ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন ও নির্বাচনের প্রস্তুতি
ভোটের অধিকার আদায়ে এবার সারা দেশে ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মসূচি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি, ড. কামাল হোসেন নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া, অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট।
একই সঙ্গে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণেরও প্রস্তুতি নেবেন। তবে এ মুহূর্তে ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মসূচি দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের দাবিতে জনমত গড়ে তোলার কাজকেই অগ্রাধিকার তালিকায় রাখা হয়েছে।
বিএনপি, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া ও যুক্তফ্রন্ট নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য।
শনিবার রাজধানীর মহানগর নাট্যমঞ্চে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার উদ্যোগে ‘কার্যকর গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলুন’ শীর্ষক নাগরিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
এতে সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট আইনজীবী ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছিলেন প্রধান বক্তা। এর বাইরে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের বেশ কয়েকটি দল এবং বাম-প্রগতিশীল ঘরানার শীর্ষ নেতারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
এ সমাবেশ থেকে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে ১ অক্টোবর থেকে দেশব্যাপী ‘বৃহত্তর ঐক্যের’ ব্যানারে আন্দোলন কর্মসূচি দেয়ার ঘোষণা দেন সরকারবিরোধী নেতারা
জানা গেছে, নাগরিক সমাবেশ সফলভাবে আয়োজনের পর ২৬ সেপ্টেম্বর রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন ড. কামাল হোসেন।
এরই মধ্যে মিলনায়তন বুকিং দেয়া এবং ঢাকা মেট্রোপলিট পুলিশের (ডিএমপি) কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অনুমতি নেয়ার কাজটি সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সদস্য সচিব আ ব ম মোস্তফা আমিন।
রোববার তিনি বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে নাগরিক সমাবেশ করেছি। এবার সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করব। তাদের কথা শুনব, মতামত নেব।
কিভাবে আগামীতে একটি অর্থবহ নির্বাচনের দাবি আদায় করা যায়- সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এ নিয়ে কথা বলবেন।’
সূত্র জানায়, সুশীল সমাজের সঙ্গে মতবিনিময়ে অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট নেতারাও থাকবেন। রোববার ড. কামাল হোসেনের মতিঝিলের চেম্বারে এ নিয়ে বৈঠকও করেছেন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতারা।
কাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে তার একটি তালিকাও তৈরি করেন তারা এ সময়। এছাড়া আন্দোলনের অংশ হিসেবে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করতে চায় যুক্তফ্রন্ট।
এ জনসভায় ড. কামাল হোসেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপি, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া, যুক্তফ্রন্ট এবং সমমনা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত থাকবেন। পাশাপাশি সিলেট, রাজশাহী এবং ময়মনসিংহে পৃথক তিনটি জনসভার আয়োজনেরও পরিকল্পনা রয়েছে যুক্তফ্রন্টের।
এদিকে নাগরিক সমাবেশ থেকে দাবি আদায়ে দেশব্যাপী জনমত গড়ে তুলতে ১ অক্টোবর থেকে আন্দোলনের কর্মসূচি প্রণয়ন নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। রোববার বেলা ১১টায় গণফোরামের ইডেন কমপ্লেক্সের কার্যালয়ে দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়।
এ সময় বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যকে এগিয়ে নিতে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া এবং যুক্তফ্রন্ট মিলে একসঙ্গে আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি একই সঙ্গে নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণেরও সিদ্ধান্ত হয়। আন্দোলন গড়ে তোলার অংশ হিসেবে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠণের উদ্যোগ নেবে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া এবং যুক্তফ্রন্ট। পাশাপাশি দু’পক্ষের শীর্ষ নেতারা মিলে সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকাও তৈরি করবেন।
এ আন্দোলন ও নির্বাচনের প্রস্তুতিতে শরিক হবে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের নিবন্ধিত সব দল ও সমমনারা।
গণফোরামের বৈঠক সূত্র জানায়, দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠকে দলগতভাবে আন্দোলন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য ড. কামাল হোসেনকে প্রধান করে ৯ সদস্য বিশিষ্ট পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠন করা হয়। এ বোর্ড প্রার্থী বাছাই এবং মনোনয়নের কাজটি চূড়ান্ত করবে। আর নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের ওপর।
তারা মিলে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন। এছাড়া বৈঠকে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার কাজটি এগিয়ে নিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশ দিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘সারা দেশে যে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছে; এ জাতীয় ঐক্য জেলা, উপজেলা ও গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত করতে হবে।’
বৈঠকে তিনি আরও বলেন- গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে এ জাতীয় ঐক্যকে আরও বেগবান করতে হবে। সংসদ নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দিয়ে দল নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে হবে এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে।
এছাড়াও গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেফতার করার জন্য পুলিশকে যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তা বাতিল করতে হবে। ড. কামাল হোসেন এ সময় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলেরও দাবি জানান।
বৈঠক শেষে ড. কামাল হোসেন বলেন, শাসক দল সংবিধান লঙ্ঘন করে দেশ চালাচ্ছে। একটি ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা আরও ৫ বছর ক্ষমতায় থেকে শুধু লুটপাট করেছে। দলটির একজন নেতা ২০-২৫টি করে মুজিব কোট বানিয়েছেন। কিন্তু মুজিব কোটের মর্মার্থ তারা জানেন না। তাই এ অবস্থার অবসানে জাতীয় ঐক্যের যে যাত্রা শুরু হয়েছে, তা আরও এগিয়ে নিতে হবে।’
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান রোববার বলেন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছে।
এ ঐক্য একসঙ্গে আন্দোলন, এমনকি একসঙ্গে নির্বাচনেও রূপ নিতে পারে। তবে আগে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এ পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারলে ভোটে গিয়ে কি হবে? তিনি বলেন, বিএনপি সরকারবিরোধী অবস্থানে থাকা সবাইকে নিয়ে পথ চলতে চায়। এক্ষেত্রে যেখানে যতটুকু ছাড় দেয়া প্রয়োজন, তা দেয়া হবে। জাতীয় স্বার্থেই বিএনপি ছাড় দেবে।
যুক্তফ্রন্টের অন্যতম শরিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন বলেন, ‘আমরা ভোটের অধিকার রক্ষায় বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি। এ অধিকার রক্ষার অংশ হিসেবেই একসঙ্গে আন্দোলন, একসঙ্গে নির্বাচন এবং পরে একসঙ্গে সরকার পরিচালনার কথা বলছি।’
এদিকে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যকে এগিয়ে নিতে এবং আন্দোলনের জন্য যৌথ কর্মসূচি ঠিক করতে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া এবং যুক্তফ্রন্টের পক্ষ থেকে একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠনের কথাও ভাবা হচ্ছে। এ স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য হবেন গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন, বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সদস্য সচিব আ ব ম মোস্তফা আমিন এবং নাগরিক ঐক্যের ডা. জাহিদুল ইসলাম। দু-এক দিনের মধ্যে দু’পক্ষের শীর্ষ নেতারা বৈঠকে বসে এটি চূড়ান্ত করা হবে বলে জানা গেছে।