ওনার চোখে যে আনন্দের অশ্রুটুকু দেখেছি ওইটুকুই আমার প্রাপ্তি
কাজী মুহা: আফিফুজ্জামান: ওনার চোখে যে আনন্দের অশ্রুটুকু দেখেছি ওইটুকুই আমার প্রাপ্তি। এই তৃপ্তির সাথে অন্য কিছুর তুলনা হয় না। অপরিচিত এক বৃদ্ধ'র ফোনকল পেয়ে তাকে উপহার সামগ্রী পৌঁছে দিয়ে ফেসবুক ওয়ালে এভাবেই নিজের প্রতিক্রিয়া জানান এক র্যাব কর্মকর্তা।
এডিশনাল পুলিশ পদমর্যাদার ওই র্যাব কর্মকর্তার নাম মনির জামান। র্যাব-২ এ আগারগাঁও কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। সম্প্রতি সিলেট অঞ্চলের র্যাব-৯ এ প্রায় তিন বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। তার ফেসবুক ওয়ালে গিয়ে দেখা গেছে অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর অসংখ্য নজির। পাশাপাশি করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় সাধারণ মানুষ ও চিকিৎসকদের উদ্বুদ্ধ করতে দেখা গেছে।
সম্প্রতি নিজের ফেসবুক ওয়ালে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অনুভূতির কথা জানিয়েছেন। পাশাপাশি সামর্থ্যবান সবাইকে দাঁড়ানোর বিনীত অনুরোধ জানিয়েছেন। ফেসবুক ওয়ালে বৃদ্ধকে সহযোগিতার একটি ছবি পোস্ট করেছেন। তবে মুখ ঢেকে দেয়া হয়েছে ওই মধ্যবৃত্ত বৃদ্ধের। এডিশনাল পুলিশ সুপার মনির জামানের ফেসবুকের পোষ্টটি এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো-
উপহার ও মধ্যবিত্ত
আজ সকাল সকাল কেন যেন ঘুমটা ভেঙে গেল। বাসায় কেউ উঠেনি এখনো, কী আর করা। কিছুক্ষণ পেপার পড়লাম, কিছুক্ষণ মোবাইল দেখলাম। প্রায় এক ঘন্টা দেড় ঘন্টা যাওয়ার পর বেশ ক্ষুধা অনুভব করলাম। ছোটবেলা থেকে আমার সমস্যা আমি ক্ষুধা সহ্য করতে পারি না। ক্ষুধা লাগলে আমার কিছু না কিছু খেতেই হবে। যা হোক না¯Íা করে চা খাচ্ছি হঠাৎ করে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে আমার সরকারি নম্বরে কল আসে। আমি ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে একজন বৃদ্ধ মানুষই বলে মনে হলো বললেন, "স্যার কেমন আছেন। আমি খুব অসুবিধার মধ্যে আছি। আমাকে কি আপনি একটু সাহায্য করতে পারবেন।" কোত্থেকে বলছেন জিজ্ঞেস করায় উনি অমুক জায়গার নাম বললেন। আরো জানালেন যে ওনার কিডনিজনিত সমস্যার কারণে পা দুটো ফুলে গিয়েছে। ওনারা তিনজন বয়স্ক মানুষ একটি রুমে থাকেন। লকডাউনের কারণে কেউ বের হতে পারছেন না ফলে খাবারের ব্যবস্থাও হচ্ছে না। আর তাছাড়া মধ্যবিত্ত হওয়ার জন্যে সবাইকে কিছু বলতেও পারছেন না। তাদের কাছে যে খাদ্য-রসদ ছিল ফুরিয়ে গেছে। আজ তাদের ঘরে কোনো খাবার নেই। আমার কেমন যেন লাগলো। ঝিম মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। কিছুক্ষণ আগে ক্ষুধার জ্বালায় নাস্তা করলাম আমিই। এই নাস্তা খাওয়ার পরপরই এই ফোনটা আসার কারণ কী। আমার কেন যেন মনে হল যে মহান আল্লাহর কুদরতি নির্দেশে হয়তো এই ব্যক্তিটি আমাকে ফোন দিয়েছেন। আল্রাহ্তায়ালা নাকি বিভিন্নভাবে মানুষকে পরীক্ষা করেন শুনেছি। আল্লাহ্ হয়তো ভেবেছেন, দেখি তো কিছুক্ষণ আগে তো ক্ষুধার জ্বালায় নিজেই খাবার খাইছিস আর এখন আমার আরেক বান্দার ক্ষুধা উপলব্ধি করতে পারিস কি না। চিন্তা করলাম, নাহ্, পরীক্ষায় পাস করতেই হবে। ওনাকে বললাম আপনাকে আমি কিছুক্ষণ পর কল দিচ্ছি। ঘন্টা দুয়েক পরে বাসা থেকে বের হয়ে তিনজনের জন্য ত্রাণ কিনলাম, না না আমার মতে এটাকে আসলে ত্রাণসামগ্রী বলাই ঠিক না বরং 'উপহারসামগ্রী' বলা যেতে পারে। ত্রাণ শব্দটাই কেমন যেন। যা হোক সামান্য কিছু উপহারসামগ্রী তিনটি ব্যাগে ভরে ঐ ভদ্রলোককে কল করে তাঁর বাসায় পৌঁছলাম। তাঁর বসবাসের জায়গাটাও একেবারে খুব যে কাছে তা না। মোহাম্মদপুর থেকে একেবারে পশ্চিম পাশে যে এলাকাটা আছে ওখানে উনি থাকেন। ওখানে পৌঁছাটাও খানিকটা কষ্টসাধ্য ছিল। ক্ষুদ্র উপহারটুকু পেয়ে উনি আসলে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে উনার একটি ফোনেই কেউ এগুলো ওনার বাসায় পৌঁছে দেবে। ওনার চোখে যে আনন্দের অশ্রুটুকু দেখেছি ওইটুকুই আমার প্রাপ্তি। এই তৃপ্তির সাথে অন্য কিছুর তুলনা হয়না। ওনাকে বললাম যে আমি একজন সামান্য সরকারী কর্মচারী। আমার বেতনের টাকা দিয়ে আমি আপনাদের জন্য এই সামান্য উপহারটুকুই আনতে পেরেছি। এটি দিযয় হয়তো বা আপনাদের এক মাস দু'মাস যাবে না তবে কিছুদিন হয়তো চলবে। তাদের অশ্রুর বন্যা দেখতে দেখতে বের হয়ে আসলাম। আমার কাছে সরকারি নম্বরটা থাকার কারণে হয়তো উনি আমার নম্বরে কল করতে পেরেছেন; না হলে তো পারতেন না। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই যে অসহায় মানুষজন তাদের অসহায়ত্বের কথা বলার জন্য আমার পর্যন্ত কমপক্ষে পৌঁছাতে তো পারেন। আপনাদের কাছে বিনীত অনুরোধ আপনাদের যাদের সামর্থ্য আছে তারা দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে আমাদের এই অসহায় মানুষগুলোর পাশে দয়া করে দাঁড়ান।