শ্রীভূমে কবিগুরুর রোমন্থন
‘শ্রীভূমি’ সিলেটে এসেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৯ সালের নভেম্বরে সিলেটবাসীর আমন্ত্রণে। সেই স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে তাই চলছে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা আর আয়োজন। পূণ্যভূমে এখন তাই পাতার মর্মরেও যেন বাজছে সাহিত্যের বীণা।
শীত-গরমের মিষ্টি হাওয়ার দোলাচলে যখন পুরো এই বাংলার মানুষ প্রাকৃতিক স্নিগ্ধতায় ছিল মগ্ন।সেই ক্ষণে বিশ্বকবির আগমনের বার্তা পেয়েছিল প্রকৃতিপ্রেমী মানুষেরা। ঘর থেকে বের হয়ে এসে এপার-ওপারের সর্বত্রে ছড়িয়ে দিল কবিগুরু আগমণের বার্তা।
বাংলা কার্তিক মাসে বিশ্বকবি এসেছিলেন শিলং এর শৈলাবাসে অবকাশ যাপনের জন্য। সেই বার্তা পাওয়ার পরপরই সিলেটের মুরারি চাঁদ (এমসি) কলেজের অধ্যাপক সুরেশ চন্দ্র সেনগুপ্ত মুহুর্তে একটি আমন্ত্রণ বার্তা তৈরি করে নিলেন। তিনি পত্র যোগে আমন্ত্রণ বার্তা প্রেরণ করলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিকট। আমন্ত্রণ পত্রে তিনি লিখেছিলেন ‘ভারতের বরপুত্র শ্রীহট্ট ভ্রমণ করে তাকে গৌরবান্বিত করুন। প্রেরিত পত্রটি ছিল বৃহত্তর সিলেটের সর্বস্তর জনগণের হৃদয়ের আবেদন। পত্র পেয়ে রবী ঠাকুর স্ব-ইচ্ছায় বাংলা ১৩২৬সনের কার্তিক মাস এই গ্রাম বাঙলার শ্রীহট্টে রেল যোগে এসেছিলেন। ওই সময় কবির সফর সঙ্গী ছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগমনে ওই সময় সিলেটে আসার রেল পথের প্রতিটি আকাঁবাকাঁ রাস্তায় এই বাংলার মানুষের লোকারণ্য ছেয়ে পড়েছিল। আস্তে আস্তে কবি রেল যোগে শিলং থেকে গৌহাটি, লামডিং, বদরপুর, কুলাউড়া হয়ে সিলেটের মাটিতে পা রাখেন।
এদিকে, ভারতের বড় পুত্র বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভ্যর্থনা জানাতে সিলেটের কুলাউড়া, বরমচাল, ফেঞ্চুগঞ্জ ও মাইজগাঁও এর স্টেশনে কবির ভক্তবৃন্দরা উপচেয়ে পড়েন। বিশ্বকবির চরণাস্থাপনে এই বাংলার আপামর জনগন আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে গঠন করেন এমসি কলেজে সেবক সংঘ ও আনজুমানে ইসলামিয়া নামক স্বেচ্ছাসেবক দল। বিশ্বের খ্যাতিমান কবির অভ্যর্থনা জানাতে আয়োজিত সমিতির পক্ষ থেকে আসামের শিক্ষামন্ত্রী খান বাহাদুল আব্দুল মজিদ কাপ্তান মিয়াকে সভাপতি নির্বাচিত করেন অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে ভক্ত-অনুরাগীরা রবী ঠাকুরের জন্য সিলেট নগরীর নয়া সড়কের পাদ্রী বাংলো চোখ ধাঁ-ধাঁ-নো মনোরম রূপে সাজিয়ে তুলেন। বাংলার ১৩২৬সনের ১৩ই কার্তিক অর্থাৎ ইংরেজী ১৯১৯সনের ৫ নভেম্বর প্রভাত বেলার হীম শীতল বৈরী মৃদু হওয়ায় পাখিদের কলরবে ঘুমন্ত সিলেট বাসীকে জাগিয়ে তুলেন হর্ষধ্বনিতে কবি। রেল স্টেশনে এমনি বিকট হর্ষধ্বনি আর ঝক-ঝকাঝক- ঝক শব্দ শোনে সিলেটবাসী আনন্দের বন্যায় আত্মহারা হয়ে মেতে উঠে।
এ সময় সিলেটবাসী আতশবাজির আলোয় পুরো নগরীকে আলোকিত করে সাদরে বরণ করেন বিশ্বের শীর্ষ খ্যাতিমান বরপুত্র কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। সুরমা নদীর বুকে করে রাখা হয় সুসজ্জিত নৌকা। সেই সাথে সুরমা নদীর চাঁদনী ঘাটে সাড়ি বন্ধ সিঁড়িগুলো লাল সালুতে মোড়ান হয়েছিলো। সকাল ও বিকেলে রতনমনি লোকনাথ হল সাজানো হয়েছিলো কবির সংবর্ধনার জন্য। এ সময় কবির ভক্ত অনুরাগীরা মিছিলে মিছিলে ভরে দেয় মঞ্চস্থের প্রাঙ্গন। আস্তে আস্তে কবি প্রতিটি সুসজ্জিত স্থানে পদার্পন করতে থাকেন। এক পর্যায়ে চাঁদনী ঘাটের নৌকা ভিড়লে কবিকে ফুল-পত্র-পতাকা ও মঙ্গল ঘটের মধ্য দিয়ে অভ্যর্থনা জানান হয়।পরে তিনি ঘোড়ার গাড়িতে উঠে পড়েন।
