এনওসি ছাড়াই কেনা হয় ভারতীয় ভিটামিন এ ক্যাপসুল
ভিটামিন এ ক্যাপসুল ক্যাম্পেইন আমাদের দেশে একটি উৎসবে পরিণত হয়েছে। আজ শনিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত সারা দেশে শিশুদের ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানোর কথা ছিল। কিন্তু ক্যাপসুলগুলো মানসম্পন্ন না হওয়ায় পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে।
আমদানি করা ক্যাপসুলগুলো মানসম্পন্ন না হওয়ায় ক্রয় প্রক্রিয়ার সময়ই এর এনওসি (নো অবজেকশন সার্টিফিকেট) দেয়নি ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। কিন্তু পরবর্তীতে ঔষধ প্রশাসনের এনওসি ছাড়াই এসব মানহীন ওষুধ কেনা হয়।
এদিকে পরবর্তী ক্যাম্পেইনের ক্যাপসুল দিয়ে এ মাসেই ক্যাম্পেইন করে শিশুদের ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানোর প্রস্তুতি নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
শুক্রবার দুপুরে কিশোরগঞ্জ সার্কিট হাউসে ‘ভিটামিন এ প্লাস ক্যাপসুলের’ নমুনা পর্যবেক্ষণে যান স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. মুরাদ হাসান। এ সময় তিনি বলেন, মামলা করে ভারতীয় একটি অখ্যাত কোম্পানির কাছ থেকে নিম্নমানের ‘ভিটামিন এ প্লাস ক্যাপসুল’ কিনতে বাধ্য করা হয়েছে। ক্যাপসুলের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইন আপাতত স্থগিত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, মামলা করে নিম্নমানের লাল ক্যাপসুল কিনতে বাধ্য করা হয়েছে। ভারতীয় ওই কোম্পানির কোনো সুনাম নেই। সরবরাহ করা এসব ক্যাপসুল কৌটার সঙ্গে লেগে আছে। আলাদা করা যাচ্ছে না। কেন এ রকম হল পরীক্ষার পর তা বলা যাবে। নমুনা ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে দেশের কোম্পানি থেকে কেনা সবুজ রঙের ট্যাবলেটে কোনো সমস্যা নেই। ‘ভিটামিন এ ক্যাপসুলে’ শিশুদের যেন কোনো প্রকার সমস্যা না হয়- সেজন্য আপাতত এ কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে। তবে শিগগিরই এটা আবার শুরু করা হবে।
জানা গেছে, এ ক্যাপসুল কেনার কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে। প্রথমে একটি দেশি ওষুধ কোম্পানি সরবরাহের কার্যাদেশ পেয়েছিল। কিন্তু ওই কার্যাদেশের বিরুদ্ধে আদালতে যায় অ্যাজটেক নামে ভারতীয় একটি কোম্পানি। ওই ভারতীয় কোম্পানিকে সরবরাহের কাজ দেয়ার নির্দেশ দেন আদালত। এরপর থেকে লাল রঙের এ ক্যাপসুল সরবরাহ করে আসছে কোম্পানিটি।
শনিবারের ক্যাম্পেইনের জন্য সারাদেশে ক্যাপসুল পাঠানো হলে মাঠ পর্যায়ে এগুলোতে সমস্যা ধরা পড়ে। ইতিমধ্যে বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এনায়েত হোসেনের নেতৃত্বে ৭ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ৭ কর্মদিবসের মধ্যে তারা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক কর্মকতা বলেন, এ ভিটামিন এ ক্যাপসুলগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অর্থায়নে ক্রয় করা হয় ২০১৬ সালে। তাদের শর্ত অনুযায়ী আন্তর্জাতিকভাবে ওষুধ ক্রয়ের দরপত্র আহ্বান করা হয়। সেখানে ভারতীয় একটি অপরিচিত প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কার্যাদেশ পায়। পুরো বিষয়টির সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দু’জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সম্পৃক্ত ছিলেন। ভারতীয় এই কোম্পানির ওষুধের মান নিয়ে সে সময় দেশের কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের কোম্পানি আপত্তি জানায়। কিন্তু সেই আপত্তি আমলে নেয়া হয়নি।
এই কর্মকর্তা আরও জানান, আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী বিদেশি কোনো কোম্পানির ওষুধ কিনতে হলে অবশ্যই সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের এনওসি নিতে হবে। সেই অনুযায়ী ঔষধ প্রশাসনকে এনওসি দিতে বলা হয়। কিন্তু ওষুধের মান যাচাই করে ঔষধ প্রশাসন এনওসি প্রদান থেকে বিরত থাকে। এনওসি না পাওয়ায় ভারতীয় কোম্পানির ওষুধ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরেজ ডিপার্টমেন্ট (সিএমএসডি)।
