মধ্য আফ্রিকায় শান্তিরক্ষীদের সম্ভাবনা
দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বমঞ্চে এখন সরব পদচারনা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর। আস্থা ও নিরাপত্তার প্রতীক হয়ে তারা কাজ করছেন। বাংলাদেশের জন্য বয়ে আনছেন গৌরব ও সম্মান। শান্তি ও মানবতা রক্ষায় লাল-সবুজের পতাকাকে তুলে ধরছেন স্ব-মহিমায়। সম্প্রতি দৈনিক মানবজমিনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক কাজী মুহা: আফিফুজ্জামান (কাজী সোহাগ) সেনাবাহিনীর একটি উচ্চ পদস্থ টিমের সঙ্গে গিয়েছিলেন মধ্য আফ্রিকায়। সেখানে সরেজমিনে দেখেছেন বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের কার্যক্রম। নিউইয়র্ক মেইলের জন্য তিনি লিখেছেন ১০ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আজ পড়ুন তার সপ্তম পর্ব।
মধ্য আফ্রিকায় কাজ করা বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের নানা সমস্যা ও সম্ভাবনার বিষয়টি পর্যালোচনা করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ একটি প্রতিনিধি দল। ২৭ জুন থেকে ৬ জুলাই পর্যন্ত ৮ সদস্যর দলটি সেখানে অবস্থান করে। এ সময়ের মধ্যে তারা বাংলাদেশের তিনটি কন্টিনজেন্ট বাংলাদেশ ব্যাটালিয়ন (ব্যানব্যাট), বাংলাদেশ স্পেশাল ফোর্স (ব্যানএসএফ) ও বাংলাদেশ মেডিকেল (ব্যানমেড) পরিদর্শন করেছেন। সেখানে কর্মরতদের সঙ্গে সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন তাদের সমস্যার কথা। আবার শান্তিরক্ষীদের অর্জন ও সাফল্যের কথা শুনে বাহবা দিয়েছেন।
দলটির নেতৃত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল এস এম শামিম-উজ-জামান। মধ্য আফ্রিকায় যাওয়া গুডউইলের টিমের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় ভাগ করে নেন। এর মধ্যে মিশন এলাকার রাজনৈতিক অবস্থা ও সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাফিজ আহসান ফরিদ, কন্টিনজেন্টের অভ্যন্ত্ররীন সমস্যা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনা নিয়ে দেখছেন কর্নেল নুরুল হুদা, মিশন এলাকার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের বিষয় নিয়ে কাজ করছেন লে. কর্ণেল সিদ্দিকুর রহমান, কন্টিনজেন্টের অস্ত্র ও সরঞ্জামাদির কার্যক্ষমতা পর্যালোচনা করছেন মেজর মঈদুল হায়দার চৌধুরী, কন্টিনজেন্টর আবাসস্থল পরিস্থিতি বিশ্লেষনের দায়িত্বে আছেন মেজর ইসমাইল কবির, কন্টিনজেন্টের লজিস্টিক সাপোর্ট দেখছেন মেজর সাকিবুল হক। এছাড়া অন্যান্য বিষয় পর্যালোচনা করছেন মেজর জেনারেল এস এম শামিম-উজ-জামান। বিশেষ করে মধ্য আফ্রিকার প্রধানমন্ত্রী, স্পিকারসহ উর্দ্ধতন কর্মকর্তা,জাতিসংঘের মিশন পরিচালনাকারি কর্তৃপক্ষ ও মিশনে অংশ নেয়া অন্যান্য দেশের কন্টিনজেন্ট প্রধানদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন তিনি।
মধ্য আফ্রিকাতে বাংলাদেশি মিশন পরিচালনায় আরও উন্নয়নে কি কি পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে তা খতিয়ে দেখছে টিমটি। পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনেতিক উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে গুডউইল ভিজিটের টিমের পক্ষ থেকে।
টিমের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রতি বছর নিয়মিত এ ধরণের গুডউইল ট্যুরে আসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি টিম। মিশনে যারা কর্মরত তাদের কাজের নানা দিক পর্যালোচনা করা হয়। এছাড়া পরবর্তী মিশনে যে টিম কাজ করবে তাদের জন্য করণীয় কি হতে পারে তা নির্ধারণে এই টিম সুপারিশ তৈরি করে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ভবিষ্যতে মধ্য আফ্রিকায় শান্তি মিশনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরও কি কি কাজ করা যেতে পারে সে বিষয়টিও গভীরভাবে দেখা হবে। মিশন এলাকার রাজনৈতিক ও সার্বিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাফিজ আহসান ফরিদ বলেন, এদেশের সম্পদের ওপর এখন অনেক দেশের আগ্রহ রয়েছে। সবাই সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছে। তাই দ্বন্ধটা আগের চেয়ে বেড়েছে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। আগে বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত ছিলো এখন সেটা কিছুটা ধর্মীয় দিকে মোড় নিয়েছে।
তিনি বলেন, বোয়ারের হেড অব অফিস আমাদের জানিয়েছেন, এখানে মুসলমানদের হাতে সব ধরণের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে কিন্তু তাদের রাজনৈতিক কোন ক্ষমতা নেই। আর খ্রিস্টানদের কাছে রয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতা কিন্তু অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রন নেই।
