লালবাগ কেল্লায় মানুষ খেকো সুড়ঙ্গ
উপমহাদেশের প্রায় সব প্রাচীন দুর্গ নিয়েই যুগ যুগ ধরে নানা লোককাহিনী, বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। এছাড়া আছে কিছু অভেদ্য রহস্যও। একজন আধুনিক মনস্ক লোকের কাছে এসব লোককাহিনী ও বিশ্বাসগুলো গুজব এবং হাস্যকর মনে হতে পারে।
তবুও বহুসংখ্যক লোক এই বিষয়গুলোকে আজও বিশ্বাস করে।
ঢাকায় অবস্থিত লালবাগ কেল্লা উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহাসিক দুর্গগুলোর একটি। এটি বাংলাদেশে মুঘল স্থাপত্যকলার অন্যতম বড় এক নিদর্শনও।
এর সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। রয়েছে অনেক রহস্যও। লালবাগের দুর্গ বা কেল্লায় দেখার মতো অনেক কিছু রয়েছে, তবে দর্শণার্থীদের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটি ঘিরে তা হলো এর রহস্যময় গোপন সুড়ঙ্গ।
কেল্লার এই গোপন সুড়ঙ্গটি প্রবেশ দর্শণার্থীদের জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আর আমরা সবাই জানি নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া মানুষের প্রকৃতি। তেমনি এই সুড়ঙ্গ নিয়েও মানুষের কৌতুহলের যেন শেষ নেই।
লোকমুখে প্রচলিত এ সুরঙ্গে কেউ প্রবেশ করলে সে আর ফিরে আসে না। তাই কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সুড়ঙ্গের প্রবেশ পথ বন্ধ করা হয়।
চলুন জেনে নেয়া যাক লালবাগ দুর্গের পূর্ব পাশে গোপন সুড়ঙ্গের রহস্যময়ী কল্পকাহিনী সর্ম্পকে।
সুড়ঙ্গের ইতিহাস
লালবাগ কেল্লার নিচে রয়েছে অসংখ্য সুড়ঙ্গ যা জমিদার আমলে তৈরি করা হয়েছিল। সুড়ঙ্গগুলোর মধ্যে একটি সুড়ঙ্গ আছে যার ভেতরে কেউ ঢুকলে তাকে আর ফিরে পাওয়া যায় না।
স্থাপত্যবিদদের মতে, এ পথটি প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে টঙ্গী নদীর সঙ্গে যুক্ত। আবার কেউ মনে করে, এটি একটি জলাধারের মুখ। এর ভেতরে একটি বড় চৌবাচ্চা রয়েছে। মুঘলদের পতনের পর লালবাগ দুর্গ যখন সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়, তখন ঢাকাবাসীর সব আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় এই সুড়ঙ্গ।
সুড়ঙ্গ সম্পর্কে যুক্তিগত মতামত
যেহেতু সুড়ঙ্গ পথের রহস্য উদঘাটনের জন্য আজ পর্যন্ত কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ হয়নি, তাই এটি নিয়ে নানা কল্পকাহিনী চালু আছে। এ কারণেই এ সুড়ঙ্গ পথটি ঢাকার আদি বাসিন্দাদের কাছে এখনো রহস্যময়।
সুড়ঙ্গের রহস্য উদঘাটন
কেল্লার দক্ষিণে আগে বেশ কয়েকটি সুড়ঙ্গের উপস্থিতি থাকলেও মূল সুড়ঙ্গটি লোহার গেট দিয়ে বন্ধ করে দেয়া আছে। পর্যটকরা বেড়াতে গেলে এই সুড়ঙ্গের গল্প অনেকেই শুনেন। বলা হয়, এখান দিয়ে নাকি সুরঙ্গ পথে দিল্লি পর্যন্ত যাওয়া যেত! কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। এটি যুদ্ধকালীন বা বিপদ মুহূর্তে সুবেদারদের নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাবার পথ হিসেবে তৈরী করা হয়েছিল। ভারতের সব দুর্গেই এরকম সুড়ঙ্গের ব্যবহার দেখা যায়।
