মারা গেছেন মতিয়া চৌধুরী
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, সাবেক সংসদ উপনেতা এবং সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী আর নেই। আজ বুধবার (১৬ অক্টোবর) বেলা ১২টা ৩৭ মিনিটে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থান শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
এভারকেয়ার হাসপাতালের চিকিৎসক জি এম আরিফ মাহমুদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মতিয়া চৌধুরীর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তার মামা সাবেক মন্ত্রী মোস্তফা জামাল হায়দারও।
২০২৩ সালের ১২ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের সংসদ উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পান মতিয়া চৌধুরী। পরে তিনি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর ফের জাতীয় সংসদের সংসদ উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব নেন। ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করলে তিনি সংসদ সদস্য পদ হারান।
ঘনিষ্ঠ সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে নকলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম জিন্নাহ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ মতিয়া চৌধুরী সপ্তাহখানেক আগে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছিলেন। বুধবার সকালে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ফের তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
প্রয়াত মতিয়া চৌধুরীর ভাই মাসুদুল ইসলাম চৌধুরী রাতে জানান, মরহুমার জানাজা আগামীকাল (১৬ অক্টোবর) বৃহস্পতিবার বাদ জোহর গুলশান আজাদ মসজিদে অনুষ্ঠিত হবে। জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হবে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। প্রয়াত মতিয়া চৌধুরীর ভাই মাসুদুল ইসলাম চৌধুরী এ কথা জানান।
মাসুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে নতুন জায়গা চাওয়া হয়েছে সিটি কর্পোরেশনের কাছে। জায়গা পেলে সেখানে দাফন করা হবে, না পেলে তার স্বামী বজলুর রহমানের কবরে দাফন হবে। এলাকার মানুষের দাবি থাকলেও দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় মতিয়া চৌধুরীকে নিজের নির্বাচনী এলাকায় নেওয়া হবে না।
এদিকে বেগম মতিয়া চৌধুরীর মৃত্যুর খবর শেরপুরসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে দলীয় অঙ্গনসহ নানা মহলে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজে তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে তার বর্ণাঢ্য জীবনের কিছু অংশ তুলে ধরা হয়েছে।
জানা যায়, অগ্নিকন্যা খ্যাত বেগম মতিয়া চৌধুরীর জন্ম ১৯৪২ সালের ৩০ জুন পিরোজপুরে। তার বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা এবং মা নুরজাহান বেগম ছিলেন গৃহিণী। ১৯৬৪ সালের ১৮ জুন খ্যাতিমান সাংবাদিক শেরপুরের নকলা উপজেলার গণপদ্দী এলাকার সন্তান বজলুর রহমানের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন মতিয়া চৌধুরী। তিনি ইডেন কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
মতিয়া চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় বামপন্থী রাজনীতি দিয়ে। ১৯৬০ এর দশকে পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার যে আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু হয়, তাতে মতিয়া চৌধুরী সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। আইয়ুব খানের আমলে চারবার কারাবরণ করেন। ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে ‘অগ্নিকন্যা’ নামে পরিচিত মতিয়া পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ন্যাপ) যোগ দেন এবং এর কার্যকরী কমিটির সদস্য হন।
১৯৭০ ও ১৯৭১ এর মাঝামাঝি সময়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, প্রচারণা, তদবির এবং আহতদের শুশ্রুষায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি ন্যাপের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। এরপর ১৯৭৯ সালে ন্যাপ ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং ১৯৮৬ সালে দলের কৃষিবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পান মতিয়া চৌধুরী। এরপর থেকে তিনি আমৃত্যু দলের গুরুত্বপূর্ণ প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে ছিলেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময়কালে তিনি বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার হন।
বেগম মতিয়া চৌধুরী তার শ্বশুরবাড়ির এলাকা শেরপুর-২ (নকলা-নালিতাবাড়ী) আসন থেকে ১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ২০০১ সালে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক হুইপ মরহুম জাহেদ আলী চৌধুরীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। এছাড়া তিনি এই আসন থেকে সর্বশেষ ২০২৪ সালের ১২তম সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত ৬ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এবং সংসদের সরকার দলীয় উপনেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ১৯৯৬, ২০০৯ ও ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ শাসনামলে কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ তিনি আওয়ামী লীগের ১নং প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বহুবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যেতে হয়েছে মতিয়া চৌধুরীকে। জেলজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘দেয়াল দিয়ে ঘেরা’ নামে একটি বই লিখেছেন তিনি। রাজনৈতিক সহকর্মীদের কাছে সারাজীবনই সাধারণ বেশভূষা আর সাদামাটা জীবনযাপনের জন্য পরিচিত ছিলেন নিঃসন্তান মতিয়া চৌধুরী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভূমিকার জন্য ২০২১ সালে বাংলা একাডেমি তাকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ দেয়।