অগ্নিকাণ্ড রোধে প্রধানমন্ত্রীর একগুচ্ছ নির্দেশনা
অগ্নিকাণ্ড ও ক্ষয়ক্ষতি রোধে বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র, নিয়মিত পরিদর্শন করে প্রতিবছর নবায়নের ব্যবস্থা রাখাসহ একগুচ্ছ নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সচিবালয়ে সোমবার মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে বনানীর এফআর টাওয়ারের অগ্নিদুর্ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর প্রধানমন্ত্রী এসব ‘অনুশাসন’ দেন বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম জানান। তিনি আরও জানান, বনানীর এফআর টাওয়ারের আগুনে নিহতদের স্মরণে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করেছে মন্ত্রিসভা।
এ ছাড়া বৈঠকে হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১৯ এবং গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন-২০১৯-এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, শিল্পকারখানার ক্ষেত্রে ফায়ার ক্লিয়ারেন্সটা প্রতিবছর নবায়ন করতে হয়। কিন্তু আমাদের বহুতল বাণিজ্যিক ভবনের ক্ষেত্রে এ নিয়ম নেই। কাজেই এটি একটু পরীক্ষা করে দেখা যে, বছর বছর এটি নবায়ন করা যায় কি না। যদি করা যায় তাহলে বাধ্য হয়েই সবাইকে এ নিরাপত্তা ব্যবস্থাটা নিতে হবে। যেমন, ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে এখন এই কারণে আগুন লাগার হার অনেকটাই কমেছে। খুব কঠোরভাবেই এ আইনটি প্রয়োগ করা হবে। এ জন্য পূর্তমন্ত্রী জানান, ঢাকা শহরে তাদের ২৪টি দল কাজ করছে। যারা এ সংক্রান্ত বিষয়ে বহুতল ভবনগুলোর ব্যাপারে রিপোর্ট দেবে এবং যেসব স্থানে এসব নতুন সুযোগ-সুবিধা ইনস্টল করা সম্ভব সেখানে করতে হবে নচেৎ ভবন ভেঙে ফেলতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনগুলো : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুশাসনগুলোর মধ্যে রয়েছে- ১. বহুতল ভবন তৈরি করার ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস সাধারণত একটি ক্লিয়ারেন্স দেয়, সে ক্ষেত্রে এখন ক্লিয়ারেন্সই যথেষ্ট নয়, এটি পরিদর্শন করে বহুতল ভবন নির্মাণযোগ্য কি না, তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। ২. ফায়ার সেফটির বিষয়টি নিয়মিত অনুসন্ধান করা এবং শিল্পকারখানার মতো প্রতিবছর এটি নবায়ন করা যায় কি না, বছর বছর তা দেখা।
৩. বিল্ডিং কোড অনুসরণ করা। ৪. নিয়মিত ফায়ার ড্রিল করা (অগ্নিনির্বাপণ মহড়া), যেটি প্রতি তিন মাসে একবার হতে পারে। ৫. অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রে দেখা যায় ধোঁয়াতেই অধিকাংশ মানুষ শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যায়। কাজেই পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এই স্মোক কন্ট্রোলের যে ব্যবস্থা রয়েছে তা অনুসরণ করা। ৬. আগুন লাগলে পানির অভাব দূর করার জন্য রাজধানীর যেখানে যেখানে সম্ভব জলাশয় বা জলাধার তৈরি করা।
৭. রাজধানীর ধানমণ্ডি, গুলশানসহ এখন যেসব লেক রয়েছে সেগুলো সংরক্ষণ করা। ৮. বাংলাদেশে আগুন লাগলে ৩০ তলা পর্যন্ত যাওয়ার জন্য বর্তমানে তিনটি সুউচ্চ মই (ল্যাডার) রয়েছে। এই সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। ৯. ভবন নির্মাণের সময় স্থপতিরা যেন আমাদের পরিবেশ ও বাস্তবতার নিরিখে বহুতল ভবনের নকশা প্রণয়ন করেন। বর্তমানের ম্যাচ বক্সের আদলে দরজা-জানালা ব্লক করে পুরো কাচঘেরা দিয়ে কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভবন করা হচ্ছে। সেভাবে না করে বারান্দা বা জানালা নির্মাণ করা। যেন কোনো বিপদ ঘটলেও শ্বাস নেয়ার জন্য পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা থাকে।
১০. ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে শতভাগ ফায়ার এক্সিট নিশ্চিত করা। ১১. ইলেকট্রিক সিস্টেম ডোর ফায়ার এক্সিটে থাকবে না, সেগুলো ওপেন দরজা ও ম্যানুয়ালি নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। ১২. দমকল বাহিনীর সেফটি গিয়ারে তারপলিন সিস্টেম ও নেট সিস্টেম অন্তর্ভুক্ত করা। যাতে কোথাও আগুন লাগলে মানুষ তার মাধ্যমে ঝুলে ঝুলে নেমে যেতে পারে।
