বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি এখন কোথায়
কাজী আফিফুজ্জামান সোহাগ: বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি কোথায়? এ প্রশ্ন এখন বাংলাদেশের মানুষের মুখে মুখে। দলের দুই কান্ডারী বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান অনুপস্থিত দীর্ঘদিন। বেগম খালেদা জিয়া জেল থেকে আর তারেক রহমান লন্ডন থেকে দলের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছেন। এর মধ্যে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে। জেলখানায় আত্মীয়-স্বজন ও তার মামলার আইনজীবীরা গেলে কেবল নির্দেশনা পাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক ইস্যু ও নির্বাচন নিয়ে আলোচনার সুযোগ খুব একটা পাচ্ছে না বিএনপি। অন্যদিকে তারেক রহমান বিদেশ থেকে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে। তবে রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে দলের অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে অবাধে আলোচনার সুযোগ সীমিত। নানা উপায় এবং সতর্কতার সঙ্গে তারেক রহমানকে যোগাযোগ করতে হচ্ছে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে। বিএনপি নেতাদের দাবি তারেক রহমান যার সঙ্গে যোগাযোগ করেন না কেন তার ফোন রয়েছে নজরদারিতে। কোটা আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সঙ্গে তারেক রহমানের ফোনালাপ ফাঁস হয়। এর আগে বিএনপি'র শীর্ষ নেতা শমসের মবিন চৌধুরীর সঙ্গে ফোনালাপ ফাঁস হয়। এসব কারণে তারেক রহমান সরাসরি যোগাযোগ না করে ভিন্ন উপায়ে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। অতীত উদাহরণের কারণে দলের শীর্ষ নেতারাও ফোনালাপ নিয়ে থাকেন সতর্ক ও তটস্থ। দুই শীর্ষ নেতার সঙ্গে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সাবলীল রাজনীতির চর্চা ব্যাহত হচ্ছে বিএনপির।
ঠিক এরকম একটি পরিস্থিতিতে দলটির নেতৃত্ব নিয়ে আদালতের নির্দেশনা আরো জটিল করে তুলেছে। ”দন্ডিত, দেউলিয়া ,উন্মাদ ও সমাজে দুর্নীতি পরায়ন বা কুখ্যাত বলে পরিচিত ব্যক্তি কমিটির সদস্য পদের অযোগ্য বিবেচিত হবেন” এমন বিধান গঠনতন্ত্রের ধারা বাদ দিয়ে আনা বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্র গ্রহণ না করতে অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। সম্প্রতি এক মাসের জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রতি এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিএনপির গঠনতন্ত্রে আনা ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে করা এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বুধবার ১ নভেম্বর বিচারপতি মোহাম্মদ আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন।
রিট আবেদনকারীর আইনজীবী মমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী নিউইয়র্ক মেইলকে বলেন, নির্বাচন কমিশন যদি দলটির সংশোধিত গঠনতন্ত্র অনুমোদন দেয় তাহলে ভিন্ন কথা। তবে যদি সংসদীয় গঠনতন্ত্র অনুমোদন না দেয় তাহলে বিএনপির আগের গঠনতন্ত্র কার্যকর থাকছে। ফলে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কার্যত দলীয় নেতৃত্বে থাকতে পারবেন না এবং তাদের দলীয় মনোনয়ন নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। কেননা ইতিমধ্যে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়েছেন। বিএনপি'র সংশোধিত ওই গঠনতন্ত্র অনুমোদন না করার জন্য ৩০ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেন ঢাকার মিরপুর১৩ এর কাফরুলের বাসিন্দা মোহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেন!।তিনি নিজেকে বিএনপি'র আদর্শে উজ্জীবিত একজন কর্মী বলে পরিচয় দেন!। সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এর আগে ২৮অক্টোবর তিনি রিটটি করেন। যার ওপর পয়লা নভেম্বর শুনানি হয়। মোজাম্মেল হোসেনের এফিডেফিট এ উল্লেখিত মিরপুর১৩ নম্বরে বাইশটেকি এলাকায় গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে হলফনামায় যে ঠিকানা দেওয়া হয়েছে সেই বাড়ি গত জুন মাসে ছেড়েছেন তিনি। বাড়িটির মালিক সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ফজলুল হক নিউইয়র্ক মেইলকে বলেন, মোজাম্মেল আইনজীবী ছিলেন বলেই তিনি জানতেন। এর বাইরে তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কিনা সেই বিষয়ে তার ধারণা নেই। মোজাম্মেলের রাজনৈতিক আদর্শের বিষয়ে এলাকার আর কেউ কিছু জানাতে পারেননি। তিনি বাইশটেকির বাড়িতে বছরখানেক ছিলেন। এর মধ্যে এলাকার লোকজনের সঙ্গে খুব বেশি মেলামেশা হয়নি তার। একটি মোবাইল নম্বর পাওয়া গেলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
আদালতের নির্দেশনার পর নেতৃত্ব নিয়ে আইনি জটিলতায় পড়ে অনেকটা শূন্যতায় পড়েছে বিএনপি। তাই স্বাভাবিকভাবেই এখন প্রশ্ন উঠছে রাজনৈতিকভাবে বিএনপি'র অবস্থান এখন কোথায়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে দলটি চলমান সংলাপে অংশ নিয়েছে তবে এককভাবে অংশ নেয়ার সুযোগ হয়নি তাদের। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট এর ব্যানারে তাদের অংশ নিতে হয়েছে। পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক বিবেচনায় হয়তো বিএনপিকে এ কৌশল নিতে হয়েছে। কিন্তু দলটির কর্মী সমর্থক ও ভোটাররা বিষয়টিকে কিভাবে নিচ্ছেন তা কি ভেবে দেখেছে বিএনপি'র শীর্ষ নেতারা?
