নৌকা-ধানের শীষে লড়াই
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা ও ধানের শীষের মধ্যেই মূল লড়াই হবে। নির্বাচন কমিশনে (ইসি) রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর দাখিল করা চিঠি থেকে এ ধারণা পাওয়া গেছে। এ নির্বাচন সামনে রেখে হাতেগোনা কয়েকটি বাদে বেশির ভাগ দল জোটবদ্ধ হয়েছে। বিভিন্ন জোট ও দল প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে বেঁধেছে গাঁটছড়া।
জোটভুক্ত দলগুলো নিজেদের বিজয় নিশ্চিত করতে জনপ্রিয় দুই প্রতীক নৌকা ও ধানের শীষ নিয়ে মাঠে নামতে যাচ্ছে। এর আগে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দেশবাসী এ দুই প্রতীকের লড়াই উপভোগ করেছে। সেই হিসাবে দশ বছর পর সংসদ নির্বাচনে আবার দুই প্রতীক নামছে ভোটের লড়াইয়ে। তবে জাতীয় পার্টি নিজস্ব প্রতীক লাঙ্গল নিয়েই মাঠে থাকছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত দুটি ধারায় বিভক্ত। একটি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে, আরেকটি আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তি। এ দুই ধারার বাইরে আর কারও অস্তিত্ব নেই, তা বড় দুই দলের শিবিরে বাকিদের একত্রিত হওয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। পাশাপাশি নিজস্ব প্রতীক বাদ দিয়ে নৌকা এবং ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ার মাধ্যমে বাকি দলগুলোর যে পায়ের তলায় মাটি নেই, সেটিও প্রমাণ করে।
এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আরও বলেন, জনপ্রিয় দুই প্রতীকে অন্য দলগুলোর নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাওয়ার কারণ মোটা দাগে দুটি। তা হল- নির্বাচনে জয় নিশ্চিত এবং ভোটারের বিভ্রান্তি দূর করা। কেননা জনগণ এখন জোটবদ্ধ রাজনীতি দেখছে। ভোটের সময়ে উদীয়মান সূর্য, হাতুড়ি বা অন্য প্রতীক দেখলে বিভ্রান্ত হতে পারে।
নির্বাচনী মাঠে বেশ কয়েকটি জোট সক্রিয়। এগুলো হচ্ছে- আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল, জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত জাতীয় জোট, যুক্তফ্রন্ট, বিএনপির সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোট। এছাড়া সিপিবিসহ বাম ঘরানার দল নিয়ে গঠিত গণতান্ত্রিক বাম জোট।
ইসিতে দল ও জোটগুলোর দাখিল করা সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ১৪ দল ও যুক্তফ্রন্টের কেউ কেউ নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করবেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং ২০ দলীয় জোটের অধিকাংশ দলের প্রতীক হবে ধানের শীষ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেই হিসাবে এবার মূলত নির্বাচন হচ্ছে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টসহ বিএনপি জোটের। মহাজোট হয়ে জাতীয় পার্টি লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নামলেও নৌকার সঙ্গেই ফল যোগ হবে। বৃহস্পতিবার একই প্রতীকে জোটগত নির্বাচনের ব্যাপারে ইসিতে তথ্য জানানোর শেষ দিন ছিল।
দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে ভোটের লড়াইয়ে নামার বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখছেন না নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও সুশাসনে জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।
তিনি বলেন, একসময়ে ঘোর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আজ একই শিবিরে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এখন তারা অভিন্ন প্রতীকে নির্বাচনও করতে যাচ্ছেন। এটা রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ। কিন্তু এখানে যে নীতি-আদর্শের কোনো বালাই নেই, সেটাই প্রমাণিত হচ্ছে। পাশাপাশি রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই, সেই আপ্তবাক্যও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে। নিজস্ব প্রতীক থাকতে অন্য দলের প্রতীকে নির্বাচনের এই দৃষ্টান্ত নৈতিক রাজনীতির জন্য সহায়ক নয়। এটা ক্ষমতার রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, ক্ষমতাসীনদের জোট থেকে ১৬টি দল নির্বাচনে অংশ নেবে। তবে এর মধ্যে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা আটটি। আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সই করা চিঠিতে উল্লিখিত ১৬টি দলের মধ্যে নিবন্ধিত আটটি হল- আওয়ামী লীগ, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল, গণতন্ত্রী পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ, তরিকত ফেডারেশন ও জাতীয় পার্টি-জেপি।
অনিবন্ধিত দলগুলো হল- গণ আজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক মজদুর লীগ, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল, ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ জাসদ, কৃষক শ্রমিক পার্টি ও তৃণমূল বিএনপি।
ইসিকে আলাদা চিঠি দিয়েছে বিকল্পধারার নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট। তারা জানিয়েছে, তাদের প্রার্থীরা ‘কুলা’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবেন। তবে মহাজোটে গেলে কিছু আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়েও লড়বেন প্রার্থীরা। বিষয়টি বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আলোচনার পর্যায়ে আছে বলে উল্লেখ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, জোটগত নির্বাচনের ব্যাপারে তথ্য আমাদের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে জানানো হয়েছে। ১৪ দলের শরিকরা নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করার বিষয়ে একমত। বাকিদের ব্যাপারে দু’এক দিনের মধ্যেই সিদ্ধান্ত হবে।