পাঁচ নভেম্বর সন্ধ্যায় কবি ব্রাক্ষ্ম সমাজগৃহের প্রার্থনায় আসেন। প্রার্থনা শেষে নগরীর নয়াসড়কে পাদ্রীর বাংলোয় রাত্রিযাপন করেন। পরের দিন প্রভাতের আলোয় টাউন হলে হাজারো মানুষের মিছিলে মুখরিত মঞ্চে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঘটা করে নাগরিক সংবর্ধনা জানানো হয়। সংবর্ধনা শেষে কবিগুরু মঞ্চে উঠে উচ্ছ্বসিত সিলেটবাসীর উদ্দেশ্যে সারগর্ভ ভাষণ দেন। একই দিন সকালে শ্রীহট্ট মহিলা সমিতি ব্রাক্ষ্ম সমাজ গৃহে রবী ঠাকুরকে সংবর্ধনা জানানো হয়। পরদিন কবিগুরু নগরীর মাছিমপুরের মণিপুরী পল্লী ঘুরে দেখেন। পরিদর্শনকালে কবি শিল্পীদের মণিপুরী রাস লীলার নিত্য শৈলী দেখে মুগ্ধ হন।ওই দিন সন্ধ্যায় লোকারণ্য টাউন হলে এসে আবার কবি বক্তৃতা প্রদান করেন। তৎকালীন সময়ে তখন মাইকের কোন প্রচলন হয়নি। তবুও কবির ভক্ত অনুরাগীরা তাঁর প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ চয়ন শ্রবণ করেন। সর্বশেষ সিলেটে মারারি চাঁদ (এমসি) কলেজের ছাত্রাবাসে আয়োজিত অভ্যর্থনা মঞ্চে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সংবর্ধনা জানানো হয়। এমসি কলেজের বিভিন্ন সংগঠনের অভ্যর্থনা কমিটির উষ্ণতা পেয়ে আনন্দের সহিত কবি আকাক্সক্ষা স্বরূপ বক্তৃতা প্রদান করেন। ওই দিন কবি তিনদিন সফর শেষে কলকাতার পথে যাত্রা শুরু করেন পুনরায় রেল যোগে।
বিশ্বকবি এসেছিলেন তিন দিনের জন্য সিলেটের প্রকৃতি, সংস্কৃতি, নানা জাতি-বর্ণের মানুষের রূপ রেখার বৈচিত্র জানতে। কবির মন জয় করেছিল সিলেটের সর্বস্তরের মানুষ। কবিগুরু আসার সেই প্রথম চরণাস্থাপন আজও তাড়িয়ে বেড়ায় সিলেটের মানুষের গহীন হৃদয়ে। প্রতি বছরের ক্ষণে ক্ষণে বিশ্বকবিকে অনুসরণ করে এই বাংলার মানুষ। কবির জন্মদিন, মৃত্যুবার্ষিকী কিংবা বিভিন্ন স্মরণীয় দিবসগুলো পালন করে, ধারণ করে বৃহৎ পরিসরে। তাই তো ওরা পথে পথে তোমারি স্মরণে খোঁজে বেড়াই আরেকবার এই বাংলার শ্রীহট্ট ভূমিতে শত বর্ষের আগমনীর লগ্নে। যদিও কবির স্বরণীয় স্মৃতিময় স্থানগুলোর রূপ রেখার চিত্র একেবারে বদলে গেছে।
সুরমা নদীর চাঁদনী ঘাটের লাল সালুতে মোড়ান সিঁড়িগুলো এখন রূপ নিয়েছে ক্বীন ব্রীজে, রতনমনি লোকনাথ হল রূপ নিয়েছে সারদা হলে, পাদ্রীর বাংলো হয়ে উঠেছে উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আর যে মুরারি চাঁদ (এমসি) কলেজের আমন্ত্রণের বার্তা পেয়ে ছাত্রাবাসে এসে আকাক্সক্ষা স্বরূপ বক্তৃতা দিয়েছিল কবি সেই প্রাচীন এমসি কলেজের ছাত্রাবাস জামাত শিবির তাড়াতে গিয়ে আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত করে দিয়েছে ছাত্রলীগের অনুসারীরা। বর্তমানে পুরনো আদলে নতুন রূপ নিয়েছে এমসি কলেজের ছাত্রাবাস।
এদিকে বিশ্বকবির স্মরণীয় স্মৃতি ধরে রাখতে মাছিমপুরের মনিপুরী পল্লীতে স্থাপন করা হয়েছে কবির ভাস্কর্য।
