৪৯ বছর পর তৈরি হচ্ছে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্যভান্ডার
স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর দেশে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে তথ্যভান্ডার তৈরি হচ্ছে। তাদের ও পরিবারের সদস্যদের সুখে-দুঃখে যেন সরকার পাশে দাঁড়াতে পারে-এ জন্যই বিশেষ এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
৬৭৬ জনের মধ্যে জীবিত আছেন দেড় শতাধিক বীর। সরকারের কাছে এসব বীর মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকা ছাড়া আর তেমন কিছু নেই। তারা কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কী করছেন, পরিবারের অবস্থাই বা কেমন-এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য মন্ত্রণালয়ের হাতে নেই।
মৃতদের অধিকাংশের পরিবারের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট কারও তেমন যোগাযোগ নেই। এ অবস্থায় তাদের ও পরিবারের সদস্যদের তথ্যভান্ডার করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য বিস্তারিত তথ্য চেয়ে সব উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ও উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। আগামী ২৬ মার্চের আগেই এ সংক্রান্ত কাজ চূড়ান্ত করতে চান তারা। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বৃহস্পতিবার বলেন, ‘সরকারের কাছে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা থাকলেও তাদের বিস্তারিত ও পরিবারের তথ্য তেমন নেই। আমরা তাদের তথ্য নিয়ে একটি ডেটাবেজ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। এটি নিয়ে কাজ চলছে। আগামী ২৬ মার্চের আগেই এটি চূড়ান্ত করে প্রকাশ করার চিন্তা রয়েছে।’
নির্মোহ টানে দেশমাতৃকাকে ভালোবেসে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অকুতোভয় অংশগ্রহণ ছিল এসব বীর মুক্তিযোদ্ধার। দেশের স্বাধীনতা ছাড়া তখন আর কিছুই চাননি তারা। মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সেই অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে স্বাধীন দেশের সরকার তাদের দিয়েছে বিশেষ সম্মান। ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত গেজেটে ৬৭৬ জনকে ‘খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা’ হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হয়। বীরশ্রেষ্ঠ, বীর-উত্তম, বীরবিক্রম ও বীরপ্রতীক বীরত্বসূচক পদককে ভূষিত করা হয়। তাদের অধিকাংশই চলে গেছেন। জাতির অহংকার এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মধ্যে আজও আলো ছড়াচ্ছেন মাত্র দেড় শতাধিক।
গেজেট অনুযায়ী বীরশ্রেষ্ঠ সাতজন, বীর উত্তম ৬৮ জন, বীরবিক্রম ১৭৫ জন ও বীরপ্রতীক ৪২৬ জন। এদের মধ্যে সেনাবাহিনীর ২৯১ জন, গণবাহিনীর ১৭৫ জন, ইপিআর/বিডিআর/বিজিবির ১৪৩ জন, নৌবাহিনীর ২৬ জন, বিমানবাহিনীর ২২ জন, মুজাহিদ বাহিনীর ১৪ জন এবং পুলিশবাহিনীর পাঁচজন। এরপর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ১১ মার্চ আরও একটি গেজেট প্রকাশিত হয়। প্রথম গেজেটে মুক্তিযোদ্ধাদের শুধু নাম ছিল। কয়েকজন ছাড়া কারও ঠিকানা ছিল না। দ্বিতীয়টিতে অনেকের ঠিকানা থাকলেও উল্লেখযোগ্য ব্যক্তির ঠিকানা ছিল না। আবার গেজেটে সেনাবাহিনী, ইপিআর (এখন বিজিবি), নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, মুজাহিদ, পুলিশ ও গণবাহিনীর যোদ্ধাদের নাম আলাদা থাকলেও অনেক অসংগতি ছিল বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য জানতে চাইলে ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত ‘খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা’ গেজেটের কপি ছাড়া তেমন কোনো তথ্য নেই বলে জানান তারা। বিভিন্ন বাহিনীর খেতাবপ্রাপ্ত সদস্যদের বিস্তারিত তথ্য নিজ নিজ বাহিনীর কাছে আছে। তবে গণবাহিনীর অনেক সদস্যের তথ্য মিলছে না। তবে এ মুহূর্তে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে ১৪৩ জন ভাতা নেন। যাদের সবাই খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা।
বর্তমানে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের বিস্তারিত তথ্যসংবলিত কোনো ডেটাবেজ নেই বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এসএম মাহবুবুর রহমান। বৃহস্পতিবার নিজ দপ্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের বিস্তারিত তথ্য নিয়ে ডেটাবেজ তৈরির কাজে হাত দিয়েছি। এ বিষয়ে তথ্য চেয়ে ইউএনও এবং উপজেলা সমাজসেবা অফিসারদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। গত ৪৮ বছরে যে কাজ হয়নি, সে কাজে আমরা হাত দিয়েছি। তথ্য পাওয়াসাপেক্ষে শিগগির তা চূড়ান্ত করা হবে।’
বর্তমানে ১৫০-১৬০ জনের মতো খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা জীবিত আছেন বলে জানিয়েছেন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) সদস্য মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীরপ্রতীক। তিনি বলেন, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের জন্য কোনো ডেটাবেজ তৈরি হয়নি। কবে হবে তাও জানি না। কতজন জীবিত আছেন, কী অবস্থায় আছেন-তার কোনো খবর নেই। আশা করছি, সরকার দ্রুত খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিস্তারিত ডেটাবেজ তৈরি করবে।’
দীর্ঘদিনেও ডেটাবেজ তৈরি না-হওয়ায় ক্ষুব্ধ খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মো. শাহজাহান কবির, বীরপ্রতীক। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের সময় সাত বীরশ্রেষ্ঠসহ দেড়শর বেশি খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হয়েছেন। ৬৭৬ জনের মধ্যে ১২ জন ডাবল খেতাব পেয়েছেন এবং ৫৫ জনের নাম থাকলেও ঠিকানা পাওয়া যায়নি। ফলে এ মুহূর্তে কতজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা জীবিত আছেন, তা বলা মুশকিল। তবে এ সংখ্যা দুইশরও কম হবে। বিস্তারিত ডেটাবেজ থাকলে এই সংশয়ের মধ্যে থাকতে হতো না জাতিকে।’
সম্মানি ভাতা নিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন খেতাবপ্রাপ্ত, যুদ্ধাহত ও শহিদ মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ডের মহাসচিব আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী তাদের সাধারণ সম্মানি ভাতার পাশাপাশি খেতাবপ্রাপ্তদের ভাতা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ২০১৩ সালের নীতিমালা অনুযায়ী খেতাবপ্রাপ্তের পাশাপাশি সাধারণ ভাতা দেওয়া হতো। কিন্তু ২০১৬ সালে নতুন নীতিমালা করে খেতাবপ্রাপ্তদের সাধারণ মুক্তিযোদ্ধার ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যভান্ডার না থাকায় এখন কতজন জীবিত আছেন, তা কেউ জানে না। দুঃখ হয়, স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা যারা তাদের বিস্তারিত কোনো তথ্য নেই।’
প্রসঙ্গত, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান স্মরণীয় করে রাখতে তাদের সম্মানি ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আসছে সরকার। দেশে দুই লাখেরও বেশি গেজেটভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা থাকলেও বর্তমানে ভাতা পাচ্ছেন এক লাখ ৮৯ হাজার ৩১১ জন। ২০১৩ সাল থেকে ৬৭৬ খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় সম্মানি ভাতাসহ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।