শ্রেষ্ঠ সন্তানদের তালিকা চূড়ান্ত হয়নি ৪৭ বছরেও
স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও চূড়ান্ত হয়নি জাতির শ্র্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা। এ পর্যন্ত সরকারিভাবে তৈরি হয়েছে পাঁচটি তালিকা। ষষ্ঠ তালিকা তৈরির কাজ স্থগিত হয়ে আছে এক বছর। শতাধিক উপজেলায় যাচাই-বাছাই কমিটির ওপর আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় প্রণয়ন করা যাচ্ছে না ওই তালিকা।
‘নির্ভুলভাবে তালিকা হয়নি’- এমন অজুহাতে সরকার পরিবর্তনের পরপরই নতুন করে তালিকা প্রণয়নের কাজে হাত দেয় ক্ষমতাসীনরা। তাদের পছন্দের নাম যোগ, আর অপছন্দের নাম বাদ দিয়ে বারবারই দীর্ঘ করা হয়েছে তালিকার আকার। নির্ভুল করতেই নতুন করে তালিকা তৈরি হচ্ছে- মন্তব্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, মূলত রাজনৈতিক কারণেই মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা চূড়ান্ত করা যাচ্ছে না। সরকার বদলের সঙ্গে তালিকার পরিবর্তনও হওয়াটা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। আর এ কারণেই দিন দিন বাড়ছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাও। ৪৭ বছরে ছয়বার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার বয়স, সংজ্ঞা ও মানদণ্ড ১১ বার পাল্টেছে। সর্বশেষ চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার বয়স ছয় মাস কমিয়ে সাড়ে ১২ বছর করা হয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সবার প্রশ্ন- তালিকা চূড়ান্ত করতে আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, সব সরকারই নিজেদের পছন্দসই ব্যক্তিদের মুক্তিযোদ্ধার সনদ দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়েছে। মুক্তিযোদ্ধার ছেলে-নাতিরাও সরকারি চাকরিসহ বিভিন্ন সুযোগ পাচ্ছেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে অনেকে নানা মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার চেষ্টা করছে। শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা চালু রেখে ছেলে-নাতিদের সুবিধা দেয়া বন্ধ করে দিলে এ প্রবণতা কমবে। এটা সরকারকে ভেবে দেখতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এখন রাজনীতি তুঙ্গে। এ কারণে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার বয়স সাড়ে ১২ বছর করা হয়েছে। এ বয়সের বাচ্চারা নাকি মুক্তিযুদ্ধ করেছে। যাচাই-বাছাই কমিটি টাকা ছাড়া কাউকে সুপারিশ করে না। সেক্টর কমান্ডার হয়েও আমার এলাকার দু’জনকে সুপারিশ করেছিলাম। তা গ্রহণ করা হয়নি, এজন্য মন্ত্রী পর্যন্ত যেতে হয়েছে। এটাই আসল চিত্র। তারপরও বলব, রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা হওয়া উচিত।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, যখনই নতুন তালিকা করা হয়েছে, তখনই মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়েছে। আর আগের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নাম। সর্বশেষ ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ঢাকঢোল পিটিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই শুরু করে সরকার। মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পেতে নতুন করে ১ লাখ ৩৪ হাজার ব্যক্তি আবেদন করেন। এসব আবেদন যাচাই-বাছাই করতে উপজেলায় ৪৮৭টি ও মহানগরে ৮টি কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে ১১০টি কমিটি আইনি জটিলতায় এখনও প্রতিবেদন দিতে পারেনি। বাকি কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেলেও তাতে রয়েছে প্রচুর অসঙ্গতি ও ভুল-ত্র“টি। এসব অসঙ্গতি দূর করতে গঠন করা হয়েছে আবার নতুন কমিটি। পাশাপাশি ১১০ উপজেলায় নতুন করে ৭ সদস্যের যাচাই-বাছাই কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন থেকে শুরু করে পুরো প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় শেষ পর্যন্ত নতুন তালিকা প্রকাশ স্থগিত করতে বাধ্য হয় সরকার। অথচ এই কাজের জন্য এরই মধ্যে ১০ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে।
