ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবে প্রাণহানি: এখনো নিখোঁজ সিলেটের ছয়জন
তিউনিসিয়ার ভূমধ্যসাগরের উপকূলে নৌকা ডুবে প্রাণহানির ঘটনায় সিলেটের ২০ জনের মধ্যে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ছয়জন। যাদের অভিবাসনপ্রত্যাশী হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
গত ১০ মে লিবিয়ার বন্দরনগরী জুয়ারা থেকে ছেড়ে আসার সময় নৌকা ডুবে ৭০ জনের প্রাণহানি ঘটে। তিউনিসিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম বিষয়টি প্রথম প্রকাশ করে। এই ঘটনায় বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ২৭ বাংলাদেশির পরিচয় নিশ্চিত করে।এর মধ্যে ২০ জন ছিল সিলেটের।
মৃতরা হলেন- সিলেটের জিল্লুর রহমান, লিমন আহমেদ, আবদুল আজিজ, আহমেদ, জিল্লুর, রফিক, রিপন, আয়াত, আজমল, কাসিম আহমেদ, খোকন, রুবেল, মনির, বেলাল ও মারুফ। সুনামগঞ্জের মাহবুব ও নাদিম আর মৌলভীবাজারের শামিম ও ফাহাদ।
এছাড়া নৌকাডুবিতে নোয়াখালীর চাটখিলের নাসির, গাজীপুরের টঙ্গীর কামরান, শরীয়তপুরের পারভেজ, কামরুন আহমেদ, মাদাবীপুরের সজীব এবং কিশোরগঞ্জের জালাল উদ্দিন ও আল আমিনের মৃত্যু হয়।
এ ঘটনার পর স্বজনরা আপনজনদের সন্ধানে সিলেটের ট্রাভেলস এজেন্সির উপর চড়াও হয়ে উঠে। এক পর্যায়ে ১৩ মে থেকে মানবপাচার বন্ধ করতে অবৈধ মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযানে মাঠে নেমে পড়েন সিলেট জেলা প্রশাসকের নির্দেশে জেলা প্রশাসকের ভ্রাম্যমান আদালতের ৫টি টিম। সাথে সাথেই ওই দিন ২৪টি ট্রাভেলস এজেন্সিকে বিভিন্ন অনিয়মের দায়ে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। আর মানবপাচারের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় ৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয় ভ্রাম্যমান আদালত।
অবৈধ মানব-পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।সিলেটের আদম ব্যবসায়ীরা নিজ নিজ দপ্তর বন্ধ করে গাঁ ঢাকা দিয়ে চলেছে।
এদিকে সিলেট নগরীর রাজা ম্যানশনের নিউ ইয়াহিয়া ওভারসিজের সত্ত্বাধিকারী মানবপাচারকারী দালাল এনামুল হক, মোহাম্মদ আক্কাস মাতুব্বর ও আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়াকে আটক করে ২০জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। মানবপাচারকারী এনামুল হকের মাধ্যমে ইতালি যাওয়ার জন্য ভূমধ্যসাগরের উপকূলে নৌকা যোগে সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার চার জন যুবক পাড়ি দিলে ওই স্থানে নৌকা ডুবে প্রাণহানি হয়।
এই ঘটনার অভিযোগের ভিত্তিতে সিলেট জেলা প্রশাসক মাঠ চষে বসে বিদেশে মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে। তিউনিসিয়ার প্রাণহানি ২০ জনের মধ্যে এখনো ছয় অভিবাসীর কোন লাপাত্তা না পেয়ে সিলেটের আকাশ স্বজনের কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে। থানা পুলিশে দৌড় ঝাঁপ করেও কোনো উপায় না পেয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন নিখোঁজদের স্বজন।
নিখোঁজরা হলেন- জিল্লুর রহমান (২২), সাব্বির খালিক (২৪), জুয়েল আহমদ (২৩), রেদওয়ানুল ইসলাম খোকন (২৬) এবং আজিজুর রহমান রুকুলসহ মৌলভীবাজারের আরো একজন।
র্যাব ও স্বজনদের সূত্রে জানা যায়, প্রথমে বিদেশে উচ্চ বেতনের কর্মসংস্থানের প্রলোভন দেখিয়ে ৭/৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় মানবপাচারকারী দালাল চক্র।
দেশে এই রকম মানব পাচারকারী ৫/৬টি এজেন্সি রয়েছে। তারা আগে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া পাঠান তিনটি রুট ব্যবহার করে। এরপর বাসযোগে কলকাতা। কলকাতার বিমানবন্দর যোগে করে দিল্লি। এরপর দিল্লি থেকে শ্রীলঙ্কায় পাঠানো হয়। তারপর অভিবাসীদেরকে বেশ কিছু দিন অবস্থান করতে হয় শ্রীলঙ্কার এজেন্টদের তত্ত্বাবধানে। এরপর বিমানযোগে ইস্তাম্বুল তুরস্কের ট্রানজিট হয়ে লিবিয়ার ত্রিপলিতে পৌঁছার পর সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশি কয়েকজন এজেন্ট তাদের গ্রহণ করে।
