দুঃসহই তাদের জীবন, করোনা যেন খড়ার ঘা
বেঁচে থাকা কারো কাছে সারাজীবনই সংগ্রাম, কারো কাছে প্রতীক্ষা। এমন অনেকেই আছেন, জন্মগতভাবেই জীবন কারো কাছে দুঃসহ। প্রতিক্ষণে সংগ্রাম করে যাদের জীবন টেনে নিতে হয়। তারা ঘুঁরেও দাড়ায় চেষ্টা ও সহযোগিতায়। কিন্তু মহামারি করোনায় থমকে গেছে সব।
শৈশব থেকে হোঁচট খেয়ে খেয়ে ঘা হয়ে আছে পুরো অন্তর। স্বজন ছাড়াই আপন গতিতে পথচলা। তবুও ওরা নিজ জন্মকে স্বার্থক মনে করে, মানব দৃষ্টিভঙ্গির কাছে হার মানেনি।
জীবন যুদ্ধে একাগ্রচিত্তে ঘুঁরে দাড়ানোর প্রয়াসে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে শ্রীহট্টের কিছু সংখ্যক বৃহন্নলা। কিন্তু চলতি পথে হঠাৎ খড়ার ঘা হয়ে দাঁড়ালো করোনাভাইরাস। স্বচ্ছতা ফিরে পেতে না পেতেই আয়-রোজগারের পথগুলো সবই বন্ধ হলো।
স্বজন ছেড়ে ভাড়াবাড়িতে থেকে অসহনীয় যন্ত্রণায় মানবেতর জীবনযাপন করে চলছে। একদিকে বাড়িওয়ালার ভাড়ার তদারকি, অপরদিকে পেটের যন্ত্রণা। এমনি পরিস্থিতিতে নাজেহাল হয়ে উঠেছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলো। মহামারি করোনা পরিস্থিতিতেও কোনো স্বজন এগিয়ে আসেনা ওদের দুয়ারে। মুখ বুজে সব অসহনীয় দুঃখ-কষ্ট মাথা পেতে নিচ্ছে এই বৃহন্নলারা বেঁচে থাকার তাগিদে। করুণ এই দুঃসময়ে মানবরূপে দেবদূত কখন ওদের দুয়ারে আগমণ করবে এমনি প্রতীক্ষায় প্রহর গুণে যাচ্ছে তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেটে প্রায় সাড়ে ৫শ’ তৃতীয় লিঙ্গ বৃহন্নলা রয়েছে। তার মধ্যে প্রায় ১০ বৃহন্নলা নিজের ইচ্ছেশক্তি ও কিছু সুহৃদয়বান মানুষের সহযোগিতায় স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু করোনায় লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল তাদের জীবনযাত্রা। অস্থিতিশীল এই পরিস্থিতিতে দুঃসহ জীবন পার করছেন তারা।
এমনি করুণ পরিস্থিতিতে তাদের সাথে আলাপচারিতা হয় নিউ ইয়র্ক মেইলের প্রতিবেদকের। সুপ্তা হিজড়া (৩০) বলেন, নিজ ইচ্ছার তাগিদে হিজড়াদের জন্য একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলাম। এর পর থেকে সুহৃদয়বান ব্যক্তিরা ৮টি ভ্যান গাড়ি দিয়েছিল সংগঠনের হিজড়াদের। তার মধ্যে একটি ভ্যান গাড়ি আমার ছিল। ভ্যান গাড়িতে চটপটি-ফুসকার ব্যবসা শুরু করতাম। আমার জমানো ১০ হাজার টাকা খরচ করে দুই জন কর্মচারি হিজরাদের রাখা হয়। প্রায় দুই বছর ধরে ব্যবসাও বেশ ভালই চলছিল। প্রথম পর্যায়ে সাধারণ মানুষ আমাদের সহজভাবে গ্রহণ না করলেও পরবর্তীতে এই ব্যবসা বেশ জমজমাট হয়ে উঠে। কর্মচারীদের জনপ্রতি আড়াই হাজার টাকা দেওয়ার পর অবশিষ্ট প্রায় ৩ হাজার টাকা আমার পুঁজি হতো ওই ভ্যান গাড়ির ব্যবসা থেকে। কিন্তু এখন সেই রোজগারের পথ বন্ধ করোনার কারণে।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাস আসার পর থেকে সিলেটে নিন্ম ও মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ীরা যেভাবে আয়- রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে আছে। আমাদেরও একই দশা। কিন্তু ওদের পাশে হাত বাড়ানোর স্বজন আছে। আমাদের নেই। স্বজন ছাড়াই আমাদের জীবনযাপন।