নিউইয়র্ক মেইল এর পক্ষ থেকে এ নিয়ে যোগাযোগ করা হয়েছিল বিভিন্ন স্তরের কর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে।বেশিরভাগই বিষয়টিকে দলের জন্য দৈন্যতা হিসাবে দেখছেন। তারা বলছেন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ছিল বিএনপিকে নিয়ে সেটাই তারা বাস্তবায়ন করছে মাত্র। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপি পরিস্থিতির শিকার হয়েছে। তবে তারা প্রশ্ন তুলেছেন এই জন্য আসলে দায়ী কে বিএনপি নেতৃত্ব নাকি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দক্ষতা ? তাদের মতে সংলাপ ইস্যু নিয়ে রাজনীতির তুরুপের তাস ছিল বিএনপি'র হাতে। দলটি ভেবেছিল সংলাপে রাজি হবে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও দলের অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের ধারাবাহিক বক্তব্যে সে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। অর্থাৎ তারা বারবার সংলাপের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ করে প্রধানমন্ত্রী সংলাপে রাজি হয়ে যান। এতে ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘুরে যায় বাংলাদেশের রাজনীতির চাকা। বিএনপির তুরুপের তাস হাত বদল হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগের হাতে। তাই ক্রমশ উত্তপ্ত হতে যাওয়া রাজনীতির পালে দোলা দেয় অমৌসুমী হাওয়া। কোট বদল করে বল, এতে আরও রাজনৈতিক দৈন্যতায় পরড় বিএনপি।
বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতির ছবি একেবারে নতুন আর অভিনব। গত কয়েক দশক ধরে ছিল আওয়ামী লীগ আর বিএনপি রাজত্ব। এখন অনেকটা ব্যাকফুটে চলে গেছে বিএনপি। জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে আলোচিত হচ্ছে ঐক্য ফ্রন্ট, ড. কামাল হোসেন, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাম। আলোচনা হচ্ছে সাবেক প্রেসিডেন্ট বদরুদ্দোজা চৌধুরী আর বাম জোটের নাম। অতীতে এ চিত্র দেখা যায়নি। সংলাপের ফলাফল নিয়েও স্পষ্ট বার্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে বিএনপি। রাজনৈতিক বিবেচনায় এটা কি সফল নাকি ব্যর্থ তা নেতাকর্মী ও সমর্থকদের কাছে পরিষ্কার নয়। সংলাপে এককভাবে বিএনপি'র কোনো এজেন্ডা নেই. দলটির সঙ্গে যুক্ত আছে ঐক্যফ্রন্টের এজেন্ডা। তাই খুব সাধারণভাবেই প্রশ্ন উঠছে তাহলে কি রাজনীতির মাঠে মাইনাস বিএনপি। আসলে তেমনটি নয় .কারণ তৃণমূল পর্যায়ে দলটির রয়েছে ব্যাপক জনসমর্থন ও ভোটার বিশ্লেষকদের মতে পরিস্থিতির শিকার হয়ে নতুন আঙ্গিকে আর নতুন ফরম্যাটে পরিচালিত হচ্ছে বিএনপি। ভবিষ্যতে দলটির গন্তব্য কোথায় হবে তা হয়তো স্পষ্ট হবে কিছুদিনের মধ্যেই. তবে তৃণমূল বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের কাছে বর্তমান পরিস্থিতি একেবারে অপছন্দের। গতানুগতিক রাজনীতির হিসাব মেলাতে না পেরে অস্বস্তির মধ্যে আছেন তারা। ভবিষ্যতে কি স্বস্তি মিলবে এটাই এখন বড় প্রশ্ন।