সাধারণত নদীর ধারের দূর্গের নকশায় সুড়ঙ্গটি তৈরীর কৌশল ছিল যেন তাড়াতাড়ি দূর্গ থেকে নৌপথে যাওয়া যায়। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায় লালবাগ দূর্গের এই সুড়ঙ্গ বুড়িগঙ্গা ব্যতীত অন্য কোথাও শেষ হবার নয়।
তবে এই রহস্যময় সুড়ঙ্গে কোনো মানুষ প্রবেশ করলে আর ফেরত আসেনা। এর কারণ সুড়ঙ্গের ভেতর এতই অন্ধকার ছিল আলোতেও সামনে কিছুই দেখা যায় না।
সুড়ঙ্গ নিয়ে গবেষণা
একদল বিদেশি গবেষক এর রহস্য উৎঘাটনের জন্য সুড়ঙ্গের মধ্যে দুটি কুকুর পাঠান। কিন্তু কুকুর দুটি আর ফিরে আসেনি। পরবর্তীতে শিকল বেঁধে আবার দুটি কুকুরকে পাঠানো হয়েছিল। তখন শিকল আসলেও কুকুরগুলো ফেরত আসেনি।
অনেকের মতে এর মধ্যে এমন এক প্রকার গ্যাস রয়েছে যার প্রভাবে যে কোনো প্রাণী দেহের হাড়, মাংস গলে যায়। আবার কারো কারো ধারণা এর মধ্যে এমন এক প্রকার শক্তি রয়েছে যার ভেতর প্রবেশ করে কোনো প্রাণীর পক্ষেই আর ফিরে আসা সম্ভব নয়।
লোকমুখে শোনা যায়, এই সুড়ঙ্গ দিয়ে পাশেই বুড়িগঙ্গা নদীতে যাওয়া যেত। সুড়ঙ্গমুখ থেকে বেরিয়েই নৌকায় উঠে যাওয়া যেত জিঞ্জিরা প্রাসাদে। আবার নদীর বাতাস অনুভবের জন্য ওই সময়ের সেনাপতিরা এই সুড়ঙ্গ ব্যবহার করতেন। তবে এসব কথাকে শুধুই কল্পকাহিনী বলে দাবি করেছে লালবাগ কেল্লার কাস্টোডিয়ান কার্যালয়। কারণ এসব কথার কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তবে যুদ্ধের সময় মুঘল সেনারা যখন বুঝতেন তাদের পরাজয় কাছাকাছি, তখন তারা এই সুড়ঙ্গ দিয়ে দুর্গের দেয়াল পেরিয়ে পালিয়ে যেতেন।
লালবাগ দুর্গের ইতিহাস
মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ছেলে সুবেদার আযম শাহ ১৬৭৮ সালে ঢাকায় সুবেদারদের স্থায়ী প্রাসাদদুর্গ করার প্রথম উদ্যোগ নেন। অত্যন্ত জটিল একটি নকশা অনুসরণ করে এর নির্মাণকাজ শুরু করেন তিনি।
তিনি দুর্গের নামকরণ করেন কিল্লা আওরঙ্গবাদ। কিন্তু পরের বছর সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে দিল্লি ফেরত পাঠান। এ সময় একটি মসজিদ ও দরবার হল নির্মাণের পর দুর্গ নির্মাণের কাজ থেমে যায়। এরপর সুবেদার হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকা আসেন শায়েস্তা খাঁ।
শায়েস্তা খাঁর মেয়ে পরী বিবির সঙ্গে শাহজাদা আযম শাহর বিয়ে ঠিক ছিল। আযম শাহ হবু শ্বশুরকে লালবাগ দুর্গের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য অনুরোধ করেন। শায়েস্তা খাঁ দুর্গের কাজ পুনরায় শুরু করেন। কিন্তু ১৬৮৪ সালে তার অতি আদরের মেয়ে পরী বিবির আকস্মিক মৃত্যু হয়।
এ ঘটনাকে অশুভ মনে করে দুর্গের প্রায় ১২ শতাংশ সম্পন্ন করে নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেন শায়েস্তা খাঁ। এর পরিবর্তে নির্মাণ করেন চিত্তাকর্ষক পরী বিবির মাজার বা পরী বিবির সমাধিসৌধ।
শায়েস্তা খাঁ ঢাকা ত্যাগ করার পরে দুর্গটির জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। এর মূল কারণ হলো রাজধানীটি ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। রাজকীয় মুঘল আমল সমাপ্ত হওয়ার পরে দুর্গটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়।
