আওয়ামী লীগের রেকর্ড মনোনয়নপত্র বিক্রির নেপথ্যে চার কারণ
কাজী আফিফুজ্জামান সোহাগ: বরগুনা-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের টিকেট পেতে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন ৫২ জন। এক আসন থেকে সর্বোচ্চ মনোনয়ন ফরম কেনার রেকর্ড এটা। অন্যদিকে ৩ লাখ ২৬ হাজার ২শ ৮১ জন ভোটার নিয়ে নারায়নঞ্জ-১ আসন। আগামী সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের টিকেট পেতে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন ৩২জন। দশম জাতীয় সংসদে এ আসনের এমপি গোলাম দস্তগীর গাজী। অন্যদিকে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৩৪৬ জন ভোটারের আসন বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট জেলা মেহেরপুর-১। মাত্র দুটি থানা নিয়ে এ আসন। বর্তমানে এখানকার এমপি ফরহাদ হোসেন। আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করতে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন কিনেছেন ১১ জন। এ চিত্র শুধু তিনটি আসনের নয়। প্রায় ৩শ আসনের একই চিত্র এটা।
বেশিরভাগ আসনে আওয়ামী লীগের পক্ষে ৮ থেকে ১০ জন করে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। গত কয়েক দিনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন প্রায় চার হাজার ২৩ জন। কাকে রেখে কাকে মনোনয়ন দেয়া হবে তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। আবার মনোনয়ন পরবর্তী পরিস্থিতি কি হতে পারে সে চিন্তাই ও রয়েছে দলটি। দলের শীর্ষ কয়েক নেতা জানান, বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। এত মনোনয়ন কেনা হবে তা প্রত্যাশিত ছিলো না। এতে বোঝা যাচ্ছে দলীয় কোন্দল রয়েছে। তবে প্রত্যাশার কথা দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা যার হাতে নৌকার টিকেট তুলে দেবেন তাকে সবাই সমর্থন দেবেন। অন্যথায় দলীয়ভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এরইমধ্যে এ নিয়ে বেশ কয়েকবার হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তারা জানান, আশা করি দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে কেউ যাবেন না। যারা যাবেন তারা রাজনৈতিকভাবে মস্তবড় ভূল করবেন। এদিকে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকটি আসনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে বেশি মনোনয়ন ফরম কেনার চারটি কারণ জানা যায়। ওইসব নেতারা জানান,প্রথমত-মূল কয়েক নেতা ছাড়া বেশিরভাগ মনোনয়ন ফরম কিনেছেন ডামি হিসেবে। তারা মনোনয়ন বোর্ডের সামনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের সমর্থন দিতে ফরম কিনেছেন। দ্বিতীয়ত-ভবিষ্যতে মনোনয়ন চাওয়ার পথ তৈরি করতে অনেকে এবার মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। তৃতীয়ত-আবারও দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসলে নানা ধরণের সুযোগ-সুবিধা পেতে কেউ কেউ তৎপর হয়েছেন। চতুর্থত-মনোনয়ন বোর্ডে প্রদানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ নিতেও অনেকে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। এসব প্রসঙ্গে দলের সভাপতিমন্ডলির সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন,এটা দলের ভেতরকার গণতান্ত্রিক চর্চা বলে মনে করি। দীর্ঘদিন দল ক্ষমতায় থাকার কারণে আমাদের নেতা-কর্মীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। কিন্তু অনেকে এটাকে দলীয় কোন্দল বলে মনে করছেন-এমণ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা পুরোপুরি ঠিক নয়। তবে অনেক হয়তো ডামি হিসেবে মনোননয়ন ফরম কিনেছেন। আমাদের কাছে এ নিয়ে খুব বেশি তথ্য নেই। আর যারা ৩০ হাজার টাকা খরচ করে দলীয় সভাপতির সঙ্গে কথা বলার জন্য ফরম কিনেছেন তারা তো আসলে সময় পাবেন না। মনোনয়ন বোর্ডের সামনে ৫ মিনিটের বেশি কোন আসনের নেতারা সময় পাবেন না। কারণ এত বেশি