‘আস্থাহীনতার’ কারণে প্রত্যাবাসনে অনীহা রোহিঙ্গাদের
প্রত্যাবাসনের সর্বশেষ প্রক্রিয়াটিও বাস্তবায়ন না হওয়ার জন্য মূলত ‘আস্থাহীনতাকেই’ দায়ি করেছেন কথা এসব রোহিঙ্গা।
এমন কি মিয়ানমার কর্তৃক প্রত্যাবাসনের জন্য চুড়ান্ত স্বীকৃতি পাওয়া তালিকাভূক্ত রোহিঙ্গাদের মধ্যে কেউ কেউ জোর করে পাঠিয়ে দেয়ার ভয়ে বাড়ী ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ারও তথ্য পাওয়া গেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রত্যাবাসনের জন্য বিভিন্ন তথ্য সম্বলিত তৈরী মিয়ানমারের কাছে ২২ হাজারের বেশী রোহিঙ্গার একটি তালিকা পাঠিয়েছিল। এ নিয়ে যাচাই বাছাই শেষে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সাড়ে ৩ হাজারের বেশী রোহিঙ্গার চুড়ান্ত একটি তালিকা বাংলাদেশের কাছে পাঠায়।
সর্বশেষ চলতি বছরের জুলাই মাসে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে নতুন করে উদ্যোগের অংশ হিসেবে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব মিন্ট থোয়ের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধি দল কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। দুইদিন ধরে ১৫ সদস্যের দলটি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনা ও বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে রোহিঙ্গাদের তরফে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব ও চলাফেরায় স্বাধীনতার দাবি পুনর্ব্যক্ত করা হয়।
এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের কাছে পাঠানো তালিকা ধরে মিয়ানমার ২২ আগস্ট দিনক্ষণ ঠিক করে প্রত্যাবাসন শুরুর সম্মতি জানিয়ে একটি চিঠি দেয়। এ নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও সার্বিক প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের প্রতিনিধি এবং জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা-ইউএনএইচসিআর যৌথভাবে প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের স্বীকৃতি দেয়া তালিকাভূক্ত রোহিঙ্গাদের গত ২০ আগস্ট থেকে মতামত নেয়া শুরু করে।
সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, বৃহস্পতিবার দুপুর ২ টা পর্যন্ত টেকনাফের নয়াপাড়া ২৪, ২৫ ও ২৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৩ শতাধিক পরিবারের মতামত গ্রহণ করা হয়েছে। মিয়ানমারের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ফিরে যেতে এসব পরিবারের কেউ রাজী হননি।
এদিকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সার্বিক প্রস্তুতি থাকার পরও মিয়ানমারের স্বীকৃতি পাওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে কেউ রাজী না হওয়ায় প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হয়নি; বৃহস্পতিবার দুপুরে টেকনাফের নয়াপাড়া ২৬ নম্বর ক্যাম্পে আয়োজিত এক প্রেস বিফ্রিংয়ে এমনটি তথ্য জানান শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম।
এর আগে গত নভেম্বর মাসেও প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ ঠিক করে সার্বিক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেইবারও রোহিঙ্গারা যেতে অনীহা প্রকাশ করায় প্রত্যাবাসন আলোর মুখ দেখেনি।
এ নিয়ে প্রত্যাবাসনের রাজী না হওয়ার ব্যাপারে কথা হয় নয়াপাড়া ২৬ নম্বর ক্যাম্পের বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে। তাদের কেউ মিয়ানমারের স্বীকৃতি পাওয়া তালিকাভূক্ত, কেউ কেউ তালিকার বাইরের।
মিয়ানমারের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তাসহ নাগরিক অধিকার নিশ্চিত না হওয়ায় রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে রাজী হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন নয়াপাড়া ২৬ নম্বর ক্যাম্প ইনচার্জ কার্যালয়ের সামনে সড়কের পাশে রোহিঙ্গা মুদির দোকানদার জাফর আলম।