সিলেট শহরের কদমতলীতে ভাড়া বাসায় থাকেন তিনি। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ছোটখাটো একটা চাকরিও করি। কিন্তু ওই বেতনের টাকা দিয়ে হিজড়া বোনদের খরচপাতি দেওয়ার পর হাতে আর কিছুই থাকে না।
তিনি বলেন, আমি যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছি সেই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ১৪শ’ টাকার মতো খাদ্য সামগ্রী দিয়েছিল করোনার প্রথম পর্যায়ে। এছাড়া অন্য কেউ আমাদের সহযোগীতা করেনি। কিন্তু ওই খাদ্য সামগ্রী তো অনেক আগেই শেষ । এখন কিভাবে চলবো।
কান্না জড়িত কণ্ঠে সুপ্তা বলেন, মাত্র ১০/১১ বছর বয়সে আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে আসি। আমাদের পাঁচ ভাইবোন। আমার জন্য বড় বোনদের বিয়ে হচ্ছিল না। বোনের বিয়ে ঠিক করতে এসে আমাকে দেখে বিয়ে ভেঙে যায়। এজন্য মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বজনরা আমাকে সব সময় কটু কথা শুনাতো। আমার বাবা - মা আমাকে ওদের সন্তান বলতে লজ্জা পায়। আমার জন্য নাকি সমাজে ওরা মুখ দেখাতে পারে না । তাই ওরা সবাই মিলে আমাকে বলেছিল, তুই হয় মরে যা, না হয় চলে যা । তখন আমার খুব কষ্ট হয়েছিলো। তারপর আমি চিন্তা করলাম মরবো কেন ? মরে গেলে তো সবই শেষ। আর তো কিছুই দেখতে পাবনা। তাই মরার কথা না ভেবে বাঁচার আশায় আমার ছোটবেলার এক বান্ধবীর কাছে আশ্রয় নেয়। ওর সহযোগিতায় আমি খানিকটাও পড়ালেখাও করেছি । কিন্তু বান্ধবীও আমার মতো। ও আমার জন্য নাইট ডিউটিতেও যেতো । ওর উপার্জনের টাকা দিয়ে আমি পড়াশোনাও করেছি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। কিন্তু বান্ধবী কষ্ট দেখে আমারও খুবই কষ্ট হয়েছিলো । তাই ওর মতো আমিও ওই পেশায় লিপ্ত হয়ে পরি। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে দেখি আমি কোনোভাবে পারি না এসব কাজ । খুবই কষ্ট । তাই যারা টাকা - পয়সা তুলে বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের সাথে যোগাযোগ করে আমিও টাকা পয়সা তুলতে থাকি। সেখানেও টাকা তুলতে গিয়ে দেখি সাধারণ মানুষ হিজড়াদের ঘৃণার চোখে দেখে । তাই নিজের প্রতি আমারই খারাপ লাগতো । তাই ওই পেশাও আস্তে আস্তে করে ছেড়ে দেয়। তখন আমার হাতে টাকা-পয়সা না থাকায় নিজের ব্যয়ভার উঠাতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল । কাউকে কিছুই বলতে পারছিলাম না।