মনোননয়ন প্রত্যাশী যে তাদের সবার সঙ্গে কথা বলতে গেলে কয়েক দিন লেগে যাবে। মনোনয়ন নিয়ে কিছুটা চাপ তো রয়েছেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নেয়া হবে আগামীকাল থেকে। ধানমন্ডিতে সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে এই সাক্ষাৎকার পর্বে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলের দফতর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ জানান,বুধবার সকাল ১১টা থেকে এই সাক্ষাৎকার পর্ব শুরু হবে। এ প্রসঙ্গে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, সোমবার মনোনয়ন ফরম বিক্রি এবং জমা দেয়ার শেষ দিন। নির্বাচন কমিশন সময় বাড়ালেও আমাদের সময় আর বাড়বে না। বুধবার থেকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নেয়া হবে। সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে সভানেত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত থাকবেন। তিনি মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সরাসরি ইন্টারভিউ করবেন। এদিকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরমে প্রার্থীর বিবরণীর একটি ঘরে ‘২০০৭ সালের ১ জানুয়ারি পরবর্তী সময়ের ভূমিকা’ লিখতে বলা হয়েছে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের।
নেতাকর্মীরা মনে করছেন, জরুরি অবস্থার মধ্যে দলের দুঃসময়েও যারা সক্রিয় ছিলেন,তাদের মূল্যায়নের জন্যই ফরমে ওই ঘর রাখা হয়েছে এবার। তারা জানান, সর্বশেষ ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরমে এ ধরনের কোনো ঘর ছিল না। আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক নেতা জানান, প্রত্যেক দলেরই কিছু কিছু বিশেষ সময় থাকে, দুর্দিন থাকে। তেমনি আওয়ামী লীগেরও দুর্দিন বা বিশেষ মুহূর্ত ছিল ১/১১। ওই সময় যারা দল থেকে দূরে ছিল তাদের মনোনয়ন পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ১/১১ তে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করার জন্য এই অংশটুকু যুক্ত করা হয়েছে। এদিকে দলীয় নেতাদের বাইরেও শরীকদের নিয়ে মনোনয়ন চাপে রয়েছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগসহ ১১টি দল নৌকা প্রতীকে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট করতে চায়। নৌকা প্রতীকে যেসব দল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট করবে, নির্বাচন কমিশনে (ইসি) সেই তালিকা রোববার জমা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দিন আহমেদের কাছে ওই তালিকা জমা দেন। নির্বাচন কমিশনে দেয়া ওই চিঠিতে যেসব দলের নাম রয়েছে বলে জানা গেছে সেই দলগুলো হলো, আওয়ামী লীগ,বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, গণতন্ত্রী পার্টি, সাম্যবাদী দল, জাতীয় পার্টি (জেপি) (মঞ্জু), কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণআজাদী লীগ, ন্যাপ (মোজাফফর), গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি ও বাসদ (রেজা)।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের একাধিক দল এরইমধ্যে নির্বাচন কমিশনে আলাদা চিঠি দিয়ে নৌকা ও তাদের দলীয় প্রতীকে ভোট করতে কমিশনকে চিঠি দিয়েছে। নিবন্ধনহীন বাংলাদেশ জাসদও নৌকা প্রতীকে ভোট করতে চেয়ে এ ধরনের একটি চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশনে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এখন শুধু অপেক্ষার পালা কারা পাচ্ছেন দলের নৌকা। ইতোমধ্যে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ গত নির্বাচনে ভোটের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো এরইমধ্যে নির্বাচনের অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে। তাই ভোটের মাঠের চ্যালেঞ্জ জয়ের সমীকরণে কারা হচ্ছেন আওয়ামী লীগের নৌকার মাঝি, তা নিশ্চিতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েকদিন।