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা কবে নাগাদ শেষ হবে তা সুস্পষ্টভাবে জানাতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) চেয়ারম্যান আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, আদালতে রিটের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শুরু করা যাবে না।
পাঁচটি তালিকার পরও কেন নতুন তালিকা? জবাবে মন্ত্রী বলেন, ওইসব তালিকায় অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে বলে আপনারাই পত্রপত্রিকায় লেখেন। ভুয়াদের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ যে, নতুন তালিকা না করে উপায় নেই।
এক প্রশ্নে মোজাম্মেল হক বলেন, বর্তমানে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকার মধ্যে রয়েছে- মুক্তিবার্তা লাল বইয়ে ১ লাখ ৫৪ হাজার, বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলে ৪৪ হাজার ও মহাজোট সরকারের সময় ১১ হাজার। এর মধ্যে প্রায় ৬০ হাজারের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। যাচাই-বাছাই কমিটি মূলত জোট সরকারের আমলের ৪৪ হাজার, অভিযোগ ওঠা ৬০ হাজার এবং নতুন এক লাখ ৩৪ হাজার আবেদনের ওপর কাজ শুরু করে। লাল বইয়ের তালিকায় থাকা কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে তা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবে এই কমিটি।
মুক্তিযুদ্ধের পর সেক্টর কমান্ডার ও সাবসেক্টর কমান্ডারদের বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ৮০০ এবং অনিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১০ হাজার। মোট ১ লাখ ৩৪ হাজার ৮০০ জন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টর বিলুপ্তির পর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রশিক্ষণ ও রেকর্ড সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠান ইবিআরসিতে স্থানান্তরিত দলিলে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৭০ হাজার ৮৯৬ জন। এটিই মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে সংরক্ষিত রয়েছে, যা ভারতীয় তালিকা নামে পরিচিত।
১৯৭৮ সালের পর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরির কাজে হাত দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে এ দায়িত্ব দেন তিনি। ১৯৮৬ সালে এরশাদের শাসনামলে তা জাতীয় তালিকা নামে প্রকাশ (গেজেট হয়নি) করা হয়। এতে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৮।
১৯৯৪ সালে বিএনপির শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদেও ভোটারসূচক তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হন ৮৬ হাজার। আওয়ামী লীগের আমলে (১৯৯৬-২০০১) মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত হয় এক লাখ ৮২ হাজার নাম। সেখান থেকে ১৯৯৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন ডিজি মমিনউল্লাহ পাটোয়ারীর নেতৃত্বে জেলা ও উপজেলা কমান্ডারদের নেতৃত্বে গঠিত যাচাই-বাছাই কমিটির মাধ্যমে তৈরি করা তালিকাটি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলে সংরক্ষণ করা হয়। এটিই এখন ‘লালবই’ নামে পরিচিত। এতে ১ লাখ ৫৪ হাজার নাম রয়েছে।
২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ২০০৩ ও ২০০৪ সালে দুটি গেজেট প্রকাশ করা হয়। এর একটি বিশেষ গেজেট- যেখানে সামরিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৩৯ হাজার। অন্য গেজেটে মুক্তিযোদ্ধা ১ লাখ ৫৯ হাজার। দুটি মিলে তখন মুক্তিযোদ্ধা দাঁড়ায় ১ লাখ ৯৮ হাজার জনে। অর্থাৎ সংখ্যা বাড়ে ৪৪ হাজার, যা ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভুয়া বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। অবশ্য মহাজোট সরকারও ক্ষমতায় এসে ৩৩ হাজার ৩৮৫ জনকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেয়। ফলে বর্তমানে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৩১ হাজার ৩৮৫ জনে। এর মধ্যে বিভিন্ন বাহিনীর গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৫০ হাজার ৮৭২ জন এবং বেসামরিক এক লাখ ৮০ হাজার ৫১৩ জন।