সরকারবিরোধী জোটভুক্ত বিভিন্ন দল ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেবে। বৃহস্পতিবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনে নামার ঘোষণা দিয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে এ ব্যাপারে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপি জোটের নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষ। এই প্রতীকে আমরা নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
এ দিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সই করা চিঠিতে ইসিকে জানানো হয়েছে, জোটে নিবন্ধিত ১১টি দল অংশ নেবে। দলগুলো হচ্ছে- বিএনপি, এলডিপি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), খেলাফত মজলিশ, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, গণফোরাম, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ।
এছাড়া জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অপর রাজনৈতিক দল নাগরিক ঐক্যও ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে এ জোট থেকে নির্বাচন করবে। দলটির আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বৃহস্পতিবার এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ কথা জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, জোটগতভাবে নির্বাচন করার বিষয়ে তথ্য দেয়ার শেষ দিনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট জোটবদ্ধ নির্বাচন করবে বলে জানিয়েছে। আওয়ামী লীগও ইতিপূর্বে জোটভুক্ত দলের কথা জানিয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোও আলাদাভাবে এ ব্যাপারে ইসিকে তথ্য দিয়েছে। যারা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জানায়নি, তারা নিজ নিজ প্রতীকে নির্বাচন করবে।
প্রসঙ্গত, জাতীয় সংসদে মোট ৩০০টি নির্বাচনী আসন আছে। এসব আসনের মধ্যে এবার সরকারি জোটে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা শরিক দলগুলোর মধ্যে ৬৫ থেকে ৭০টি আসন ভাগাভাগি হতে পারে। বৃহস্পতিবার এমন আভাস দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তবে এটা কমতেও পারে, আবার বাড়তেও পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রতিপক্ষ যদি বড় ধরনের জোটে যায়, তাহলে তো স্বাভাবিক কারণে আমরাও যাব। অনেকেই আমাদের সঙ্গে জোট করতে চায়। আজ ৩৯ দলীয় একটি জোট এসেছিল, যারা নির্বাচনে আমাদের সঙ্গে কাজ করতে চায়। তিনি আরও বলেন, যুক্তফ্রন্ট আমাদের জোটে আসবে। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
আসন বণ্টন বিএনপির সামনে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, শরিক দলগুলোর এখন পর্যন্ত শতাধিক আসনের চাহিদা আছে। তবে বিএনপি শরিকদের জন্য সর্বোচ্চ ৭০-৮০টিতে ছাড় দিতে পারে বলে সূত্রগুলো জানায়। এক্ষেত্রে জয়ী হওয়ার মতো প্রার্থীকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার নীতি আছে বিএনপির। এ ধরনের প্রার্থীকে ছাড় দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো আপত্তি করবে না তারা।
এদিকে ২০ দলীয় জোটের বড় একটি শরিক জামায়াতে ইসলামী। এ দলটির নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নেই। তবু দলের নেতারা কমপক্ষে ৩৫টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এক্ষেত্রে তারা ধানের শীষ প্রতীকের বদলে স্বতন্ত্র হিসেবে মাঠে নামছেন বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এ নির্বাচনকে আমরা একটি আন্দোলনের অংশ হিসেবে নিয়েছি। দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং সুশাসন কায়েম আমাদের প্রধান লক্ষ্য। এখানে কোন দল কোন প্রতীকে নির্বাচন করছে, সেটি বড় নয়। ক্ষমতার বাইরে থাকা সব জোট আজকে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে- এটাই বড় কথা।
তিনি বলেন, জোটগতভাবে নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়টি আমরা নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করেছি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক সব দল ধানের শীষে নির্বাচন করার বিষয়ে জানিয়েছে। ২০ দলীয় জোটের শরিকরাও এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪৯ শতাংশ ভোট পেয়ে ২৩০টি আসনে জয়লাভ করে। বিএনপি ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পেলেও আসন পায় মাত্র ৩০টি। জাতীয় পার্টি ৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। তবে আসন পেয়েছিল ২৭টি। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিসহ গঠিত মহাজোট অংশ নেয়।
অপরদিকে বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত চারদলীয় জোট অংশ নেয়। জোটগতভাবে অংশ নিলেও ওই নির্বাচনে জোটের অভিন্ন প্রতীক ছিল না। বিশেষ করে জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামী নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করেছিল। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিজস্ব প্রতীকে অংশ নেয়।
এর আগে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৪১ দশমিক ৪০ শতাংশ ভোট পায়। সেবার দলটি ১৯৩ আসনে জয়লাভ করে। ওই বছর ৬২ আসনে জয়লাভ করলেও আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছিল ৪০ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। জাতীয় পার্টি ভোট পেয়েছিল ৭ দশমিক ২২ শতাংশ। আসন পেয়েছিল ১৪টি। কিন্তু জাতীয় পার্টির চেয়ে কম ভোট পেয়েও জামায়াতে ইসলামী ১৭ আসনে জয়লাভ করে। দলটি পেয়েছিল ৪ দশমিক ২৮ শতাংশ ভোট। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে অংশ নিয়েছিল। তবে বিএনপি চারদলীয় জোটের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশ নেয়।