এ পর্যায়ে ভারতীয় কোম্পানি আদালতের শরণাপন্ন হলে আদালত তাদের পক্ষে রায় দেন। এ সময় তারা জানায়, তাদের ওষুধের মেয়াদ ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত রয়েছে। তাই এই ওষুধ গ্রহণে কোনো বাধা থাকতে পারে না। আদালতের নির্দেশে ঔষধ প্রশাসনের এনওসি ছাড়াই পরবর্তীতে এই ওষুধ স্টোরেজ করে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
সম্প্রতি বছরের প্রথম প্রান্তিকের ক্যাম্পেইন ঘোষণা করা হয়ে স্টোরেজ থেকে ক্যাপসুল সারা দেশে পাঠানো হয়। ক্যাপসুল পেয়ে বেশরভাগ জায়গার মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা বাক্স খুলে দেখতে পায় এগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে জোড়া লেগে আছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, শুক্রবার তিনি নিজেও গাজীপুরের কয়েকটি কমিউনিটি ক্লিনিক পরিদর্শনে যায়। সেখানে তিনি দেখতে পান একটি কৌটার সব ক্যাপসুল জোড়া লেগে বলের মতো হয়ে আছে। তবে কোথাও কোথাও ওষুধ ভালো রয়েছে।
তিনি বলেন, এই ওষুধ ভালো থাকলেও দেশের কোথাও ব্যবহার করা হবে না। বছরের দ্বিতীয় ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইনের জন্য দেশি কোম্পানির কাছ থেকে আন্তর্জাতিক মানের ক্যাপসুল কেনা রয়েছে। ওইসব ক্যাপসুল মাঠ পর্যায়ে সরবরাহ করে এই মাসেই ক্যাম্পেইন করা হবে।
তিনি বলেন, ভারতীয় কোম্পানির ক্যাপসুল নিয়ে মাঠ পর্যায় থেকে অভিযোগ আসার পর বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালকের নেতৃত্বে ৭ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে তারা কাজ শুরু করেছে। আগামী ৭ কর্মদিবসের মধ্যে তারা তদন্ত রিপোর্ট প্রদান করবে। রিপোর্টের সুপারিশ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
প্রসঙ্গত, গত ডিসেম্বরে এই ক্যাপসুল খাওয়ানোর কথা থাকলেও বার্ষিক পরীক্ষা, জাতীয় নির্বাচনসহ নানা কারণে তা পিছিয়ে যায়। জাতীয় পুষ্টি কর্মসূচির আওতায় প্রতিবছর দু’বার ৬-১১ মাস বয়সী শিশুকে নীল এবং ১২-৫৯ মাস বয়সী শিশুকে লাল রঙের ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। মূলত রাতকানা রোগ প্রতিরোধের জন্য ১৯৯৪ সাল থেকে দেশের শিশুদের ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানো হচ্ছে।
আজ শনিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত সারা দেশে শিশুদের ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানোর কথা ছিল। স্থায়ী টিকা কেন্দ্র ছাড়াও বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট, ফেরিঘাট, ব্রিজের টোল প্লাজা, বিমানবন্দর, রেলস্টেশন, খেয়াঘাটসহ বিভিন্ন স্থানে ও ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্রে শিশুদের ‘ভিটামিন এ’ খাওয়ানোর কথা ছিল। জাতীয় পুষ্টি কর্মসূচির আওতায় প্রতি বছর দু’বার ৬-১১ মাস বয়সী শিশুকে নীল এবং ১২-৫৯ মাস বয়সী শিশুকে লাল রঙের ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়।
ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইন সরকারের একটি সফল কার্যক্রম। দেশব্যাপী এ কার্যক্রমের গ্রহণযোগ্যতাও ছিল ব্যাপক। কিন্তু এ বছর ক্যাপসুলের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অবশ্য ২০১২ সালে ভিটামিন এ ক্যাপসুল নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। তবে তা ছিল মূলত কার্যাদেশ দেয়া নিয়ে। আর এ বছর জটিলতা দেখা দেয় ক্যাপসুলের মান নিয়ে।
নামসর্বস্ব কোম্পানির কাছ থেকে নিম্নমানের ওষুধ কেনায় ব্যাহত হয়েছে জাতীয় ভিটামিন এ ক্যাপসুল ক্যাম্পেইন কার্যক্রম। তবে বড় কোনো দুর্ঘটনার আগে বিষয়টি নজরে আসায় এবং সরকারের এমন সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ ও অভিভাবকরা। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন না হতে অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।