১৩. হাসপাতাল ও স্কুলগুলোতে রুমের বাইরে বারান্দা বা খোলা জায়গা রাখা। ইন্টেরিয়র ডিজাইনাররা অনেক সময় এগুলো ব্লক করে দেয়, কাজেই সেটা যেন না হয়। ১৪. আগুনের সময় লিফট ব্যবহার না করা, এ জন্য সচেতনতা সৃষ্টিতে প্রশিক্ষণ দেয়া। ১৫. প্রতিটি ভবনে কম করে হলেও দুটি এক্সিট পয়েন্ট যেন থাকে।
পরে সাংবাদিকরা গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের কার্যালয়ে গিয়ে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা তাদের কাজকে আরও উজ্জীবিত করবে। বনানীর আগুনের ঘটনার পর দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ছাড়া ঢাকার বহুতল ভবনগুলো নির্মাণে কোনো অনিয়ম আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে ২৪টি উপদল (টিম) গঠন করা হয়েছে। তারা আজ (সোমবার) কাজ শুরু করেছে। তাদের আগামী ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে হবে।
প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কোন কোন ভবনে অনিয়ম রয়েছে বা ভবনগুলো কী অবস্থায় আছে, তার তথ্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে জানানো হবে। এরপর মালিককে একটা সংক্ষিপ্ত সময় দিয়ে বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন আছে কি না, তা নিশ্চিত করতে বলা হবে। এরপরও নিয়ম না মানলে ফৌজদারি ব্যবস্থাসহ যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রসঙ্গত, গত ২৮ মার্চ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর ২৩ তলা ভবনে আগুন লেগে ২৬ জনের মৃত্যু হয়, আহত হন অর্ধশতাধিক মানুষ। ১৮ তলার অনুমোদন নিয়ে ভবনটি ২৩ তলা করা হয়েছিল এবং অগ্নিনিরাপত্তার যথাযথ ব্যবস্থা সেখানে ছিল না বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১৯’ ও ‘গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১৯’-এর খসড়া নীতিগতভাবে অনুমোদন করা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম জানান, অন্য কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আইনগুলো অনুসরণ করে ‘হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১৯’-এর খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে নতুন কিছু নেই।
খসড়া আইন অনুযায়ী, নতুন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়টি হবিগঞ্জ জেলায় প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং রাষ্ট্রপতি এর আচার্য হবেন। হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরুতে কৃষি, মৎস্য ও পশুসম্পদ নিয়ে তিনটি অনুষদ থাকবে। সেই সঙ্গে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এ প্রতিষ্ঠানেও একজন উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, কোষাধ্যক্ষ, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিল থাকবে।
গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইনের খসড়া প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘নতুন খসড়া আইনটি বিদ্যমান রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইনের অনুলিপি মাত্র।’
জানা গেছে, খসড়া আইনে বলা হয়েছে, গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হবে। এর প্রধান হবেন চেয়ারম্যান। চারজন সার্বক্ষণিক সদস্য থাকবেন। বুয়েটের নগর অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক, পরিবেশ ও বন, ভূমি, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পদমর্যাদার একজন করে প্রতিনিধি, পুলিশ কমিশনার, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, স্থাপত্য অধিদফতরের সহকারী প্রধান স্থপতি, স্থানীয় গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী, শিল্প ও বণিক সমিতির প্রতিনিধি, এলাকায় বসবাসরত তিনজন বিশিষ্ট নাগরিক ও সদস্য সচিবের সমন্বয়ে কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে।
সদস্যরা তিন বছরের জন্য নিয়োগ পাবেন। এর আগে বৈঠকের শুরুতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর ২০১৭-১৮ অর্থবছরের কার্যাবলি সংবলিত বার্ষিক প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করেন।