নির্ধারিত তারিখের আগেই সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রার উৎপাদন শুরু
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের বেঁধে দেয়া তারিখের আগেই উৎপাদন শুরু করেছে দেশের সর্ববৃহৎ কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
আজ সোমবার (১৩ জানুয়ারি) সকাল ১১টায় কেন্দ্রটিকে জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে সিনক্রোনাইজিং বা সংযুক্ত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুধাবি থেকে দেশে ফেরার পর পরই বিদ্যুতকেন্দ্রটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের দিনক্ষণ ঠিক করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
এরই মধ্যে এই কেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। আগামী ২৭ জানুয়ারি কেন্দ্রটি প্রথম ইউনিটের ৬৬০ মেগাওয়াট পূর্ণ ক্ষমতায় চালানো হবে। এছাড়া ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সমান দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদন শুরু করবে আগামী মে মাসে।
এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় জানায়, প্রাথমিকভাবে পায়রা কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন শুরুর পাশাপশি জাতীয় গ্রীডে ১০০ মেগাওয়াট লোডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। ক্রমান্বয়ে কেন্দ্রটি থেকে উৎপাদনের পরিমাণ আরও বাড়ানো হবে।
প্রকল্প পরিচালক শাহ আব্দুল মাওলা বলেন, সোমবার আমরা বেশ কিছুক্ষণ কেন্দ্রর প্রথম ইউনিট চালানো হয়েছে। শুরুতে ৬০ মেগাওয়াট উৎপাদন হলেও আস্তে আস্তে উৎপাদন বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমরা সারা দিনই ১২০ মেগাওয়াট উৎপাদন করেছি। এর মধ্যে কেন্দ্রটির নিজস্ব ব্যবহার বাদে ১০০ মেগাওয়াট জাতীয় গ্রিডে সরবরা করা হয়েছে। আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে ক্রমান্বয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করা হবে। প্রতিদিন অল্প অল্প করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। এরপর বাড়ানো হবে। পাশাপাশি যন্ত্রপাতিগুলোও চলবে এই মাসজুড়েই। চাইলে এই পর্যায়ে একাবের উৎপাদন করা যায় না। ধীরে ধীরে উৎপাদন বাড়াতে হয়।
তিনি বলেন, আমরা আশা করছি আগামী ২৭ জানুয়ারি গ্রিডে আমরা ৬৬০ মেগাওয়াটই সরবরাহ করতে পারবো। এ জন্য অনেক ধরনের পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ রয়েছে। আশা করছি আগামী মাস ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে আমরা কেন্দ্রটির প্রাথমিক বাণিজ্যিক অপারেশনের দিন নির্ধারণ করতে পারবো।
বিদ্যুত বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলে পায়রার উদ্বোধনের তারিখ ঘোষনা করা হবে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী পায়রা গিয়ে কেন্দ্রটি উদ্বোধনের বিষয়ে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এর আগেও পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র এলাকায় ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য নির্মিত আবাসন প্রকল্প উদ্বোধন করতে যান প্রধানমন্ত্রী।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, তিন বছর নয় মাস ২৩ দিন পেরিয়ে গতকাল আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রায় ১০ হাজার চীন এবং বাংলাদেশী শ্রমিক ও প্রকৌশলীর দিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রম। ২ দশমিক চার বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে নতুন এক ইতিহাসের সূচনাকে দেশের বিদ্যুৎ খাতের অন্যতম বড় অর্জন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কেন্দ্রটির সমান অংশিদার চীন এবং বাংলাদেশ। চীনের এক্সিম ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছে। সরকার যেসব মেগা প্রকল্প নির্মাণ করছে তার মধ্যে পায়রা অন্যতম। সরকারের অগ্রাধিকার ১০ মেগা প্রকল্পর বাইরে