বালিশ! মাথার নীচে না উপরে?
॥ শামীমুল হক ॥
ঘুরে ফিরে কেন যে বালিশ আলোচনায় আসে তা বুঝিনা। এক এগারোর জামানায় বন খেকোর বালিশ কাহিনীর কথা মনে পড়ে কি? বন খেকোর বাসায় অভিযান চালিয়ে বালিশের ভেতর থেকে কোটি কোটি টাকা বের করা হয়েছিল। শুধু বালিশই নয়, চালের ড্রাম, ঘরের এখানে সেখানে শুধু টাকা আর টাকা। সে সময় গোটা দেশে রব উঠেছিল বালিশ নিয়ে। দীর্ঘদিন পর ফের আলোচনায় এলো এই বালিশ। এবার বালিশ ব্যবহার করে কোটি টাকা কামিয়ে নেয়া হয়েছে।
রুপপুর পারমানবিক প্রকল্পে একটি বালিশ বানাতে খরচ হয়েছে প্রায় সাত হাজার টাকা। আর এ বালিশ ভবনে উঠাতে খরচ হয়েছে প্রায় সাতশ টাকা। ওরে বাবারে! কোন দেশে আছি আমরা? এ নিয়ে হইচই দেশজুড়ে। বালিশ কাহিনী এখন আলোচনার শীর্ষে। বন খেকো ঘুষ খেয়ে বাড়ি-গাড়ি, ধন-দৌলত, ব্যাংক ব্যালেন্স করেও হাতে থেকে যায় কোটি কোটি টাকা। আর ওই টাকা দিয়ে বালিশ বানিয়ে রেখে দেয় নিজ ঘরে। মিডিয়া খবর নিয়ে দেখেছে এত টাকার মালিক হলেও বনখেকো তার মাকে ভরণপোষণ করতো না। ভাঙা ঘরেই বসবাস করতে হয়েছে তাকে। আর রুপপুরের বালিশ কাহিনী অবাক করে দিয়েছে গোটা দেশকে। এভাবেও প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করা যায়? আসালে তারা ঘুমাবার সময় বালিশ মাথার নীচে নাকি উপরে দিয়ে ঘুমায়? খুব জানতে ইচ্ছে করে।
এমন দিনকে সামনে রেখেই হয়তো কবি বলেছিলেন- পৃথিবীতে হায়? সে বেশি চায়/ আছে যার ভূরি ভূরি/ রাজার হস্ত করে/ সমস্ত কাঙ্গালের ধন চুরি। চলার পথে কবির এ কাব্য কত যে মধুর তা সবাই উপলব্ধি করছেন। বাস্তবেও দেখছেন প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। রাস্তায় বেরুলে ছিনতাইকারী, মলম পার্টি, ব্লেড পার্টি, পকেটমার এমনকি থাবা পার্টির ভয়। যে কোন সময় তারা তাদের কৌশল প্রয়োগ করে হস্তগত করতে পারে অন্যের ধন, অর্থ। কেউ কেউ এটাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। আবার রাজপথে, ফুটপাথে অনেক ভিক্ষুক আছেন যারা কোটিপতি। ঢাকায় তাদের একাধিক বাড়ি রয়েছে। ভবন রয়েছে। কারও কারও সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। কারও সন্তান সম্মানজনক চাকরি করছেন।
কেউ কেউ মেয়ে বিয়ে দিয়েছে লাখ লাখ টাকা খরচ করে। এত কিছুর পরও ওইসব ভিক্ষুক এখনও রাজপথে থালা নিয়ে বসেন। ভিক্ষা করেন। বাসায় থাকতে নাকি তাদের ভাল লাগে না। ঘুমের মধ্যেও মাঝে মাঝে বলে ওঠেন- ‘মাগো কিছু দিয়া যান।’ দীর্ঘদিনের অভ্যাস ত্যাগ করা খুব কঠিন।
এক ছেলে বিয়ে করেছে। ঘরে নতুন বউ। প্রতিদিন সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রাতে বাড়ি ফেরে। একদিন বউ তাকে বলছে, তুমি কি কর। ছেলে জবাব দেয় চাকরি করি। বড় চাকরি। ওগো বলো না কি চাকরি? ছেলে কোন জবাব দেয় না। এভাবে দিন চলতে থাকে। বেশ কিছু দিন পর একরাতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন দু’জন। হঠাৎ চিৎকারে বউ ঘুম থেকে জেগে উঠেন। দেখেন স্বামী তার চিৎকার করে বলছেন- ওই লাগেনি জুতা পালিশ...। লাগেনি জুতা পালিশ...। বউয়ের আর বুঝতে বাকি রইলো না তার স্বামী কি করেন। দিনে যা করেন রাতে স্বপ্নের মধ্যেও স্বামী বেচারা তা দেখছেন। তাই ডাকছেন ‘ওই লাগেনি জুতা পালিশ...।’ আসলে অভ্যাস কখনও পরিবর্তন হয় না। এমনকি তা আপনজনের কাছে লুকাতে গেলেও তা প্রকাশ হয়ে পড়ে। কখনো স্বপ্নে কিংবা কখনও মনের অজান্তেই । রাজধানী ঢাকার অলিগলিতে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের ছড়াছড়ি। সব ক’টি কেন্দ্রই চলছে বেশ ভালভাবেই। অথচ একসময় সরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ছিল একটি। তা তেজগাঁওয়ে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো- এসব কেন্দ্র থেকে চিকিৎসা নিয়ে আসক্তরা কি সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে পেরেছেন। না। বেশির ভাগই সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে পারেননি। কারণ এসব কেন্দ্রে মাস কয়েক থাকার পর বাইরে বেরিয়ে ফের তারা অন্ধকার জগতে পা বাড়ান। এমনও শোনা যায়, কোন কোন নিরাময় কেন্দ্রে নিজেরাই আসক্তদের নেশা সরবরাহ করে। ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। পুরনো অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেন না তারা। নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা করিয়েও সন্তানদের সুস্থ করতে পারছেন না অভিভাবকরা। এমন কত অভ্যাস যে গড়ে তোলে মানুষ। ঘুষখোর অফিসার জীবনে কোটি কোটি টাকা ঘুষ খেয়েও তার অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেন না।
বাড়ি-গাড়ি, ধন-দৌলত করেও তাদের আফসোস থেকে যায়। তাকে দেখে দেশের মানুষ যতই ছিঃ ছিঃ করুক এতে তার কিছুই যায় আসে না। এই যে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ফোকলা করে হাজার হাজার কোটি টাকা গিলে খেয়েছে। কখনো ভূয়া এলসি, কখনো নকল কাগজ সরবরাহ করে একের পর এক টাকা তুলে নিয়েছে তারা। বাসের কন্ডাক্টরও নাকি সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। ব্যাংকের কর্ণধাররা পৈতৃক সম্পত্তি মনে করে ব্যাংকগুলোকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে ব্যবহার করেছে। এসবের কোন প্রতিকার নেই।
দেশ যেভাবে চলার চলছেই। কেউ অভ্যাস বদলায়না। বদলাতে চায়না। সবাই মনে করে তিনি যা করছেন, তা-ই ভাল। এ কারণেই হয়তো ‘কয়লা যায়না ধুলে, অভ্যাস যায়না মরলে‘ প্রবাদ বাক্যটি সমাজে প্রচলিত। আর তাইতো কারো কারো জীবনে অভ্যাস পরিণত হয় বদ অভ্যাসে। আর এ বদ অভ্যাসের কারণেই বারবার ঘটে বালিশ কাহিনী।