আফ্রিকায় কষ্টের গৌরবগাঁথা
দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বমঞ্চে এখন সরব পদচারনা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর। আস্থা ও নিরাপত্তার প্রতীক হয়ে তারা কাজ করছেন। বাংলাদেশের জন্য বয়ে আনছেন গৌরব ও সম্মান। শান্তি ও মানবতা রক্ষায় লাল-সবুজের পতাকাকে তুলে ধরছেন স্ব-মহিমায়। সম্প্রতি দৈনিক মানবজমিনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক কাজী মুহা: আফিফুজ্জামান (কাজী সোহাগ) সেনাবাহিনীর একটি উচ্চ পদস্থ টিমের সঙ্গে গিয়েছিলেন মধ্য আফ্রিকায়। সেখানে সরেজমিনে দেখেছেন বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের কার্যক্রম। নিউইয়র্ক মেইলের জন্য তিনি লিখেছেন ১০ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আজ পড়ুন তার তৃতীয় পর্ব।
ছেলের জন্মের পরই মধ্য আফ্রিকার শান্তি মিশনে আসেন তিনি। এখন ছেলের বয়স ছয় মাস। নিজের প্রথম সন্তান হওয়ায় বাড়তি আকর্ষন তার। কিন্তু ছেলেকে না দেখেই কাজ করতে হচ্ছে তাকে। অসুস্থ স্ত্রীর পাশেও থাকতে পারছেন না। আরেকজনের মা গুরুতর অসুস্থ। যে কোন সময় হয়তো শুনতে হবে কোন খারাপ খবর। এরকম অসংখ্য উদাহরনের স্বাক্ষী হয়ে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৮ হাজার কিলোমিটার দুরত্বে কাজ করছেন সেনাবাহিনীর একটি চৌকষ দল। অসংখ্য কষ্টগাঁথা বুকে নিয়ে দেশকে এনে দিচ্ছেন সাফল্যের গৌরবগাঁথা।
মধ্য আফ্রিকার বাংগুই এর এমপোকোতে অবস্থিত সেনা সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এরকম অসংখ্য কষ্টের কথা জানা যায়। তবে তাদের সবসময়ের হাসিমুখ দেখে এটা বোঝার উপায় নেই। এসব প্রকাশও করতে চান না তারা। এ ধরনের কষ্টগাঁথা শুধু মিশনে কর্মরতদের না, একই কষ্টের মধ্যে থাকতে হয় তাদের পরিবারের সদস্যদেরও।
মিশনে কোন দূর্ঘটনার কথা শুনলেই পরিবারের সদস্যদের অন্তরাত্বা কেঁপে ওঠে বলে জানান সেনা সদস্যরা। পরিবারের সদস্যরা খোঁজ নিতে থাকেন স্বামী, ভাই বা বোনের। ভাগ্য সু-প্রসন্ন হলে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব হয়। না হলে কোন অফিসারে দেশে থাকা স্ত্রী বা অন্যদের কাছ থেকে খবর জানতে হয়।
অন্যদিকে আফ্রিকার দূর্গম অঞ্চলে কোন অপারেশনে থাকলে যোগাযোগ করার কোন সুযোগ থাকে না। তাই শঙ্কা, সন্দেহ আর আতঙ্ক নিয়েই অপেক্ষা করতে হয় পরিবারের সদস্যদের।
বাংলাদেশ স্পেশাল ফোর্স বা ব্যানএসএফ এর এক সদস্য জানান, পরিস্থিতি ঠিক থাকলে স্ত্রীর সঙ্গে হয়তো নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হয়। কিন্তু প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মা, বাবার সঙ্গে প্রতিদিন যোগাযোগ রাখি না। কারন প্রতিদিন যোগাযোগ রাখলে তারা প্রত্যাশা করবেন প্রতিদিন কথা বলার। অনেক সময় অপারেশনের জন্য আমাদের যেতে হয় দূর্গম জঙ্গলে। যেখানে তৎপর থাকে দূর্ধর্ষ সব অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। একটানা কয়েকদিন সেখানে অপারেশনে থাকলে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয় না। এতে মা, বাবা আতংকিত হযে অসুস্থ হতে পারেন। কখনও দূর্ঘটনাও ঘটতে পারে। অতীতে এরকম অনেক ঘটেছে। তাই সপ্তাহে এক বা দুইবার কথা বললে তারা চিন্তামুক্ত থাকেন।
মধ্য আফ্রিকার দূর্গম অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আধূনিক মারণাস্ত্র নিয়ে সক্রিয় রয়েছে প্রায় ১০টি দূর্ধর্ষ বাহিনী। সংখ্যায় তারা প্রায় ৯ হাজার। এদের মধ্যে এন্টি বালাকা আর এক্স সেলেকা সবচেয়ে বেশি দূর্ধর্ষ। এসব সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে রয়েছে-এম-১৬, আরপিজি, এইচএমজি ও কানাশনিকভ এর মতো অত্যাধুনিক অস্ত্র। প্রতিনিয়ত এদের সঙ্গে লড়েই মধ্য আফ্রিকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষীরা।