থাকলেও পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে সুপার ফাস্ট তকমা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ ব্যাপারে এর আগে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, কেন্দ্রটি উৎপাদনে আসায় অন্তত এক হাজার ৩০০ মেগাওয়াট তেল চালিত বিদ্যুত কেন্দ্রর উৎপাদন কমানো যাবে। এতে করে বিদ্যুৎ খাতে বিপুল পরিমান সাশ্রয় হবে বলে আমরা আশা করছি। এখন তেল চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে ফার্নেস তেলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ১৩ শমিক ৬২ টাকা এবং ডিজেলে ২৭শমিক ২১ টাকায় উৎপাদন করা হয়। এর বিপরীতে পায়রার উৎপাদন খরচ থাকবে সাড়ে ছয়টাকার নিচে। ফলে প্রতি বছর বিদ্যুৎ খাতে বিপুল পরিমান সাশ্রয় হবে।
তিনি বলেন, সরকার প্রথম মেয়াদে দায়িত্ব নেয়ার পর বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদনের সঙ্গে ব্যয় সাশ্রয়ের উদ্যোগ নেয়। এজন্য বিদ্যুত উৎপাদনে মিশ্র জ¦ালনি ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়। সেই উদ্যোগের প্রথম বাস্তবায়ন হলো পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
জানা যায়, দেশের দক্ষিন পশ্চিম এবং উত্তরা লের বিদ্যুত কেন্দ্র দিয়ে মধ্যভাগের চাহিদা মেটানোর জন্য বিদ্যুৎ সঞ্চালনে এক্সপ্রেস ওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। পায়রা-রামপাল-রূপপুরের বিদ্যুৎ নেয়া হবে গোপালগঞ্জে। সেখান থেকে ঢাকাতে বিদ্যুত সঞ্চালন করা হবে। জিরো লোডশেডিং আওয়ার বা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য এই মেগা প্রকল্পটির কাজ শুরু করেছে।
জানা যায়, গত ২০১৪ সালের ৯ জুন চীনের ন্যাশনাল মেশিনারি এক্সপোর্ট এন্ড ইমপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি) এর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (এনডব্লিউপিজিসিএল) বাংলাদেশে একটি এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য সমঝোতা স্মারক সই করে। এরপর সমঝোতা স্মারক, যৌথ মূলধনী কোম্পানি গঠন আর ক্রোড়পত্র আহ্বানের পর ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ কেন্দ্রটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। চীনের আরেক প্রতিষ্ঠান এনইপিসি কেন্দ্রটির ঠিকাদার নিযুক্ত হয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির আর্থিক সংস্থানের আগেই ঠিকাদারকে ২০ ভাগ অর্থ ব্যয়ের শর্ত দেয়া হয়। এতে করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির চুক্তি সইর পরের দিন থেকেই কেন্দ্র নির্মাণ শুরু করে এনইপিসি। যাতে কেন্দ্রটির কাজ দ্রুততার সাথে শেষ হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
কেন্দ্রটি নির্মাণে বিসিপিসিএল সর্বাধুনিক আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এছাড়া একই সঙ্গে পরিবেশ রক্ষায় সব ধরনের সতর্কতা মেনে চলা হচ্ছে।
প্রতিবেশীদেশ ভারত এবং চীন কোন কোন ক্ষেত্রে কয়লা চালিত কেন্দ্রে উন্মুক্ত অবস্থায় কয়লা রেখে দিলেও পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র কয়লা রাখার জন্য যে কোল ইয়ার্ড নির্মাণ করেছে তা পুরোপুরি ঢাকনা যুক্ত। জাহাজ থেকে কয়লা ওঠার সময়ও ঢাকানা যুক্ত কনভেয়ার বেল্টে আনা হবে। প্রতিটি এক লাখ ৮০ হাজার টন ধরান ক্ষমতার চারটি কোল ইয়ার্ড নির্মাণ করা হচ্ছে। যা দিয়ে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ৫৭ দিনের কয়লা মজুদ রাখতে পারবে। নির্গত গ্যাস ধরতে ফ্লু গ্যাস ডিসালফারাইজার ইউনিট (এফজিডি) নির্মাণ করা হচ্ছে।
এর মাধ্যমে কেন্দ্রটির ৯৬ ভাগ ফ্লু গ্যাস ধরা হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর ৯৯ শমিক ৯ ভাগ ছাই ‘এ্যাশ হপারে’ ধরা হবে। এর বাইরেও কেন্দ্রটির ২২০ মিটার উচ্চতার চিমনী নির্মাণ করা হয়েছে । প্রায় ৭৫ তলা ভবনের সমান উঁচু চিমনী দিয়ে বাতাসের নির্দিষ্ট স্তরে ধোয়া ছাড়ার ফলে দূষন নিয়ন্ত্রিত মাত্রার মধ্যেই থাকবে।