সেখানে কয়েকদিন অবস্থানের সময় অভিবাসীদের আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে বাকি টাকা আদায় করে ভূমধ্যসাগরের পথে ইউরোপে প্রেরন করেন।
১৩ মে তিউনিসিয়ার ভূমধ্যসাগরে উপকূলে নৌকা ডুবে প্রাণহানির ঘটনায় সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমা উপজেলার জিল্লুর রহমান (২২) নামের একজন এখনও নিখোঁজ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে প্রতারণার জালে ফেঁসে যায় জিল্লুর রহমান ৮ লাখ টাকা দিয়ে। ইতালিতে উচ্চ বেতনের কর্মসংস্থানের কথা বলে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া নিয়ে যায়। তারপর ভূমধ্যসাগরে নিয়ে বন্দুক দিয়ে গুলি করে প্রাণের মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে জাহাজ থেকে ছোট ছোট নৌকায় অভিবাসীদের উঠার জন্য বাধ্য করে। মৃত্যুর ভয় থেকে বাঁচার আশায় চ্যালেঞ্জ নিয়ে স্বপ্নের দেশে যাত্রা করান জিল্লুরকে। শুধু জিল্লুর নয়। সিলেটে এই রকম সব অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সাথে এমনি আচরণ করে মানব পাচারকারীরা। দিনে এক বেলা একটি রুটি দেওয়া হয় খাবারের জন্য। কেউ খাবারের জন্য দুইবার কল করলে তাকে শাস্তি স্বরূপ ৭২ ঘন্টার পর খাবার দেওয়া হয়।
দক্ষিণ সুরমা উপজেলার ইনাত আলীপুর গ্রামের বাসিন্দা জিল্লুর রহমানের বাবা লেচু মিয়া জানান, ভূমধ্যসাগরে নিখোঁজদের মধ্যে জিল্লুর রহমানের নাম রয়েছে। এ খবর পাওয়ার পর যে দালালের মাধ্যমে জিল্লুর ইউরোপে পাড়ি দিয়েছিল সেই বশির আহমদ লিলু মিয়াকে বিষয়টি জিজ্ঞেস করলে তিনি আমাদের সাথে নানা ধরণের ভয়ভীতিও দেখান। দালাল বশির বি. কে. এয়ার সার্ভিস এবং সিদ্দিকিয়া হজ্ব ট্রাভেলস এর সত্ত্বাধিকারী ।
তিনি বলেন, ইতালি পাঠানোর নামে দালাল বশির প্রথমে ৮লাখ টাকা নেন। পরে আরো ৪ লাখ টাকা দিতে হয়। নিখোঁজ জিল্লুর রহমান সিলেট সরকারি কলেজের স্নাতক ২য় বর্ষের ছাত্র।
মানব পাচারকারী বশিরের খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, তার সব অফিস বন্ধ।পাশাপাশি তার ব্যবহৃত সব মোবাইলও যোগযোগ বিচ্ছিন্ন দেখা যায়।
দালাল বশিরের গ্রেফতারের দাবিতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান স্বজনরা।
এদিকে একই ঘটনার শিকার সিলেট সদরের বাসিন্দা নিখোঁজ সাব্বির খালিক । তার অনুসন্ধানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন নিখোঁজ সাব্বিরের ভাই শাহ আলম, চাচা কান্দিগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি সামসুল হকসহ অন্যান্য স্বজনরা ।
মন্ত্রীর কাছে নথিপত্র প্রদান করেন সুস্থ্যভাবে তদন্ত করে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য। নিখোঁজ সাব্বির সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের ৮ং ওয়ার্ড এর বসন্তরাগাঁও নিবাসীর মৃত আব্দুল খালিকের পুত্র। এই ঘটনায় বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সিলেট অফিসকে অবহিত করা হয়েছে এবং সিলেট জালালাবাদ থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছে বলে জানান স্বজনরা।
অপরদিকে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখার যুবক জুয়েল আহমদ (২৩) এখনও নিখোঁজ রয়েছে। নিখোঁজ জুয়েল বড়লেখা উপজেলার উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নের ছাতারখাই গ্রামের জামাল উদ্দিন বছরের পুত্র।
জুয়েলের বাবা জামাল উদ্দিন বছর বলেন, গত ১০ মে ইতালিতে যাওয়ার পথে নৌকাডুবিতে আমার ছেলে জুয়েলও ছিল। যাবার আগের দিন আমাকে ছেলে ফোন করে জানিয়েছিল যে ও ইতালির উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। ঘটনার পর বাংলাদেশের একটি অ্যাম্বেন্সির সাথে যোগাযোগ করি। কিন্তু তারা বলেছে জুয়েলের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এদিকে ভূমধ্যসাগরের নৌকাডুবিতে আজিজুর রহমান রুকুল ইসলামসহ মৌলভীবাজারের আরেক নিখোঁজ আজিজুর সদর উপজেলার উপজেলা ১২নং গিয়াসনগর ইউনিয়নের কালিয়ারগাঁও গ্রামের মৃত সাদিকুর রহমানের পুত্র। নিখোঁজের বিষয়টি নিশ্চিত করেন আজিজুর রহমানের বড় ভাই মো. মুহিবুর রহমান।