ঘুঁরে দাড়ানোর প্রসঙ্গে সুপ্ত জানান, সেই সময় বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি একজন কর্মীর সাথে পরিচয় হয়। তিনি আমাকে চাকরির প্রস্তাব করেন। তারপর আমিও চাকরিতে যোগদান করি। চাকরি করে করে চিন্তাও করেছি। শুধু চাকরি করলে হবে না। আমার মতো হিজড়া বোন যারা আছে তাদের পাশে আমাকে দাঁড়াতে হবে। তাই আমি হিজড়াদের জন্য একটি সংগঠন গড়ে তোলার প্রস্তাব রাখি যুব উন্নয়নের। সেখানে সুহৃদয়বান কর্মকর্তাদের সহযোগীতা পেয়ে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে হিজড়া বোনদের জন্য একটি সংগঠন তুলতে সক্ষম হয়। ওদের সহযোগীতা ৮টি ভ্যাগ গাড়ি পেয়েছিল সংগঠনের হিজড়ারা। কিন্তু আজ তা বন্ধ হয়ে আছে করোনাভাইরাসের জন্য। খুব দুঃসময় পাড় করছি আমরা। একদিকে থেকে বাড়িওয়ালার ভাড়ার তাগিদ অন্য দিকে খাবারসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান। কিছুই করতে পারছিনা হিজড়া বোনদের জন্য। তাই হৃদয়বান মানুষের অপেক্ষায় বসে আছি। এ সময় ৩৫ বছর বয়সের হিজড়া আলমগীর-আল- আলম প্রতিবেদককে বলেন, খুব কষ্ট করে ভ্যান গাড়িতে ব্যবসা করে মোটামুটি ভাগ্যের চাকা পরিবর্তন হয়েছিল। ভয়ঙ্কর করোনাভাইরাসের জন্য আমাদের সব ব্যবসা বন্ধ হয়ে আছে। খুবই কষ্টে দিন কাটছে। কোন আয় রোজগার নেই। আগে তো খদ্দেররা আসতো আমাদের কাছে । কিন্তু এখন করোনার জন্য কেউ আসেনা। খুব বেশি অভাবে দিন কাটছে আমাদের।
আরও বলেন, সিটি কর্পোরেশন মেয়র মহোদয় আশ্বাস দিয়েছিলো সহযোগীতা করবে বলে। এজন্য অত্যন্ত পক্ষে আমি সিটি কর্পোরেশনে অনেকবার গিয়েছি । কিন্তু দেবে দেবে বলে আর দেননি। এছাড়া স্থানীয় কোন জনপ্রতিনিধিও করোনাকালে আমাদের সহযোগীতার জন্য এগিয়ে আসেনি। আমাদের জন্য আপনারা কিছু করেন। স্বজন বলতেই তো আপনারা। আমরা খুবই কষ্টে দিন যাপন করে যাচ্ছি।
বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সিলেটের দায়িত্বরত ব্যবস্থাপক জহিরুল ইসলাম প্রতিবেদককে বলেন, মহামারি করোনার প্রথম ধাপে বন্ধু সোশ্যালের নিজস্ব তহবিল থেকে খাদ্য সামগ্রী দেওয়া হয়েছে প্রায় ১২০ জন হিজড়াদের মধ্যে। পরবর্তীতে দ্বিতীয় দফায় হিজড়াদের সহায়তার জন্য আলোচনা চলছে।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের (সিসিক) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিধায়ক রায় চৌধুরী নিউ ইর্য়ক মেইলকে বলেন, হিজড়াদের পক্ষ থেকে কোন আবেদন আসেনি। তাই ওদের জন্য করোনাকালে পৃথকভাবে কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। তবে যারা কাউন্সিলর আছে তারা এই ব্যবস্থা নিতে পারেন । তবে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে এখনো কোন আলোচনা উত্থাপন হয়নি।