পরে ১৮৪৪ সালে অঞ্চলটি আওরঙ্গবাদকে প্রতিস্থাপন করে লালবাগ নামে পরিচিতি লাভ করে।
লালবাগ কেল্লার সুড়ঙ্গ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য যে স্থানগুলো পর্যটকদের আকর্ষণ করে সেগুলো হলো-
পরী বিবির সমাধি
কেল্লার প্রধান দরজা দিয়ে ঢুকে একটু সামনে গেলেই চোখে পড়ে একটি সমাধি। সেটিই হলো পরী বিবির সমাধি।
দুর্গের অভ্যন্তরে মোগল ভবনগুলোর মধ্যে পরী বিবির মাজার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি একটি অনন্য কাঠামো। এটিই একমাত্র ভবন যেখানে রাজমহল পাহাড়ের কালো বেসাল্ট, রাজপুতানার সাদা মার্বেল এবং বিভিন্ন রঙের টাইলস ব্যবহার করা হয়েছে।
ছাদটি একটি গম্বুজ দ্বারা আবৃত এবং লম্বা ফাইনাল দ্বারা মুকুটযুক্ত। মাজারের অভ্যন্তরটি ১৯টি বর্গাকার কেন্দ্রীয় সমাধিসৌধসহ নয়টি কক্ষে বিভক্ত করা হয়েছে।
সমাধি-কক্ষের দক্ষিণে রয়েছে পাথরের দরজার জামে ভরা প্রবেশদ্বার এবং চন্দনের কাঠের দরজা। যা চিনের ক্রস প্যাটার্ন দিয়ে সজ্জিত।
কেল্লার জাদুঘর
লালবাগ কেল্লায় দর্শনার্থীদের বাড়তি আকর্ষণগুলোর মধ্যে একটি হলো জাদুঘর।এটি পূর্বে গভর্নর শায়েস্তা খানের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার হতো। এটি একটি দ্বিতল ভবন যা পশ্চিমে প্রজেক্ট সংযুক্তিযুক্ত। এতে শ্রোতা হল এবং হাম্মামও রয়েছে। কেন্দ্রীয় হলের মাঝখানে একটি ডুবে শোভাময় ঝর্ণা রয়েছে।
হাম্মামটি একটি গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত যা মূলত এটিতে আলো এবং বায়ুচলাচল জন্য একটি খোলার ছিল। এটিতে একটি গাঁথনির ট্যাঙ্ক রয়েছে যা গোসলের জন্য ব্যবহার করা হতো।
এছাড়াও সেখানে স্থান পেয়েছে মুঘল আমলে ব্যবহৃত ১২ মডেলের রাইফেল। হাতে লেখা কোরআন শরিফ। যেন শিল্পীর আঁচড়ে আঁকা প্রতিটি আরবি হরফ। দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটি হাতে লেখা।
সুবেদারদের ঝাড়বাতিগুলো দেখলে যে-কারো চোখ জুড়িয়ে যাবে। এক অপরূপ সৌন্দর্য, সবখানে শৌখিনতার ছোঁয়া। মনে হবে সেটিই আধুনিকতার সর্বশেষ সংস্করণ। খাবারে ব্যবহৃত সিরামিকসের তৈজসপত্র নিয়ে আছে চমকপ্রদ তথ্য।
খাদ্যে ভেজাল কিছু থাকলে ভেজাল উপকরণগুলো ওই থালা-বাটিতে কালো রং ধারণ করত। গোসলখানাটিতে ছিল ঠাণ্ডা ও গরমপানির সুব্যবস্থা। ছিল পৃথক কাপড় পরিবর্তনের ঘর ও টয়লেট। গোসলে ব্যবহৃত পুরো ঘরটি টাইলস লাগানো। এখানেও নকশার অনন্য গাঁথুনি।
লালবাগ দুর্গটি মোঘল স্থাপত্যের অন্যতম কীর্তি একটি ঐতিহাসিক প্রাচীন স্থাপনা হিসেবে এখনো দর্শকদের আকৃষ্ট করে। প্রতিদিন দেশ ও বিদেশের বহু দর্শক এটি দেখতে আসেন। তারা এ দুর্গটির নির্মাণ শৈলী ও কারুকার্য দেখে মুগ্ধ হন।
অনেকেই মনে করেন কেল্লার আরো যত্ন বা সংরক্ষণ প্রয়োজন। কেল্লার ওপর সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের নজরদারি আরো বাড়ানো দরকার ।