তিনি বলেন, বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা এখানে জাতিসংঘের হেলমেট পরার কারণে কোন দলের হয়ে কাজ করতে পারবে না। তারা জাতিসংঘের নির্দেশনা মেনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। কন্টিনজেন্টের অভ্যন্ত্ররীন সমস্যা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনা প্রসঙ্গে কর্নেল নুরুল হুদা বলেন, অন্যান্য মিশনের তুলনায় এখানে বাংলাদেশের সক্ষমতার তুলনায় বেশি এলাকা জুড়ে কাজ করতে হচ্ছে। বলা যায়,অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের কাজ করতে হচ্ছে। ব্যবসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এদেশে বাজার খুব ছোট। এখানে অনেক ভার্জিন ল্যান্ড রয়েছে। এমনও আনেক জায়গা রয়েছে যেখানে মানুষের পা পড়েনি। ভূমিগুলোও অনেক উর্বর। তাই কৃষি নির্ভর ব্যবসা করার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া যোগাযোগ সেক্টর বিশেষ করে টেলিকমিউনেকেশন খাতেও ব্যবসা করার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করি।
মিশন এলাকার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের বিষয় প্রসঙ্গে লে.কর্নেল সিদ্দিকুর রহমান বলেন, মিশনে যারা কাজ করেন তাদের মুলত প্রশিক্ষন নিতে হয় বাংলাদেশে। কিন্তু দেশের প্রশিক্ষন নিয়ে এ ধরনের দূর্গম ও বিরুপ পরিবেশে কাজ করাটা দুরুহ বিষয়। বলা যায়,এখানকার পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। তাই বেসিক প্রশিক্ষন নিয়ে এখানকার ভিন্ন পরিস্থিতিতে কাজ করাটাই মুল চ্যালেঞ্জের বিষয়।
তিনি বলেন, এরইমধ্যে মধ্য আফ্রিকায় মিশন কয়েক বছর হয়ে গেছে। তাই এখানে যারা কাজ করে গেছেন তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে। প্রতি বছর অপারেশনের জন্য অস্ত্রশস্ত্রসহ নানা ইক্যুপমেন্টের প্রয়োজন হয়। এসব সরবরাহ করে বাংলাদেশ। জাতিসংঘ এজন্য বাংলাদেশকে ভাড়া পরিশোধ করে। দ্বন্ধ সংঘাত লেগে থাকা এসব অঞ্চলে সব সময় ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হয় মিশনে কর্মরত বাংলাদেশিদের। সংঘাতে জড়িতরা প্রতিনিয়ত আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হচ্ছে। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখানে বাড়াতে হচ্ছে আধুনিক অস্ত্রের মজুদ। গুডউইল ভিজিটের টিমের সদস্যরা শান্তিরক্ষী মিশনে আধুনিক অস্ত্র সংযোজনের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখছেন। প্রয়োজন অনুযায়ী তারা অস্ত্র সংযোজনের পরামর্শ দেবেন।
এ প্রসঙ্গে মেজর মঈদুল হায়দার চৌধুরী বলেন, এখানে ২১টি দেশ শান্তিরক্ষায় কাজ করছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা অস্ত্র ব্যবহার করছে। তাছাড়া আফ্রিকায় যেসব সন্ত্রাসী আছে তাদের হাতে রয়েছে আধুনিক মারণান্ত্র। আমাদের শান্তিরক্ষীরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। তাই তাদের হাতে কি ধরণের অত্যাধুনিক অস্ত্র থাকা প্রয়োজন তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তিনি বলেন, এসব পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদন সেনাসদরে দেয়া হবে। উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। লজিস্টিক সাপোর্ট প্রসঙ্গে মেজর সাকিবুল হক বলেন, শান্তিরক্ষীদের জন্য বরাদ্দ রসদ সরবরাহে অনেক সময় দেরি হচ্ছে। আবার কিছু জটিলতার কারণে কোন কোন শান্তিরক্ষীকে অতিরিক্ত সময় থাকতে হচ্ছে। এসব বিষয় নিয়ে সুপারিশ দেয়া হবে।
তিনি বলেন, মধ্য আফ্রিকা হচ্ছে দূর্গম এলাকা। এখানে বিকেল ৫টার পর হেলিকপ্টার সুবিধা পাওয়া যায় না। তাই জরুরি ভিত্তিতে কাউকে উদ্ধার বা চিকিৎসার প্রয়োজন হলে তাতে ব্যাঘাত ঘটছে। এ এলাকায় দ্রুত হেলিকপ্টার সুবিধা আরও বাড়ানো উচিত বলে মনে করি। এদিকে কন্টিনজেন্টের আবাসস্থল পরিস্থিতি বিশ্লেষনের দায়িত্বে থাকা মেজর ইসমাইল কবির সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, এখানকার কন্টিনজেন্টগুলো তিন থেকে চার বছর হয়েছে মাত্র। তাই আবাস্থলের জন্য যা নির্মাণ করা হয়েছে তা এখনও নতুন রয়েছে।
গুডউইল টিমের অপর সদস্য ক্যাপ্টেন খোরশেদ হাসান বলেন, অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এখানে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা কাজ করছেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করছেন। এর মাধ্যমে তারা দেশকে করছেন সম্মানিত, লাল-সবুজের পতাকাকে তুলে ধরছেন বিশ্ব শান্তির মঞ্চে।