দিন-কাল-ক্ষণ সবই পরিবর্তন হয়েছে সময়ের গতিতে। কিন্তু কবির সেই আগমনী বার্তা আজও একই ধারায় বয়ে চলেছে সিলেটবাসীর হৃদয়ে। সিলেটে বিশ্বকবির আগমনের শত বর্ষের স্মরণীয় উৎসবকে ঘিরে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। চলছে সাংস্কৃতি কর্মীদের দফায় দফায় মহড়া। আগামী ৭-৮ নভেম্বর দু'দিন ব্যাপী সিলেটে রবীন্দ্র শতবর্ষ স্মরণোৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর তাই এই স্মরণোৎসবকে ঘিরে সিলেট জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে আয়োজিত কমিটির আহ্বায়ক করে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদিও শুরুতে দল মতের দ্বন্দ্ব ছিল আয়োজিত কমিটিকে নিয়ে। তবে সেই দ্বন্দ্ব ভুলে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সিলেটবাসীকে আহ্বান জানান দিয়েছে কমিটির নেতৃবৃন্দরা।
এদিকে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীও বিভেদ ভুলে সম্প্রীতির বন্ধনে বেঁধে রাখতে সিলেট মহানগরীর সর্বস্তরের মানুষকে রবীন্দ্র আগমনের শতবর্ষ স্মরণ উৎসবে সকল বর্ণের মানুষদের আহ্বান জানান দিয়ে যাচ্ছেন। অপরদিকে, আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দরা একের পর এক প্রস্তুতি সভার আয়োজন করে যাচ্ছে রবীন্দ্র শতবর্ষ স্মরণোৎসবকে ঘিরে। আসছে ৭-৮ নভেম্বর মহাউৎসবের মধ্য দিয়ে দু'দিন ব্যাপী সিলেটে রবীন্দ্র শতবর্ষ স্মরণোৎসব সম্পন্ন হবে সর্ব স্তরের মানুষের মিলন মেলার মধ্য দিয়ে । এর পর আরেকবার কবির আগমনের স্মরণ উৎসবের জন্য অপেক্ষার ক্ষণ গুণবে নানা অঙ্গ সংগঠনের মানুষগুলো । কিন্তু একী পথ অনুসরন করবেন না সিলেটে আরেক কিংবদন্তী সঙ্গীত শিল্পী রানা কুমার সিনহা । তিনি বিশ্ব কবির রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গীতের সাধক । বিগত ৪৩বছর ধরে রবীন্দ্র সংগীতের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছেন । মাত্র ১৫জন ছাত্র নিয়ে সিলেটের ছোট বড় বিভিন্ন মঞ্চে রবীন্দ্র সঙ্গীতকে তুলে ধরেছেন তাঁরই ভরা গলায় । দীর্ঘ দিন রবীন্দ্র সঙ্গীতকে সিলেটের সর্বস্তরে প্রসারিত করে পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের আটটি অঞ্চলেও পরিবেশন করেছেন কবি গুরুর রবীন্দ্র সংগীত । আজ দুই দেশের গুণী শিল্পীরা তারই ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করেন শ্রীহট্ট ভূমি সিলেটে । শুধু নববর্ষে নয়।
কবির প্রতিটি মুহুর্ত, প্রতিটি ক্ষণ ধরে রাখতে নিত্যদিন সুর সংগীত সাধনা করে যাচ্ছেন নিজ গৃহে । দুই দেশের অগণিত ভক্তরা কিংবদন্তী এই গুণী শিল্পী ভরা কণ্ঠের সুরেলা রবীন্দ্র সংগীত শুনার জন্য মুখীয়ে থাকেন টিভি পর্দায় কিংবা সামাজিক মাধ্যমে ।
আনন্দলোকের পরিচালক রবীন্দ্র সাধক শিল্পী রানাকুমার সিনহা প্রতিবেদককে বলেন, ১৯৭৬সালে রবীন্দ্র সঙ্গীতের চর্চা শুরু করেছি । বর্তমানে সিলেট সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আমার ছাত্ররা রবীন্দ্র সঙ্গীতের এক একটি পর্যায়ে আছেন । কবির রবীন্দ্র সঙ্গীতের বিচারকের আসনে অনেকবার নতুন কুড়িসহ বিভিন্ন মঞ্চেও বিচারক হয়েছি । এছাড়া পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বড় বড় মঞ্চে রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন করার সুভাগ্য হয়েছে। কবিগুরুর প্রতিটি সংগীত আমি আমার পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে ভালোবাসি । তাই জীবনের শেষ সময়েও রবীন্দ্র সাধনায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাই।