করোনায় অচেনা ঢাকা
বাংলামোটর থেকে পল্টন মোড়ে বিআরটিসির বাসে করে যেতে সময় লাগলো মাত্র ১৪ মিনিট। দোতালা বাসটিতে যাত্রী সব মিলিয়ে ২০ জনের মতো। এর অর্ধেকের মুখেই কাপড়ের তৈরি মাস্ক। দুই একজন যাও সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার করছেন, কিন্তু নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় মুখ থেকে খুলে ফেলছেন। পাশাপাশি সিটে বসা যাত্রী নেই কেউই।
অন্য যেকোনো সময় বৃহস্পতিবারের চিত্রটা রাজধানীবাসীর কাছে ভয়াবহ। রাস্তায় তীব্র যানজট আর লোকারণ্যে তিল ধারণের জায়গা থাকে না রাজধানীর কেন্দ্রস্থলগুলোতে।
কিন্তু বৃহস্পতিবারের রাজধানীর দৃশ্যটা যেনো আগে কখনো দেখে নি নগরবাসী। ফার্মগেট মোড় থেকে থেমে থেমে যাও দুই একটা গণ-পরিবহণ চলছে তাতেও যাত্রী হাতে গোণা। মাস্ক পরিহিত বা মাস্ক ছাড়া কেউই কারো সাথে কথা পর্যন্ত বলছে না। পরিচিতরা কুশল বিনিময় করতে পর্যন্ত ভয়ে কুকড়ে যাচ্ছেন।
সারাবিশ্বব্যাপী আতঙ্ক তৈরি করা করোনা ভাইরাসের প্রভাবে রাজধানীর এ চিত্র সম্পূর্ণ নতুন।
এর আগে কোনো ঈদ বা সামাজিক অনুষ্ঠানের দিনও এরকম অবস্থা তৈরি হয়নি বলে মন্তব্য করেন বিকল্প পরিবহনে মতিঝিল থেকে মিরপুরের যাত্রী শহিদুল ইসলাম। বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত শহিদুল বলেন, মতিঝিলে অফিস হওয়ায় নিত্য যাত্রার পথ আমার এটি। বৃহস্পতিবার মানে আমাদের জন্য আতঙ্কের দিন। অফিস শেষে বাসে করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে তীব্র জ্যামের কারণে রাত ৯টা বাজা খুবই স্বাভাবিক ব্যপার। কিন্তু এক ভাইরাসের প্রভাবে রাজধানী ফাঁকা। মাত্র ২০ মিনিটে আগারগাঁও পৌছে গেছি। যা এর আগে কোনোদিন সম্ভব হয়নি।
থমথমে অবস্থা দেখা গেছে অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা কমলাপুর রেলস্টেশনেও। সাপ্তাহিক ছুটির আগের দিন বৃহস্পতিবার যেখানে থাকে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় সেখানে গতকাল দেখা যায় হাতে গোনা কয়েকজন যাত্রী। তবে স্টেশন কর্তৃপক্ষ এসব যাত্রীদের স্যানিটাইজারের ব্যবস্থায় নিয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ প্রয়োজনীয় স্যানিটাইজার সামগ্রী দিয়ে যাত্রীদের যতটুকু সম্ভব নিরাদ রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
করোনা আতঙ্কে ফাঁকা হয়েছে রাজধানীর ব্যস্ত শপিংমলগুলোও। কেনাকাটার জন্য রাজধানীবাসীর অন্যতম পছন্দের জায়গা নিউমার্কেটে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত যেনো কোনো মড়ক লেগেছে। ক্রেতা তো নেই-ই বিক্রেতারা তঠস্থ আছেন কখন কোন ভাবে আক্রান্ত হয়ে যান করোনা ভাইরাসে। একই অবস্থা মৌচাক মার্কেটেরও। খুবই জরুরী প্রয়োজনীয় কেনাকাটা ছাড়া কেউই আসছেন না শপিং সেন্টারগুলোতে। মগবাজার থেকে জন্মদিনের গিফট কিনতে আসা সালমা আকতার বলেন, প্রায় দুই মাস আগে দাওয়াত নেওয়া ছিলো। এমন অবস্থায় না গেলে হয় না আবার যেতে হলে উপহারসামগ্রীও তো কিনতে হবে। তাই বাধ্য হয়েই আসতে হয়েছে।
এসব শপিং সেন্টারগুলোতে স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা তো নেইই নেই ন্যূনতম সতর্ক ব্যবস্থাও। তবে কিছুটা ভিন্ন চিত্র রয়েছে বসুন্ধরা সিটি এবং যমুনা ফিউচার পার্কের মতো বড়ো শপিং সেন্টারগুলোতে। এগুলোর গেইটেই ক্রেতাদের প্রবেশের সময় হাতে করে হ্যান্ডস্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিস্কার করিয়ে দিচ্ছেন নিরাপত্তা কর্মীরা।
সরকারের ব্যাপক প্রচারণার ফলেই দেশের লোকজন সচেতনতার অংশ হিসেবে ঘরে অবস্থান করছে মন্তব্য করে নগরবাসীর এ সচেতনাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ।
তিনি বলেন, দেরিতে হলেও লোকজন করোনার ভয়াবহতা বুঝতে পারছে। আমরা বার বার বলছি একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হবেন না। ঘরে পৌঁছেই হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিস্কার করবেন। হাঁচি-কাঁশিতে শিষ্টাচার অবলম্বন করতে হবে। মাছ-মাংসসহ যেকোনো খাবার খুব ভালো করে সিদ্ধ করে খেতে হবে। গৃহপালিত পশু-পাখি একটু দুর্বল হলে সেগুলোকে আলাদা করে রাখতে হবে।
তবে সরকারকে করোনা প্রতিরোধে আরও কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সনাল।
তিনি বলেন, ইতালি শুরুতে এই রোগটির ভয়াবহতা বুঝতে না পারায় আজকে তা মহামারী রূপ ধারণ করেছে। আমরা দেখছি এখনো দেশে প্রবাসীরা ফিরছেন। যা আমাদের নিজেদের জন্য খুবই আতঙ্কের। তাই আমি সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি ইতালির মতো ভয়াবহতার হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে আরও কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনই।