিপাবলিক। দেশটির আয়তন ২ লাখ ৪০ হাজার বর্গমাইল। রাজধানীর নাম বাঙ্গী। শিক্ষার হার ৫০ শতাংশ। মুদ্রার নাম সেফা। সাংহো এবং ফরাসি এই দুইটি ভাষা প্রচলিত। সম্পূর্ণ জাতি প্রায় ৮০টি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত।
দেশটিতে প্রচুর পরিমাণে হীরা, ইউরোনিয়াম, তেল এবং সোনার খনি রয়েছে। কিন্তু নিজেদের হানাহানির কারনে সেই সম্পদ তাদের ভাগ্যবদলে কাজে লাগছে না। নিজেদের অভ্যন্তরীন সংঘাতে রক্ত ঝরছে নিয়মিত। এখানকার মানুষের হাতে হাতে অস্ত্র। অসংখ্য সশস্ত্র গ্রুপ পরষ্পরের সঙ্গে হানাহানিতে লিপ্ত। বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ বড় সেন্ট্রাল আফ্রিকায় মানুষ মাত্র ৪৭ লাখ। এই অল্প সংখ্যক মানুষের দেশটিতে বিপজ্জনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্বের দ্বিতীয় অশান্তিময় দেশ হচ্ছে এই সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক। দেশটিতে দীর্ঘদিন ধরে চলছে জাতিগত সংঘাত। এখানকার মানুষ ভারি অস্ত্র দিয়ে গোলাগুলি করাটা রীতিমত উৎসব বলে মনে করে। নিষ্ঠুরতা তাদের অস্থিত্বে মিশে আছে। এ পরিস্থিতিতে দেশটিতে জাতিগত যুদ্ধ বহুদিন ধরেই চলছে।
জাতিগত বিরোধকে কেন্দ্র করে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। পরবর্তীতে পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় জাতিসংঘ এখানে ২০১৪ সালে ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে শান্তি রক্ষা মিশন চালু করে। শান্তিমিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা দেশটিতে কাজ শুরুর পর তাদের দক্ষতা, পেশাদারিত্ব এবং আন্তরিকতার মাধ্যমে এ দেশের সরকার এবং জনসাধারণের আস্থা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে। এখানে পানির সমস্যা প্রকট। রয়েছে বিদ্যুতের সমস্যাও। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি এসব সমস্যা নিরসনে কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চৌকস ও কর্মঠ সদস্যরা। যারা পরিবার-পরিজন ফেলে বছরের পর বছর বিশ্ব শান্তি রক্ষায় কাজ করছে বাংলাদেশ থেকে যোজন যোজন দুরত্বে।