বিশ্বের ২১টি দেশের ২৭টি কন্টিনজেন্ট কাজ করছে মধ্য আফ্রিকায়। মাত্র ৩টি কন্টিনজেন্ট নিয়ে শান্তি রক্ষায় কাজ করছে বাংলাদেশ। দূর্গম জায়গা হওয়ায় কোন অপারেশনে কয়েক সপ্তাহ লেগে যায়। সম্প্রতি পৃথক দুটি অপারেশনে একটানা ৮২ ও ৩০ দিন সময় লেগে যায়। এসময়টুকু তাদের থাকতে হয়েছে গহীন জঙ্গল আর ঝুঁকিপুর্ণ এরিয়ায়।
এদিকে এ রিপোর্ট যখন লেখা হচ্ছে তখন মধ্য আফ্রিকার গ্রীমারিতে ৪টি এপিসি ও ২টি এলএবি নিয়ে ৫ দিন ধরে আটকে আছেন ৮০ জন বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী। এপিসিতে ত্রুটি দেখা দেয়ায় ঘন জঙ্গলের মাঝে আটকে আছেন তারা। আরও কয়দিন লাগবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। দলটি বাংগুই থেকে ৩৮০ কিলোমিটর দূরত্বে অবস্থিত বামবারিতে যাচ্ছিলো। সাধারনত এ রাস্তা যেতে সময় লাগে ৩ দিন।
বাংগুই কন্টিজেন্টে থাকা সেনা কর্মকর্তারা জানান, আটকে থাকা সেনা সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে তাদের পরিবারের অনেক সদস্য আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তাদের জানিয়েছি, তারা সুস্থ আছেন, ভালো আছেন। শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন না পরিবারের সদস্যরা।
কন্টিনজেন্টে থাকা আরেক সেনা সদস্যের ছোট ছেলে অসুস্থ। কিন্তু ওই কর্মকর্তার মুখে হাসি দেখে বোঝার উপায় নেই।
তিনি জানান, এখানে আমরা যে কয়জন আছি তারা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছি। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে শত কষ্ট আর প্রতিকুল পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করছি। এতে আমাদের মনে কোন দু:খ নেই। কারণ দেশের জন্য কাজ করতে পারাটা অনেক গর্বের, অনেক সম্মানের।
আরও কয়েক সেনা কর্মকর্তা বলেন, আমাদের সফলতা মানেই দেশের সফলতা। জাতিসংঘ আমাদের ওপর যে আস্থা রেখেছে তা নষ্ট হতে দিতে পারি না। আমাদের পূর্বসুরিরা এখানে কাজ করে দেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছেন। এজন্য তাদের অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। তাই বাংলাদেশের অর্জিত এ সম্মান ধরে রাখতে আমরাও প্রস্তুত সব ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে।
তারা বলেন, বাংলাদেশ ভালো থাকলে আমরাও ভালো থাকবো। পরিবারের মুখে থাকবে অনাবিল সুখের হাসি। এদিকে জাতিসংঘের মূল্যায়নে, মালিকে বলা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ শান্তিরক্ষা মিশন। ঝুঁকির বিবেচনায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে এই সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক।
বর্তমানে মধ্য আফ্রিকায় তিনটি কন্টিনজেন্ট নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ। একটি হলো ব্যানএসএফ, যার সদস্য সংখ্যা ১৫০ জন। কমান্ডো ট্রেনিংসহ বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা এরইমধ্যে সাফল্যের সঙ্গে অনেক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। ব্যানব্যাট নামে আরেকটি কন্টিনজেন্টের সদস্য রয়েছেন ৮০২ জন।
এছাড়া চিকিৎসা সেবার জন্য গঠিত ব্যানমেড কন্টিনজেন্টের সদস্য রয়েছে ৬৯ জন। সবমিলিয়ে বর্তমানে এখানে কাজ করছেন ১০৪৬ জন বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী। তাদের দূর্দান্ত সাহসী ভূমিকা আর অবিশ্বাস্য সব ত্যাগ দিয়ে লাল-সবুজের পতাকাকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরছেন গৌরবময় জাতি হিসেবে।