জাফর বলেন, দীর্ঘ বছর ধরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে জাতিগত নির্যাতন নিপীড়নের শিকার। এনিয়ে বিভিন্ন সহিংসতার ঘটনায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগসহ ভিটেমাটিও হারিয়েছে। তাছাড়াও রোহিঙ্গারা নাগরিক অধিকারসহ নানা বৈষম্য ও শোষণের শিকার।
“এসব কারণে রোহিঙ্গারা এদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। তাই নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ও নিরাপত্তাসহ নাগরিক অধিকার নিশ্চিত না হলে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে না।”
তিনি বলেন, “ নাগরিকত্বের স্বীকৃতি, নিরাপত্তা, নির্যাতনের বিচার ও ভিটেমাটিসহ হারানো সম্পদের নিশ্চিয়তা পেলে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তারা মিয়ানমার সরকারের জিন্মায় ফিরে যেতে রাজী নয়। কারণ মিয়ানমারের ক্যাম্পগুলোতে ডিটেশন প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের ভয় রয়েছে। ”
এ জন্য শর্তপূরণ সাপেক্ষে প্রত্যাবাসনের পর ইউএনএইচসিআর এর তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে আশ্রয় দেয়ার নিশ্চিয়তা পেলে রোহিঙ্গারা ফিরে যাবে বলে মন্তব্য করেন জাফর।
নয়াপাড়া ক্যাম্পের বাসিন্দা জাফর বলেন, “ প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের স্বীকৃতি পাওয়া তালিকাভূক্ত রোহিঙ্গাদের মধ্যে কেউ কেউ জোর করে পাঠিয়ে দেয়ার ভয়ে বাড়ী ছেড়ে পালিয়েছে। মূলত নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তাসহ নাগরিক অধিকারের নিশ্চিয়তা না পাওয়ায় রোহিঙ্গাদের মনে ফিরে যেতে আশংকা তৈরী হয়েছে। ”
জাফরের দোকানের রাস্তার বিপরীতে রোহিঙ্গা মুদির দোকানী ছুরত আলম প্রত্যাবাসনের তৈরী মিয়ানমারের স্বীকৃতি পাওয়া তালিকাভূক্তদের একজন। তিনি দোকানের সঙ্গে সংযুক্ত বাড়ীতেই বসবাস করেন।
জাফর জানালেন, প্রত্যাবাসনের জন্য রোহিঙ্গাদের মতামত গ্রহণ শুরু হলে এবারে জোর করে পাঠিয়ে দেয়ার ভয় ধরে ছুরত আলমের (৫০)। এ কারণে প্রত্যাবাসনের নির্ধারিত দিনের আগেরদিন (২১ আগস্ট) রাতে তিনি পরিবার নিয়ে অন্যত্র চলে যান।
পরে বৃহস্পতিবার দুপুরে জাফরে তথ্যের সূত্র ধরে ছুরত আলমের দোকান ও বাড়ীতে গিয়ে প্রতিবেদক তালাবদ্ধ দেখতে পায়।
একই কারণে বাড়ী ছেড়ে পালিয়েছেন নয়াপাড়া ২৬ নম্বর ক্যাম্পের ডি-ব্লকের বাসিন্দা মোহাম্মদ নুর (৫৫)। তার বাড়ীতে গিয়ে দেখা গেছে দরজায় তালাবদ্ধ।
মোহাম্মদ নুরের প্রতিবেশী খদিজা বেগম (৩৫) বলেন, প্রত্যাবাসনের জন্য মতামত গ্রহণ শুরু হওয়ার থেকে মোহাম্মদ নুরের পরিবারে জোর করে পাঠিয়ে দেয়ার আশংকা তৈরী হয়। এ কারণে তিনিও বুধবার রাতে (প্রত্যাবাসনের আগেরদিন) পরিবার নিয়ে অন্যত্র চলে যান।
প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমরের স্বীকৃতি পাওয়া তালিকাভূক্ত আব্দুল খালেক (৫২) নয়াপাড়া ২৬ নম্বর ক্যাম্পের ই-ব্লকের বাসিন্দা।
আব্দুল খালেক বলেন, প্রত্যাবাসনের জন্য মতামত গ্রহণকারি শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন এবং ইউএনএইচসিআর এর প্রতিনিধি দলের কাছে তিনি কথা বলেছেন। দলটির কাছে কেন মিয়ানমার ফিরতে চাই না তা অবহিত করেছি।
মিয়ানমারে ফিরে যেতে রোহিঙ্গাদের দেয়া শর্তগুলো পূরণের এখনো নিশ্চিয়তা না পাওয়ায় রোহিঙ্গারা রাজী হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকাভূক্ত এ রোহিঙ্গা।
এদিকে প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের নির্ধারণ করা দিনক্ষণে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সার্বিক প্রস্তুতি নেয়া হলেও রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় যেতে অনীহা প্রকাশ করছে। এতে পর পর দু’বার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ ও সার্বিক প্রস্তুতি নেয়ার পরও সফলতার মুখ দেখেনি। মূলত রোহিঙ্গাদের মধ্যে মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ও নিরাপত্তাসহ নাগরিক অধিকারের নিশ্চিয়তা না পাচ্ছে না। এ কারণে প্রত্যাবাসন নিয়ে রোহিঙ্গাদের মাঝে তৈরী হয়েছে ‘আস্থাহীনতা’।