বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন: শেখ হাসিনা ম্যাজিকে উড়ে গেল বিরোধী জোট
বিশেষ প্রতিনিধি: বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে অবিশ্বাস্য জয় পেয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের এটা হ্যাটট্রিক জয়। জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নিলেও শরিকদের ছাড়াই তারা দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। ফলে টানা তৃতীয়বারের মতো শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে দেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী ঐতিহ্যবাহী এই দলটি। নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলটি এককভাবে পেয়েছে ২৬৬ টি আসন। বিরোধী জোট পেয়েছে মাত্র ৮টি আসন। নির্বাচনে এই অভাবনীয় ফলাফলের জন্য শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা কে প্রশংসা করেছে বিশ্ব মিডিয়া। মূলত “হাসিনা ম্যাজিকেই” উড়ে গেল বিরোধী জোটের সকল রাজনৈতিক ও নির্বাচনী কৌশল। রেকর্ড গড়ে টানা তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন তিনি।
আওয়ামী লীগের প্রধান বিরোধী শক্তি বিএনপি নেতৃত্বাধীন নির্বাচনী জোট ”জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট” ভোটে কারচুপির অভিযোগ তুলে ফল প্রত্যাখ্যান করে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। ঐক্যফ্রন্টসহ বিভিন্ন দলের ৯৬ প্রার্থী ভোট গ্রহণ শেষের আগেই তা বর্জনের ঘোষণা দেন।
এদিন ২৯৯টি সংসদীয় আসনে ভোট গ্রহণ করে নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে একটির ফল স্থগিত করে ২৯৮টি আসনের ফল ঘোষণা করা হয়। ইসি সচিব জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে ভোটের ফল স্থগিত করা হয়েছে। এ আসনের তিনটি কেন্দ্রে পুনরায় ভোট হবে।
রোববার ভোট গ্রহণের পর বিকেলে ফল ঘোষণা শুরু করে ইসি। রাত গড়িয়ে তা সোমবার ভোর পর্যন্ত পৌঁছায়। ভোর সাড়ে চারটায় ইসির সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২৬৬ আসন। এছাড়া, বিএনপি ৫, গণফোরাম ২, লাঙ্গল প্রতীকে জাপা ২২, ওয়ার্কার্স পার্টি ৩, জাসদ ২, স্বতন্ত্র ৩, তরিকত ফেডারেশন ১, বিকল্পধারা ২ ও জেপি (মঞ্জু) ১টি আসন পেয়েছে বলে জানায় ইসি।
গোপালগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই লাখ ২৯ হাজার ৫৩৯ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির এস এম জিলানী পেয়েছেন মাত্র ১২৩ ভোট।
বিএনপির জয়ীরা হলেন-বগুড়া-৬ আসনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে জাহিদুর রহমান, বগুড়া-৪ আসনে মোশাররফ হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে আমিনুল ইসলাম ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনে হারুনুর রশিদ। সিলেট-২ আসনে গণফোরামের মোকাব্বির খান ও মৌলভীবাজার-২ আসনে একই দলের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর জয়ী হয়েছেন।
বিএনপিকে ছাপিয়ে সংসদে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। এবার দলটি ২২ আসন পাওয়ায় আগামীতে সংসদের প্রধান বিরোধীদল হতে যাচ্ছে।
এবারের নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৭৭ জন। অসমর্থিত সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনে সাত কোটি ৯৯ লাখ ১৮ হাজার ৮১৮ জন ভোট দিয়েছেন। এ হিসাবে ৭৬ শতাংশেরও বেশি ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। আওয়ামী লীগ পেয়েছে ৭৭ দশমিক ১২ শতাংশ ভোট। বিএনপি পেয়েছে ১২ দশমিক ২৮ ভোট। জাতীয় পার্টি পেয়েছে ৫ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ ভোট। ভোটপ্রাপ্তিতেও রেকর্ড করেছে আওয়ামী লীগ। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে ৭৩ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পেয়ে ২৯৩ আসন পেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন দলটি।
সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সারাদেশের ২৯৯টি সংসদীয় আসনে ৪০ হাজারের বেশি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ হয়।
তবে রাজধানীর অনেক ভোটকেন্দ্রেই ভোটারের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। আবার অনেক স্থানে ভোটকেন্দ্র ছিল ফাঁকা। কেন্দ্রের সামনে ও ভেতরে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের সরব উপস্থিতি থাকলেও দেখা মেলেনি বিএনপির কর্মীদের। তবে পরিস্থিতি ছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। নিয়োজিত ছিল সেনাবাহিনীও।
ঢাকার বাইরে বেশ কয়েকটি আসনের ভোটকেন্দ্রে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। দীর্ঘ ১০ বছর পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা-ধানের শীষের সরাসরি ভোটযুদ্ধ নিয়ে মানুষের মধ্যে ছিল ব্যাপক কৌতূহল। ভোটের আগের রাত থেকে মোবাইল ফোনে থ্রিজি ও ফোরজি সেবা বন্ধ থাকলেও সন্ধ্যার পর তা চালু হয়। তবে রাতে আবার বন্ধ হয়ে যায়। রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নির্বাচন নিয়ে নানা প্রতিক্রিয়া জানায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
নির্বাচনী আইন অনুযায়ী ভোটের দিন মিছিল নিষিদ্ধ থাকলেও সন্ধ্যার পর রাজধানীসহ দেশের অনেক স্থানে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকরা আনন্দ মিছিল করেন। ছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থান।
এর আগে দেশ-বিদেশের গণমাধ্যম ও বেসরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের বিজয়ের ধারণা করা হয়। আওয়ামী লীগের নিজস্ব জরিপে ১৬৮ থেকে ২২২ এবং বেসরকারি সংস্থা আরডিএসের জরিপে আওয়ামী লীগ ২৪৯ আসন পাবে বলে আভাস দেওয়া হয়।
এদিকে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে নির্বাচন বাতিলের জন্য নির্বাচন কমিশনে দাবি জানানো হয়েছে। জোটের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন বলেছেন, দেশের প্রায় সব আসন থেকেই প্রার্থীরা তাদের কাছে ভোট ডাকাতির খবর দিয়েছেন। এই ফল প্রত্যাখ্যান করে তিনি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ নির্বাচন পুরোপুরি প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দিয়ে বলেন, নির্বাচনের নামে গণতন্ত্রের সঙ্গে নিষ্ঠুর প্রহসন করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যে ইসলামী দেশগুলোর সংগঠন ওআইসি, ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ ও সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে মন্তব্য করা হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যরা এখনও মন্তব্য করেনি।
ভোট শুরু হওয়ার পর সকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা ঢাকার উত্তরায় নিজের ভোট দেওয়ার পর সাংবাদিকদের কাছে বলেন, দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সারাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হচ্ছে। তবে সারাদেশে নির্বাচনী সহিংসতায় ১৬ জন নিহত ও প্রায় ৩০০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে পুলিশের গুলিতে দু'জন নিহত হয়েছেন।
এর আগে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম ও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ জয়লাভ করে। নবম সংসদের ভোটে শতকরা ৮৭ দশমিক ১৩ ভাগ ভোট পড়ে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসনে জয়লাভ করে। দশম সংসদের ভোটে শতকরা ৪০ দশমিক শূন্য ৪ ভাগ ভোট পড়ে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩৪টি আসনে জয়লাভ করে। যদিও বিরোধী দল বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দলের বর্জনের ফলে ওই নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেন মহাজোটের প্রার্থীরা।
নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত ৩৯টি দলই এবারের নির্বাচনে অংশ নেয়। দল ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে প্রার্থীসংখ্যা ছিল এক হাজার ৮৬১।