হঠাৎ ছন্দ পতন, বিবর্ণ নগরী
ছন্দের তালে তালে যে নগরী বয়ে চলেছিল বহুমাত্রায়, সেখানে এখন অনেকটাই নীরবতা। নেই কোনো হাক-ঢাক। নেই কোনো স্লোগান কিংবা ক্ষমতার দাপট। মনে হয় এ সময় সুন্দরী শ্রীভূম যেন সরলরেখায় অতিক্রম করে যাচ্ছে সর্বাঙ্গে।
গেল ৫ ডিসেম্বর সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিকী সম্মেলনের পর থেকেই শ্রীভূম শ্রীহট্টে উৎসুক নেতা-কর্মীদের হই-হুল্লা আর নেই বললেই চলে। যেভাবে আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিকী সম্মেলনের মঞ্চে উঠে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরান ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক সাধারন সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী কেঁদেছিলেন জনসম্মুখে তাঁর দলের জন্য। কিন্তু সেই কান্নার স্রোতেও তাদের জ্যেষ্ঠ নেতাবৃন্দরা দমে যাননি কর্তব্য রক্ষার্থে। দেশনেত্রী দায়িত্বর রক্ষার্থে। মূহুর্তে মঞ্চে উঠে কিছু সময় বক্তব্য দেওয়ার পর পরই বিশ মিনিটের সময় চেয়ে সিলেটে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের তিন বছর মেয়াদী নতুন এক কমিটির ঘোষণা দিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
তিনি ঘোষণায় বলেন, এবার সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এড. লুৎফুর রহমান ও সিলেট জেলার সাধারণ সম্পাদক এড. নাসির উদ্দিন খান। আর সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাশুক উদ্দিন আহমদ ও সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন। ঘোষণার মুহুর্তেই উপস্থিতি জনস্রোতের বদর ভাই, শফিক ভাই, আজাদ ভাই, আসাদ ভাইসহ প্রমুখ ভাইদের নামের স্লোগান নিমেষে মিলিয়ে গেল।
আওয়ামী লীগ ত্রি-বার্ষিকী সম্মেলনে সিলেট জেলা ও মহানগর কমিটি ঘোষণার পর হাতে গো্ণা কয়েকটি ছোট পরিসরে আনন্দ মিছিল বের করা হলেও আর কোন বৃহৎ কিংবা ক্ষুদ্র পরিসরে আনন্দ মিছিল অথবা শোভাযাত্রা দেখা যায়নি সিলেট নগরীতে।
কমিটি ঘোষণার পরেরদিন নবনির্বাচিত নেতৃবৃন্দ সাবেক সভাপতি ও সাধারন সম্পাদকদের বাসায় গিয়েছিল সহযোগীতার জন্য। তারা সহযোগীতার আশ্বাসও দেন। কিন্তু সেই আশ্বাসের বাচনভঙ্গিতে ছিলো না কোনো আনন্দের আভাস। মনের গহীন যত দুঃখ-যন্ত্রণা সিলেটের জ্যেষ্ঠ আওয়ামী লীগের নেতাদের চোখে মুখে ফুটে উঠেছে।
কমিটি ঘোষণা আগ মুহুর্ত পর্যন্ত সিলেটের প্রভাবশালী নেতাকর্মীদের যে ঝড়ো হাওয়া ছিল বিস্তরভাবে পুরো নগর জুড়ে। আজ সেই নগরের চিত্র অন্য রকম। মনে হয় কোন এক বিবর্ণ অচেনা নগরী।
কিছ দিন আগেও আজাদ গ্রুপ, রঞ্জিত গ্রুপ, বদর ভাই, আসাদ ভাই ছাড়া আরও বেশ কিছু ভাইদের নেতাকর্মীরা প্রভাব খাতিয়ে উত্তপ্ত করে রাখত সিলেট নগরীর জিন্দাবাজার, টিলাগড়, মাছিমপুর, আম্বরখানা, সুবিদবাজার, লামাবাজার, মিরের ময়দান, জল্লারপার, শাহী ঈদগাঁ ছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ওই প্রভাবশালী নেতাকর্মীদের আনাগোনা কম দেখা যায় সিলেট নগরীতে।
এসব বিষয়ে নবনির্বাচিত সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এড. নাসির উদ্দিন খান বলেন, সিলেটে নিজের নামে কোন গ্রুপ নেই। এক সময় আমি জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। সেই সুবাদে অনেকে আমার অনুসারী হতে পারে। ছাত্র রাজনীতি ছেড়েছি প্রায় বিশ বছর আগে। তাই ছাত্র রাজনীতির কোন কর্মসূচিতে যাওয়া হয় না। বর্তমানে আমি গণরাজনীতি করি।দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাসহ কেন্দ্রীয় নেতারা আমার উপর যে আস্থা রেখেছেন তার মূল্যায়ন আমি আমার কাজের মাধ্যমে প্রমাণ দিতে চাই। আশা করি আগামীর পথগুলোতে আপনাদের সবার সহযোগীতা পাবো।
