শিরোনাম
আগে চারজন দাঁড়াত, এখন একটা মারলে ৪০ জন দাঁড়াবে: ড. ইউনূস প্রযুক্তিগত ত্রুটি, যুক্তরাষ্ট্রে বিমান চলাচল বন্ধ গিনিতে ফুটবল ম্যাচে সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে প্রায় ১০০ নিহত রাশিয়ার ‘হাইব্রিড আক্রমণ’ নিয়ে সতর্কতা জার্মানির ভারতে মসজিদে ‘সমীক্ষা’ চালানো ঘিরে সংঘর্ষ, নিহত ৩ সরকারের সমালোচনামূলক গান, ইরানি র‍্যাপারের মৃত্যুদণ্ড ২০ সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ হয়ে যাবে যাদের জিমেইল টিকটক নিষিদ্ধ হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২০টির বেশি অঙ্গরাজ্যে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন হান কাং বিশ্বসেরার স্বীকৃতি পেল ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর সাগরে ডুবে গেল বাংলাদেশ থেকে ফেরা সেই রুশ জাহাজ নিভে গেল বাতিঘর..... গুগল-অ্যাপলকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ড অ্যামাজন পড়াশোনা শেষে ব্রিটেনে থাকতে পারবেন বিদেশি শিক্ষার্থীরা
Update : 19 March, 2019 08:50

সিলেটে ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংশ করে হাসপাতাল নির্মাণ: জনমনে ক্ষোভ

সিলেটে ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংশ করে হাসপাতাল নির্মাণ: জনমনে ক্ষোভ

অমিতা সিনহা, সিলেট থেকে: সিলেটের দেড়শ’ বছরের পুরোনো একমাত্র ঐতিহাসিক স্থাপনা ‘আবু সিনা ছাত্রাবাস’ ভেঙ্গে সেখানে হাসপাতাল নির্মাণ হচ্ছে। সিলেটবাসীর অনেক স্মৃতির জায়গাটি ভেঙ্গে ফেলায় সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষোভে ফেটে পড়েছে সাধারণ মানুষ। ইতিমধ্যে পরিবেশ, সামাজিক ও সাংষ্কৃতিক সংগঠনগুলো প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে।

