বাংলাদেশে দুই এমপির শপথ নিয়ে রাজনৈতিক রহস্য
কাজী আফিফুজ্জামান সোহাগ: ঐক্যফ্রন্টের দুই এমপির শপথ নিয়ে বাংলাদেশে চলছে রাজনৈতিক রহস্য। চলছে পাল্টাপাল্টি কথোপকথন। মৌলভীবাজার-২ আসনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ। অন্যদিকে সিলেট-২ আসনে গণফোরামের নিজস্ব প্রতীক ‘উদীয়মান সূর্য’ নিয়ে জয়ী হন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত গণফোরামের প্রার্থী মোকাব্বির খান। ৭ই মার্চ তারা শপথ নিতে যাচ্ছেন। তাদের শপথ ইস্যুতে আসল ঘটনা কি তা জানতে উদগ্রীব সবাই। কিন্তু কোন পক্ষই মুখ খুলছেন না। ঐক্যফ্রন্টের মঞ্চের সিদ্ধান্ত শপথ নেয়া যাবে না। কেউ শপথ নিলে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু কি ধরণের শাস্তি দেয়া যেতে পারে তা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। সর্বোচ্চ তাদেরকে বহিস্কার করা যেতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো বহিস্কার করলেই কি এমপি পদ থেকে তাদের সরানো সম্ভব হবে? ফ্রন্টের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব ড. কামাল হোসেন বলছেন তাদের শপথ নিয়ে কোন ধরনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। অন্যদিকে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর বলছেন তিনি সবকিছু জানেন।
বিএনপির শীর্ষ কয়েক নেতা জানান, শপথ নেয়া তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। প্রথম দিকে বিএনপির শীর্ষ নেতারা এ নিয়ে সরব থাকলেও এখন অনেকটা চুপ। দলের প্রতীক নিয়ে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারা শপথ নিয়ে কোন ধরণের উচ্চবাচ্য করছেন না। রহস্যটা আসলে এখানেই। চাউর রয়েছে, ঐক্যফন্টের দুই এমপিকে শপথ পাঠ করানো অভ্যন্তরিন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে অনেকটা ধোঁয়াশা তৈরি করে। কারণ শপথ না নেয়ার পক্ষে বিএনপির প্রভাবশালী কয়েক নেতা রয়েছেন কট্টোর অবস্থানে। তাদের বেশিরভাগ নির্বাচনে অংশ নিয়ে করুণভাবে পরাজিত হয়েছেন। তাই এ সংসদ ও সরকারের প্রতি ওইসকল হেভিওয়েট নেতাদের রয়েছে আলাদা রকমের ক্ষোভ। মূলত তাদেরকে পাশ কাটিয়ে সংসদে যেতে ইচ্ছুক বিএনপির নির্বাচিত এমপিরা। এরই অংশ হিসেবে ঐক্যফ্রন্টের এমপিদের সামনের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। তাদের শপথের পর প্রতিক্রিয়া কি হয় তা টেস্ট করা হবে। এরপই আন্দোলনের অংশ হিসেবে ও সংসদে সরকারের কঠোর সমালোচনার অঙ্গীকার করে বিএনপির নির্বাচিতরা যোগ দেবেন সংসদে। সরকারী দলের পক্ষ থেকে তাদেরকে বারবার সংসদে যোগ দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এমনিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাদেরকে সংসদে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সংসদে না আসাটা তাদের রাজনৈতিক ভূল সিদ্ধান্ত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
যাই হোক শেষ পর্যন্ত ৭ই মার্চ তারা শপথ নিয়ে বসতে যাচ্ছে সংসদ অধিবেশন কক্ষে। একাদশ জাতীয় সংসদে নির্বাচিত ওই দুই সদস্যের লিখিত আগ্রহ অনুযায়ী ওইদিন বেলা ১১টায় সংসদ ভবনে স্পিকারের দপ্তরে শপথ অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য সংসদ সচিবালয়ের আইন শাখাকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। গত ৩০ জানুয়ারি একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। এর আগে গত ৩ জানুয়ারি নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেন। কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরুর ৯০ দিনের মধ্যে কেউ শপথ না নিলে তার আসন শূন্য হবে। বাকী ৬ জন নির্বাচিত সদস্য শপথ না নিলে আগামী ৩০ এপ্রিলের পর তাদের আসন শুন্য হবে। কিন্তু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গঠিত নির্বাচনী জোট ঐক্যফ্রন্টের কেউ কি এককভাবে এমপি হিসেবে শপথ নিতে পারবেন? গত কয়েক দিন ধরে এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে। এবারের নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্টে বিএনপি দলীয় ৬ জন ও গণফোরামের দুইজন এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্যে গণফোরামের একজন বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে জয়লাভ করেছেন। বিএনপি সংসদে না গেলে ধানের শীষে নির্বাচন করা গণফোরামের প্রার্থী সংসদে অংশ নিতে পারবেন কিনা-এ প্রশ্ন এখন সামনে এসেছে। এ বিষয়ে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া নিউইয়র্ক মেইলকে জানিয়েছেন, নির্বাচিত এমপি হিসেবে এককভাবে যে কেউ শপথ নিতে পারেন। এতে কোনো ধরনের বাধা নেই। আর নির্বাচিত হওয়ার পর কেউ যদি সংসদ সচিবালয়ে শপথ নিতে আসেন তাহলে তাকে ফিরিয়ে দেয়ার আইনগত কোনো এখতিয়ার নেই। শপথ নেয়ার পর সংসদেও যোগ দিতে পারবেন। এ প্রসঙ্গে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী নিউইয়র্ক মেইলকে বলেন, এই দুজন চাইলে যেকোনো সময় এমপি হিসেবে শপথ নিতে পারেন। তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচন কমিশন গেজেট প্রকাশ করেছে। শপথের জন্য সময় নির্ধারণ করা আছে নির্বাচিত হওয়ার পর ৯০ দিন পর্যন্ত। একই প্রসঙ্গে ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, জনগণের ভোটে নির্বাচিত যে কেউ শপথ নিতে পারেন।
সংসদ সচিবালয় তাদের শপথ অনুষ্ঠান আয়োজন করবে। এক্ষেত্রে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ কোনো বাধা নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন। ডেপুটি স্পিকার বলেন, সবকিছু তো হয় আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে। তাদের আসার বিষয়টি যদি ঐক্যফ্রন্টের মত নিয়ে না হয় সেক্ষেত্রে বিএনপি তাদের বিষয়ে স্পিকার ও নির্বাচন কমিশনের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিতে পারে। তবে বিষয়টি নিয়ে সুস্পষ্টভাবে আইনগত কোনো ব্যাখ্যা নেই বলে দাবি করেছে সংসদ সচিবালয়। প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কয়েক কর্মকর্তা নিউইয়র্ক মেইলকে বলেন, অতীতে এ ধরনের কোনো উদাহরণ নেই।
গণফোরামের দুই সদস্য যদি সংসদে যোগ দেন তাহলে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বরখেলাপ হবে না। ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন অথবা সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন তাহলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে। এর সাংবিধানিক ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে-যদি কোনো সংসদ সদস্য, যে দল তাহাকে নির্বাচনে প্রার্থীরূপে মনোনীত করিয়াছেন, সেই দলের নির্দেশ অমান্য করিয়া-(ক) সংসদে উপস্থিত থাকিয়া ভোটদানে বিরত থাকেন অথবা (খ) সংসদের কোনো বৈঠকে অনুপস্থিত থাকেন তাহা হইলে তিনি উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে। সংসদ সচিবালয় জানিয়েছে, সংসদে যোগ দিতে ইচ্ছুক ঐক্যফ্রন্টের এমপিরা যদি শপথ নেন ও সংসদে যোগ দেন তাহলে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ তাদের ক্ষেত্রে কার্যকর হবে না। কারণ সংসদে যোগ দিয়ে দলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার কোনো সুযোগ তাদের নেই। কারণ তাদের দলই তো সংসদে নেই।
আর যদি দল থেকে পদত্যাগ করে তাহলে ভিন্ন বিষয়। একাদশ জাতীয় সংসদে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৮জন সদস্য এখনো শপথ নেননি। এরমধ্যে ৬জন বিএনপি’র ও দুইজন গণফোরামের। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম মনোনীত ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে বিএনপি’র ধানের শীষ প্রতীক ও মোকাব্বির খান সিলেট-২ আসন থেকে গণফোরামের প্রতীক উদীয়মান সূর্য্য নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন। কিন্তু তাদের জোটের ভরাডুবি হওয়ায় নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ এনে তারা শপথ অনুষ্ঠান বর্জন করেন।