এদিকে বিগত তিন দশক ধরে সিলেটে আওয়ামী লীগের শক্ত হাতে হাল ধরেছিলেন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। তিনি ১৯৭৩ সালে ওয়ার্ড কমিশনার হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮৯, ১৯৯২ ও ১৯৯৭ সালে সিলেট নগরীর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০০২, ২০০৫ ও ২০১১সালে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে। এছাড়া তিনি সিলেট সিটি কর্পোরেশনে দুইবার মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন।
তিনি নবগঠিত সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটিকে অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে।
এদিকে সাধারনকর্মীদের অভিযোগ, সিলেট আওয়ামী লীগের বহুল প্রত্যাশীত নেতাদের কোনো স্থান হলো না কমিটিতে। এমনকি তিন দশক ধরে যিনি শক্ত হাত দিয়ে মাঠ চষে বেড়িয়েছিলেন তারও রক্ষা হলো না। সিলেট আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিকী সম্মেলনে মঞ্চে সিলেটের বড় বড় গুণী নেতারা তাদের কথার ফুল ঝুঁড়ি আর চোখ ভেজা জল দিয়েও তাদের নিজ নিজ অবস্থানকে ধরে রাখতে পারেনি। মন গলেনি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাবৃন্দদের।
দেশের হয়ে দলকে শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তুলতে সিলেটের স্থানীয় নেতাদেরকে শাসিয়ে গেলেন ত্রি বার্ষিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা।
অপরদিকে সিলেট আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক কমিটির নেতৃবৃন্দদের নিয়ে সোমবার নগরীর রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির দপ্তরে আওয়ামী লীগের প্রথম সভা আয়োজন করেন নবনির্বাচিত সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মাশুক উদ্দিন আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন।
সভায় তিনি সকল সাবেকদের সহযোগীতা কামনা করেন। এ সময় সভায় ৩৬ জন কাউন্সিল অংশ গ্রহন করেন। সাবেকদের মধ্যে উপস্থিতি ছিলেন - সাবেক সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরান, সাবেক সহ সভাপতি এডভোকেট রাজ উদ্দিন আহমদ, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালিক, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল আনোয়ার আলোয়ার, সাবেক শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ, বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক জগদীশ চন্দ্র দাশ, আজহার উদ্দিন জাহাঙ্গীর প্রমুখ।
বৈঠকে সাবেকেরা নতুন কমিটিকে অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এ প্রসঙ্গে নব নির্বাচিত সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মাশুক উদ্দিন বলেন, এমনি প্রস্তাব পেয়ে আমি প্রথমে বিস্মিত হয়ে যাই। আরও কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলি। তারা সকলেই জানান দলের নেত্রী এমন নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর আমার ছোট ভাই মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদের সাথে পরামর্শ করি। সেও নেত্রীর নির্দেশ মেনে মহানগরের সভাপতি পদে মনোনয়ন জমা দেওয়ার পরামর্শ দেয়। সকলের সঙ্গে পরামর্শ করে, একেবারে শেষ মুহূর্তে, সবাই মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার প্রায় আধঘণ্টা পর আমি মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে মনোনয়নপত্র জমা দেই। এরপর সভাপতি পদে আমার নাম ঘোষণা করা হয়। মহানগরের রাজনীতিতে নতুন হলেও এখানকার সকল নেতাকর্মীরাই আমাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে নিয়েছেন। সবাই আমার বাসায় এসে আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। মহানগর আওয়ামী লীগকে আরও সুশৃঙ্খল এবং সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্য আমার। আমাদের নেত্রী চাচ্ছেন স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মানুষের হাতে নেতৃত্ব তুলে দিতে। দল থেকে অপরাধীদের ছাটাই করতে। আমিও সে লক্ষ্যে কাজ করবো। আওয়ামী লীগ ছাড়াও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনেরও ভাবমূর্তি ফেরাতে আমি কাজ করবো।