গ্যাসের অবৈধ সংযোগ কোনো ভাবেই বন্ধ হচ্ছে না
স্বপ্না চক্রবর্তী, ঢাকা থেকে : আবাসিক খাতে নতুন করে গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকলেও শিল্প খাতে নতুন নতুন সংযোগ দেওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়তই। বেশিরভাগ শিল্প প্রতিষ্ঠানই সরকারী নিয়মনীতি মেনে গ্যাসের সংযোগ পেলেও অবৈধ গ্যাস সংযোগও কমানো যাচ্ছে কোনোভাবেই।
আবাসিকে নতুন ও সম্প্রসারিত স্থাপনাগুলোর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নানা কায়দায় অবৈধ সংযোগ নেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে শিল্পখাতে গ্যাসের প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণের সমীক্ষা চালানোর সিদ্ধান্ত জ্বালানি বিভাগ নিলেও আবাসিকের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেই কারও।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আবাসিকে গ্যাস সংযোগের ক্ষেত্রে সরকারের খাতায় না ওঠা এসব সংযোগের প্রতিটি চুলার বিল মাস শেষে নেওয়া হলেও তা কোথায় জমা হয় গ্রাহকরা নিজেও জানে না। এমন এলাকাও আছে যেখানে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়েছে পুরো এলাকার বিল এক চুক্তিতে। এলাকার নির্দিষ্ট লোকজন প্রতি মাসে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিল তুলে তা কোম্পানির লোকজনকে দেয়।
রাজধানীর মগবাজার এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভাড়াটিয়া জানান, বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় চুক্তিতে বিদ্যুৎ বিল, পানির বিলের কথা থাকলেও গ্যাসের বিলের কথা কোথাও লেখা ছিলো না। কিন্তু বছর শেষে হঠাৎ করে ভবনের কো-অপারেটিভ সোসাইটি থেকে একটা বড় পরিমাণের টোকেন ধরিয়ে দেওয়া হয় গ্যাস বিলের নামে। যদিও আমাদের কাছে কোনো বিলের কাগজ কখনো আসেনি তবুও সোসাইটির চাপে বাধ্য হয়ে একসাথে এতগুলো টাকা দিতে হয়। একই অভিযোগ করেন রাজধানীর হাতিরপুর এলাকার অপর বাসিন্দা রতন পাল।
তিনি বলেন, আমরা জানি নতুন ভবনগুলোতে প্রাকৃতিক গ্যাসের সংযোগ পাওয়া যাবে না। তাই এলপিজি দিয়েই কাজ চালানোর প্রস্তুতি নিয়েই নতুন একটি ভবনে বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম। কিন্তু কিছুদিন পরে দেখি বাড়িওয়ালা প্রাকৃতিক গ্যাসের লাইন সংযোগ দিয়ে দিয়েছে বাসায়। এতে করে আমাদের স্বস্তি হলেও সরকার একটা বড় রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে আমি মনে করি।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এসব সংযোগের কোনো তথ্য পেট্রোবাংলা কিংবা তিতাস গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানির কোনো পর্যায়ের নথিপত্রে নেই। ফলে গ্যাস সংযোগ বন্ধে সরকারের উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না। সংযোগ নেওয়ার চেষ্টায় কয়েকজন ভুক্তভোগী এবং সংযোগ নিয়েছেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে পাওয়া যায় আর তথ্য। সংযোগ দেওয়ার সময় তাদের আশ^স্থ করা হয়, তাদের নাম তিতাসের কম্পিউটারে রক্ষিত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে। সরকার গ্যাস সংযোগ আবার চালু করলে তাদের সিরিয়াল থাকবে এগিয়ে। যারা অবৈধ পন্থায় সংযোগ কিংবা সম্প্রসারণে ইচ্ছুক নন তারা দেখছেন তাদের চোখের সামনে বিভিন্ন ভবনে সরকারি লাইনের গ্যাসের চুলা জ্বলছে। তারা না পারছেন বৈধভাবে গ্যাস নিতে, না পারছেন প্রতিবেশীর এসব বিষয়ে কাউকে বলতে।