এলাকাবাসিরা বলছেন, সিলেটের মানুষের জন্য একটি অত্যাধুনিক হাসপাতাল প্রয়োজন। এাঁ সিলেটবাসির দীর্ঘদিনের দাবি। তবে সেই হাসপাতাল একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংশ করে নয়। এই প্রাচীন ঐতিহাসিক ভবনের ধ্বংশযজ্ঞ কেউ মেনে নিতে পাচ্ছেনা। 
আবু সিনা ছাত্রাবাস আসলে এক সময়ের ‘রাজপ্রাসাদ’। কালের বিবর্তনে এর নাম একের পর এক পরিবর্তন হলেও তাঁর নিখুত শৈলী, সৌন্দর্য ও আকৃতি এখনো যৌবন ধরে রেখেছে। সিলেটবাসির কাছে এটা একটা নস্টালজিয়ার নাম।  
২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫০ শয্যা আধুনিক হাসপাতালের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। সেই হাসপাতাল নির্মাণের জন্য ধ্বংশ করা হচ্ছে এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি।  সরেজমিনে সিলেট নগরীর চৌহাট্টায় অবস্থিত ভবনটিতে ঘুরে দেখা যায়, জরাজীর্ণ বিশাল ভবনটি দেখতে ইংরেজি বর্ণের  ‘ট’ আকৃতির মতো। বিশাল রাজপ্রাসাদের মতো ভবনটির একশটি প্রাচীন দেওয়ালের মধ্যে দুইটি দেওয়াল গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ইতিমধ্যে। আর সামনের খোলা জায়গায় চলছে হাসপাতাল নির্মাণের কাজ। 
হাসপাতালের নতুন ভবনের নির্মাণ শ্রমিকরা জানান, ফেব্রুয়ারী মাসে প্রথম সপ্তাহ থেকে সিলেট জেলা হাসপাতালের নির্মাণের কার্যক্রম চলছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ১শ’ ২০জন রাজমিস্ত্রি এই কাজ করছে। ভবনের প্রাঙ্গনে উঠতি গাছ গাছালিকে কেটে ফেলতে হচ্ছে। ১৫তলা বিশিষ্ট হাসপাতাল ভবন নির্মাণ শেষ হবে দুই বছরের মধ্যে।
প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর মোকতালিম দি নিউইয়র্ক মেইলকে জানান, হাসপাতালের নির্মাণের কাজ ঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারছেনা তিনি। এই পুরনো ভবনের মধ্যে আধুনিক হাসপাতাল ভবন নির্মাণের জন্য বলা হয়েছে। তবে এখনো ঠিকভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি কোথা থেকে হাসপাতাল নির্মাণের কাজ শুরু হবে বলে। 
অনুসন্ধানে জানা যায়,  ১৮৭৬ সালে সিলেটের প্রথম সংবাদপত্র ‘শ্রীহট্ট প্রকাশ’ এর প্রেস ছিলো বর্তমান আবু সিনা ছাত্রাবাসটি। এছাড়া এই প্রাচীন স্থাপনাটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বর্মি ও ব্রিটিশ বাহিনীর ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিলো। এর আগে ভবনটি জমিদার বাড়ি ছিলো বলে জানা যায়। কেউ বলে এটি সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলা দুহালিয়া জমিদারবাড়ির সম্পত্তি। যার নাম ছিলো দুহালিয়া হাউজ। আর কেউ বলে এটি সুনামগঞ্জ সদরের গৌরাং বাজার বাড়ি। আর কেউবা এই ভবনটি  সিলেট ভ্যালী মেডিক্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠান ছিলো বলে। খোঁজ নিয়ে আরো জানা যায়, এই ভবনটি আসলেই জমিদারদের ভবন ছিলো। কিন্তু কোন নথিপত্র না থাকায় চিহ্নিত করে কেউ সঠিক তথ্য দিতে পারিনি। তবে ১৯৩৬ সালে সিলেটের সিভিল হাসপাতাল স্থাপিত হওয়ার একযুগ পর ১৯৪৮ সালে চৌহাট্টা এলাকা বর্তমান ডা. চঞ্চল সড়ক এর দক্ষিণ পাশে ভবনটিকে সংস্করণ ও বর্ধিতকরণ করে সিলেট মেডিকেল স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সরকারের সময় সিলেট মেডিকেল কলেজ নামে উন্নীত করা হয়। ১৯৬৯-১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ প্রফেসর ডা. শামসুদ্দিন আহমদ এই মেডিকেল কলেজের ও হাসপাতালের শল্য বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্বপালন করেছিল। ওই সময় পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হন ডা. শামসুদ্দিনসহ আরো অনেকেই। 
এরপর ১৯৭১স ালের ৯ এপ্রিল এই ভবনটির সামনে সম্মুখ যুদ্ধ হয় মুক্তিযোদ্ধা ও পাকসেনাদের মধ্যে। যুদ্ধের পর ১৩ এপ্রিল কারফিউ জারি করা হলে ক্ষতবিক্ষত মরদেহগুলোকে আশপাশের ছোট ছোট গর্তে সমাহিত করেন স্বজনরা। এর মধ্যে সিলেটের চৌহাট্টার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ছিলো সমাহিত গর্তের মধ্যে একটি। 
১৮৬৯ ও ১৮৯৭ সালের ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে ধ্বসে পরে বিলুপ্ত হয়ে যায় সিলেটের অনেক প্রাচীন স্থাপত্য। এর মধ্যে ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হয় সিলেটের মনিপুরী রাজবাড়ি ভবনটিও। শুধু অক্ষত অবস্থায়  বেঁচে যায় সিলেটের এই ‘আবু সিনা ছাত্রাবাস’ ভবনটি। এই প্রাচীন একমাত্র ঐতিহাসিক স্থাপনটিকে রক্ষণাবেক্ষণ করে যাদুঘরে রূপান্তরিত করার জন্য অনেকে দাবি করলেও কোন লাভ হয়নি। অবশেষে হাসপাতালের কারণে মৃত্যু ঘটছে অনেক ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী এই ভবনটির।  
এ প্রসংগে প্রকৌশলী তোফায়েল মোহাম্মদ সারওয়ার দি নিউইয়র্ক মেইলকে বলেন, ঐতিহ্য সংরক্ষণ করার জন্য আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এটা শুধু আমাদের জন্য না, নতুন প্রজন্মের জন্য ইতিহাস সংরক্ষন জরুরি। কারণ আমরা যদি নতুন প্রজন্মের জন্য কোন কিছু রেখে না যেতে পারি তাহলে তো ওরা জানতে পারবেনা আমাদের ঐতিহ্য কি ছিলো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে থাকা প্রাচীন স্থাপনাকে সংরক্ষণ করে বিশ্বের কাছে তুলে ধরে। আর আমরা ইতিহাস ধ্বংশ করি।
এ বিষয়ে সিলেট শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবি)’র স্থপতি শুভজিৎ দাস দি নিউইয়র্ক মেইলকে বলেন, আবু সিনা ছাত্রাবাস ভবনটি অনেক পুরনো ঐতিহাসিক রাজাদের রেখে যাওয়া চিহ্নের মধ্যে একটি। বাংলাদেশে এরকম চিহ্নিত রাজপ্রাসাদ খুবই কম দেখা যায়। এই ঐতিহাসিক প্রাচীন রাজ মহলকে ধ্বংস না করে কিভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা যায় তা আমাদের সচেতন ভাবে চিন্তা করতে হবে। ইতিহাসের সাথে জড়িত কোন স্থাপনাকে ভেঙে ফেলে হাসপাতাল নির্মাণ করা কোনভাবেই শোভনীয় কাজ নয়। 
সচেতন নাগরিক কমিটির সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ বলেন, ইতিহাসের সাথে যে স্থাপনা জড়িয়ে আছে, তাকে ভেঙে ফেলে সিলেট জেলা আধুনিক হাসপাতাল তৈরি করা কোনভাবেই উচিত বলে আমি মনে করিনা। এমনিতেও সিলেটে পুরনো প্রাচীন কোনো স্থাপত্য নেই বললেই চলে। সিলেট নগরীর রাজবাড়ীর রাজাদের প্রাসাদটিও ভূমি কম্পনে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আর এই স্থাপনাটি যতেœর সাথে রক্ষণাবেক্ষণ করা সবার দায়িত্ব। আধুনিক হাসপাতাল গড়ে তোলার জন্য সিলেটের ভিতরে আরও অনেক জায়গা আছে, সেখানে করা যেতে পারে। কিন্তু আবু সিনা ভবন ধ্বংস করে মধ্যস্থানে হাসপাতাল নির্মাণ করা কোনভাবেই কাম্য নই। ইতিহাসের সাথে সংযুক্ত প্রাচীনতম স্থাপনাকে ভেঙে ফেলায় আজ সিলেটবাসীকে মাঠে নেমে মানববন্ধন করতে হচ্ছে। নতুন প্রজন্মরা চোখের সামনেই দেখছে কিভাবে  ঐতিহাসিক প্রাচীন স্থাপনাকে ভেঙে ফেলা হচ্ছে। এটা জাতির জন্য মঙ্গল জনক না। 
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, আবু সিনা ছাত্রাবাসের আশপাশে আরও কয়েকটি সরকারি হাসপাতাল আছে, সেহেতু প্রাচীনতম স্থাপনাটি গুঁড়িয়ে না দিয়ে এটিকে কিভাবে রক্ষা করা যায় তা সব মহলকে ভাবতে হবে। আবু সিনা ছাত্রাবাস কোন ছাত্রদের ছাত্রবাস না। এটি পুরাতন ইতিহাসের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক প্রাচীন স্থাপনা। এই প্রাচীন স্থাপনাকে যতেœর সাথে সংগ্রহ করে দেশের প্রাচীনতম মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করা যায়। এছাড়া সিলেট হচ্ছে দেশ-বিদেশের পর্যটন বান্ধব জায়গার মধ্যে একটি অন্যতম স্থান। এই স্থাপনা রক্ষার জন্য আন্দোলন চলবে বলেও তিনি জানান।
 

 

 

 

উপরে