নির্বাচন হবে কি হবে না, জানি না: মহাসমাবেশে এরশাদ
আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে কি না, সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন হওয়া নিয়ে শঙ্কায় আছি, নির্বাচন হবে কি হবে না, জানি না। একটি দল সাত দফা দিয়েছে। সরকার মানতে চায় না। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী তা মানা সম্ভবও না। এ অবস্থার মধ্যে নির্বাচনের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন কাজ করছে। তবে আমরা দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই। এর জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে।’
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এ সময় ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেয়া এবং জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়ে আরও বলেন, ‘জোটগতভাবে নির্বাচন করব। আমরা ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেব। তবে দেশের স্বার্থে সেই সিদ্ধান্ত বদল হতে পারে। এ জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জাতীয় পার্টিই আবার ক্ষমতায় আসবে’। তিনি এ সময় জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দল নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করারও দাবি জানান।
শনিবার দুপুরে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন ‘সম্মিলিত জাতীয় জোট’র মহাসমাবেশে সভাপতির বক্তৃতায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এসব কথা বলেন।
নির্বাচনের আগমুহূর্তে জাতীয় পার্টির এই মহাসমাবেশ কার্যত জনসমুদ্রে পরিণত হয়। এর মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্য জানান দেয় দলটি।
মহাসমাবেশে এরশাদ বলেন, ‘ক্ষমতা ছাড়ার পর আমি যে অত্যাচার সহ্য করেছি তা আর কেউ করেনি। নব্বই সালের পর থেকে আমি একদিনও শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি, জেলে যাওয়ার ভয়ে। কখন নাকি আমাকে জেলে যেতে হয়’।
তিনি বলেন, ‘আমি দেশের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি। এটাই আমার জীবনের শেষ নির্বাচন। আমার জীবন দেশ ও জাতির জন্য উৎসর্গ করলাম।’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় পার্টির ১৮ দফা লক্ষ্য ঘোষণা করেন সাবেক এই রাষ্ট্রপতি। এর মধ্যে প্রাদেশিক সরকার গঠন করে প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ, নির্বাচন পদ্ধতি ও নির্বাচন কমিশনের সংস্কার ও পুনর্গঠন, সংখ্যালঘুদের জন্য জাতীয় সংসদে আসন সংরক্ষণ, শিক্ষা-স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন এবং সন্ত্রাস দমনে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তুতি রয়েছে।
এরশাদ বলেন, এই ১৮ দফাই জনগণের মুক্তির পথ। আমরা প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থা কায়েম করতে চাই। নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তন করতে চাই। উপজেলা পদ্ধতির পূর্ণাঙ্গ রূপ বাস্তবায়ন করব। সংখ্যালঘুদের সংসদে কোটা, ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চাই। শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা জাতিকে অন্ধকারে নিয়ে যাচ্ছে।
এরশাদ বলেন, এ মাসের মধ্যে আমরা পার্লামেন্ট বোর্ড গঠন করব। আমরা জোটগতভাবে ৩০০ আসনেই নির্বাচন করব। হয়তো তা পরিবর্তন হতে পারে। সে জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। সামনে আমাদের সুযোগ। এ সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জাতীয় পার্টি জয়ী হবে। সে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য দেশবাসীর দোয়াও চান সাবেক এ রাষ্ট্রপতি।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন, নির্বাচনের পাক্কালে এই মহাসমাবেশ। ২৭ বছর ক্ষমতায় নেই তারপরও মানুষ মনে রেখেছে। ৯ বছরে যা করেছি সেই উন্নয়নের চিহ্ন দেশ এখনো ধারণ করে আছে। গণতন্ত্রের জন্য ৯০ সালে তিন জোটের রূপরেখা অনুসারে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়েছি। তারপর ২৭ বছরে দেশের কী হাল হয়েছে।
তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন হয়তো হবে আমার জীবনের শেষ নির্বাচন। শেষ জীবনে নিজেকে দেশ ও জাতির জন্য উৎসর্গ করতে চাই। আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। তবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের নিশ্চয়তা চাই। নির্বাচনকালীন সরকার সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের সমন্বয় গঠন করতে হবে। দেশের স্বার্থে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ হতে পারে। সময়ের দাবি মেনেই আমরা পথ চলব।
নেতাকর্মীদের উদ্দেশে এরশাদ বলেন, জেলায় ফিরে গিয়ে প্রার্থী বাছাই করতে হবে। যারা আগ্রহী তাদের দলীয় আবেদন সংগ্রহ করতে হবে। এ মাসের মধ্যেই পার্লামেন্টারি বোর্ড ঘোষণা করব। তৃণমূলের সুপারিশ নিয়ে প্রার্থী চূড়ান্ত করব। ভোটকেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠন করে জেলা কমিটির মাধ্যমে আমার কাছে জমা দিতে হবে। জোটের শরিকরাও তাদের প্রার্থী তালিকা জমা দেবে। দলের পরিচয়ের চেয়ে প্রার্থীর যোগ্যতা বেশি বিবেচনা করা হবে। তবে শেষ কথা হচ্ছে নির্বাচনের জন্য অবশ্যই সরকারকে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
সমাবেশে বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ বলেন, বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করেছেন, আর এরশাদ স্বাধীনতার সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন। দেশবাসী এরশাদ শাসনামলেই স্বাধীনতার সত্যিকারের সুফল ভোগ করেছেন।
তিনি আরও বলেন, এবার জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যা যা করা দরকার তাই করবে। জাতীয় পার্টিকে ক্ষমতায় সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
রওশন এরশাদ বলেন, দেশ আজ মাদক আর সন্ত্রাসে ছেয়ে গেছে। এ থেকে জাতিকে পরিত্রাণ দিতে হলে জাতীয় পার্টির ক্ষমতায় আসা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, জাতীয় পার্টিকে ধ্বংস করতে বারবার চেষ্টা করা হয়েছে। পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে কারাগারে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। যারা এই ষড়যন্ত্র করেছে, তারাই আজ দুর্নীতি মামলায় সাজাগ্রস্ত।
তিনি বলেন, বিগত ২৭ বছর বহু উত্তাল পরিস্থিতি উপেক্ষা করে, অত্যাচার নিপীড়নের মধ্য দিয়েও জাতীয় পার্টি স্বগৌরবে, বিশাল শক্তি নিয়ে এখন রাজনীতির ময়দানে বীরদর্পে টিকে রয়েছে। এর কারণ, এরশাদ শাসনামল ছিল উন্নয়নের স্বর্ণযুগ। সে সময় ছিল না সন্ত্রাস, খুন-গুম ও জঙ্গিবাদ। মানুষের মাঝে উপলদ্ধি হয়েছে, দেশের উন্নয়ন ও শান্তি বজায় স্বার্থে এরশাদের বিকল্প নেই।
কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, দেশের মানুষ এবার এরশাদকে রাষ্ট্রক্ষমতায় দেখতে চায়। মানুষ মনে করে এরশাদের শাসনামলে তারা সুখে থাকবে। শান্তিতে ঘুমাতে পারবে। মায়ের কোলে সন্তান নিরাপদে থাকবে।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম বলেন, ‘এখন জনগণের কথা শোনার দিন। জনগণের ভাষা বোঝার দিন। আর সেই জনগণের মনের কথা বোঝেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তাই তিনি জনগণের ভাষায় কথা বলেন।
তিনি বলেন, দেশের আপামর জনতা, খেটে খাওয়া মানুষ, কৃষক, শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষ এখনো এশাদকে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দেখতে চায়। মানুষ আবার এরশাদের শাসনামলে ফিরে যেতে চায়।
অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম বলেন, জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের প্রতিটি দিকনির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চললে আমরা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব। আমার বিশ্বাস, মুক্তিকামী জনগণকে সঙ্গে নিয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ফের সরকার গঠন করতে সক্ষম হবে। সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে জনগণের রায় নিয়ে জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় আসতে পারলে ব্যাংক ডাকাত ও শেয়ারবাজার লুটেরাদের বিচার নিশ্চিত করবেন। তাই আমাদের ভবিষ্যতে সমৃদ্ধিশালী স্বনির্ভর শিল্প বিপ্লবের বাংলাদেশ গড়তে এরশাদের হাত ধরে এগিয়ে যেতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বিগত ২৭ বছর দেশের দুটি বড় দল সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করে দেশ ও জাতিকে যে অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে- সে অন্ধকারে আলো জ্বালাতে পারেন একমাত্র হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনিই একমাত্র জাতিকে আলোর পথ দেখাতে পারেন। আমি জোর গলায় বলতে পারি লাঙ্গলই এখন দেশের মানুষের মুক্তির একমাত্র ভরসাস্থল।
অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম বলেন, জাতীয় পার্টিকে ধ্বংস করার অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু এরপরেও জাতীয় পার্টি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে মাথা উঁচু করে টিকে আছে।
মহাসমাবেশে আরও বক্তৃতা করেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি, এসএম ফয়সল চিশতী, ফখরুল ইমাম এমপি, বিরোধী দলের চিফ হুইপ নুরুল ইসলাম ওমর এমপি, রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, ডা. রুস্তুম আলী ফরাজী এমপি। এছাড়াও জোটের শরীকদলগুলোর মধ্যে- ইসলামী ফ্রন্টের এমএ মান্নান, খেলাফত মজলিসের মাওলানা মাহফুজুল হক, ইসলামী ফ্রন্টের আল্লামা আবু সুফিয়ান, বিএনএ’র সেকান্দার আলী মনি, জাতীয় ইসলামী মহাজোটের আলহাজ-আবু নাছের ওহেদ ফারুক বক্তব্য রাখেন।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এমপি, এমএ সাত্তার, কাজী ফিরোজ রশীদ এমপি, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু এমপি, মো. আবুল কাশেম, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খান, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, আলহাজ-গোলাম কিবরিয়া টিপু, সাহিদুর রহমান টেপা, অ্যাড. শেখ মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, মুজিবুল হক চুন্নু এমপি, নুর-ই-হাসনা লিলি চৌধুরী এমপি, মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা, সুনীল শুভরায়, মীর আবদুস সবুর আসুদ, মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী।
এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন, মো. আজম খান, মশিউর রহমান রাঙ্গা এমপি, নাসরিন জাহান রতনা এমপি, মেজর (অব.) খালেদ আখতার, ব্যারিস্টার দিলারা খন্দকার, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য রওশন আরা মান্নান, রিন্টু আনোয়ার, মেরিনা রহমান এমপি, সৈয়দ দিদার বখত, রেজাউল ইসলাম ভুইয়া, ভাইস চেয়ারম্যান মাহজাবিন মোর্শেদ এমপি, অধ্যাপক ইকবাল হোসেন রাজু, জহিরুল ইসলাম জহির, আরিফুর রহমান খান, আলমগীর সিকদার লোটন।
নুরুল ইসলমা নুরু, সরদার শাহজাহান, পীর ফজলুর রহমান মেজবাহ এমপি, যুগ্ম মহাসচিব লিয়াকত হোসেন খোকা এমপি, ইয়াহিয়া চৌধুরী এমপি, গোলাম মোহাম্মদ রাজু, জহিরুল আলম রুবেল, কেন্দ্রীয় নেতা সুলতান মাহমুদ, ইসাহাক ভুইয়া, শেখ আলমগীর হোসেন, মনিরুল ইসলাম মিলন, মো. মহিবুল্লাহ, মাহমুদা রহমান মুন্নী, সৈয়দা পারভিন তারেক, মো. জাহাঙ্গীর আলম, কামরুজ্জামান মৃধা, মোস্তফা আল মাহমুদ, গোলাম মোস্তফা আঙ্গুর, সাইফুল ইসলাম, আলমগীর কবির মজুমদার, সৈকত আকন আলমগীর, সোলায়মান সামী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।