স্থানীয় ঠিকাদাররা বলছেন, এখন সব ধরনের সংযোগ বন্ধ, তবে জায়গামতো লোক থাকলে সব সম্ভব। যদি লোক না থাকে তাহলে তারা অন্যভাবে (অবৈধ) সংযোগ নিয়ে দিতে পারবেন তারা। কোনো সমস্যা হবে না, সবকিছু ঠিক থাকবে, কেবল টাস্কফোর্সের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। তিতাস গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানির লোকজন এসে সরকারি রেটে অতিরিক্ত চুলাগুলোর বিল নিয়ে যাবে। আর পুরনো চুলার বিল আগের মতোই গ্রাহককে গিয়ে ব্যাংকে জমা দিতে হবে। এই দুই প্রস্তাবের এক এলাকায় গ্যাস সংযোগ কিংবা সম্প্রসারণের জন্য প্রতি চুলার জন্য ৩৫ হাজার টাকা দাবি করেন ঠিকাদার। অন্য এলাকার ঠিকাদারের চাহিদা ৪৫ হাজার টাকা প্রতি চুলা।
অবৈধ সংযোগের ব্যবাপারে তিতাসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের যে জনবল তা দিয়ে সব জাযগায় নজর রাখা সম্ভব হয় না। তবে আমরা মাঝে মাঝে বিভিন্ন জায়গায় অবৈধ সংযোগের খবর পেলে কেটে দিয়ে আসি। আপনাদের কাছেও যদি কোনো তথ্য থাকে আমাদের জানাবেন। আমরা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেবো। তিনি জানান, গ্যাস সংযোগ বন্ধ সরকারি সিদ্ধান্ত। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী আর জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী কিংবা উপদেষ্টার নির্দেশ ছাড়া সংযোগ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
তবে এদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন খোদ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। তিনি বলেন, আমাদের নিজেদের কিছু অক্ষমতা আছে। তিতাস এবং এবং পেট্রোবংলার জনবল সংকটও এর একটা কারণ। তবে আশা করছি খুব শিগগীরই এসব অবৈধ সংযোগগুলো আর থাকবে না।
জানা যায়, সরকার ২০০৯ সালের ২১ জুলাই থেকে শিল্প এবং ২০১০ সালের ১৩ জুলাই থেকে আবাসিক গ্রাহকদের নতুন গ্যাস-সংযোগ দেয়া বন্ধ করে দেয়। এরপর ২০১৩ সালের ৭ মে থেকে কেবল আবাসিক সংযোগ দেওয়া হয় কিছুদিনের জন্য। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত আবাসিকে গ্যাস সংযোগ বন্ধ, তবে বিশেষ বিশেষ এলাকায় স্থাপিত শিল্পে সংযোগ দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে শিল্পখাতে গ্যাসের সংযোগ সহজ করাতে সমীক্ষা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। পেট্রোবাংলার মাধ্যমে এই জরিপ চালাতে ইতোমধ্যে জ্বালানি বিভাগ নির্দেশনাও দিয়েছে। এক্ষেত্রে হাইড্রোকার্বন ইউনিটের মাধ্যমে গ্যাস বিতরণ কোম্পানি থেকে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে জরিপ করার চিন্তা চলছে বলে জানিয়েছেন জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা। তারা জানান, এখন দেশের চাহিদা রযেছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে তিন হাজার ১০০ থেকে তিন হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।
তবে, লিকুফায়েড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বাড়লে গ্যাসের সরবরাহও বাড়ানো যেতে পারে। নতুন শিল্প মালিকরা প্রতিনিয়ত গ্যাস সংযোগ পাওয়ার আবেদন করছেন। কিন্তু ভবিষ্যতে শিল্পের জন্য কী পরিমাণ গ্যাসের প্রয়োজন, সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোনও ধারণা নেই কারও। ফলে, এখন যে সব শিল্প-সংযোগ দেওয়া হচ্ছে, তা পুরোপুরি অনুমাননির্ভর।