মুর্খ নোবেলকে নিয়ে যা লিখলেন ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন
বিশেষ প্রতিনিধি, নিউ ইয়র্ক: কলকাতার জি বাংলা টিভির জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো ‘সা রে গা মা পা ২০১৯’-এ অংশ নিয়ে পুরো শোজুড়েই আলোচনায় ছিলেন বাংলাদেশের ছেলে নোবেল। তবে এবার নিজের দেশের জাতীয় সংগীতকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যের কারণে সমালোচনার ঝড় বইছে সোস্যাল মিডিয়ায়। নিন্দা জানিয়েয়েছেন দুই বাংলার বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ।
এক লাইভ সাক্ষাৎকারে নোবেল বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ যতটা না দেশকে প্রকাশ করে তার চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি প্রকাশ করেছে প্রিন্স মাহমুদের লেখা ‘বাংলাদেশ’ গানটি। সাক্ষাতকারটি কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভাইরাল হয়ে যায়।
সোস্যাল মিডিয়ায় অনেকেই লিখেছেন মুর্খতার কারণেই এমন মন্তব্য করেছেন নোবেল। জি বাংলার ওই শো চলাকালীন সময়ে সংগীতের অনেক সিনিয়র শিক্ষক এবং দুই বাংলার শ্রদ্ধেয় শিল্পীদের সম্মান করেননি বলেও অভিযোগ উঠেছে এই তরুণ শিল্পীর বিরুদ্ধে। হঠাৎ পরিচিতি পাওয়া অহঙ্কারি হয়ে গেছে বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকে।
কলকাতার জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ইমন চক্রবর্তী ফেসবুকে ভিডিওটি পোস্ট করে ক্যাপশনে লেখেন, 'সরি টু সে একে সামনে পেলে চাবকাতাম।' ভারতের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম নিন্দা জানিয়ে তুরুত্বের সাথে খবর প্রকাশ করেছেন।
জাতীয় সংগীতকে নিয়ে নোবেলের আপত্তিকর মন্তব্যের নিন্দা জানিয়ে বাংলাদেশের বিশিষ্ট ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন ফেসবুকে একটি স্টাটাস দিয়েছেন।
বিশিষ্ট ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটনের ফেসবুক স্টাটাসটা এখানে তুলে ধরা হলো:
.......................................................................................................................
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...
লুৎফর রহমান রিটন
আমাদের জাতীয় সঙ্গীতটি মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালেই স্বাধীনতার আগে থেকেই নির্ধারিত। এটা নির্ধারণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭০-এর খানিক আগেই। একাত্তরে পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন ক্যাম্পে লুঙ্গিপরা সাধারণ মানুষরা মুক্তিযোদ্ধা হিশেবে ট্রেনিং নেয়ার সময় জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে অশ্রুসজল চোখে সমবেত কণ্ঠে এই গানটি গাইতেন। খালেদ মোশাররফের ভিডিও ক্লিপ ছাড়াও অনেক ভিডিও ক্লিপে এরকম দৃশ্য দেখা যায়।
আমরা স্মরণে আনতে পারি, ১৯৭৫-এ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যার পর, ঘাতক মোশতাক-জিয়ার শাসনামলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামের একজন 'হিন্দু (?)' রচিত আমাদের জাতীয় সঙ্গীতটি পরিবর্তনের আবদার শুরু হয়। সেই আবদারে ধীরে ধীরে শামিল হতে থাকেন সুশীল বেশধারী কতিপয় ছুপা রুস্তমও। গর্তে লুকিয়ে থাকা এই রুস্তমরা আড়মোড়া ভেঙে বেরিয়ে আসতে শুরু করেন। পরিস্থিতি অনুকুল বিবেচনায় মুখোশ ঝেড়ে ফেলে ঝেড়ে কাশতে থাকেন কেউ কেউ। সেই কেউ কেউদের একজন মোহাম্মদ মোদাব্বের। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, লেখক। দৈনিক আজাদের ছোটদের পাতা মুকুলের মাহফিলের পরিচালক 'বাগবান ভাই' হিশেবে খ্যাতিমান ছিলেন তিনি। সুধীমহলে ছিলেন তিনি শ্রদ্ধার আসনে। আশির শুরুর দিকে একটি অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তৃতায় সেই প্রাজ্ঞপ্রবীন বললেন, রবীন্দ্রনাথের লেখা 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটা শুনলে তার ভেতরে কোনো সমীহ আসে না।
আশপাশের গর্ত থেকে স্বাধীনতা বিরোধী দু'একজন পাকপেয়ারু মোদাব্বেরের সঙ্গে হুক্কা হুয়া দেবার জন্যে গলা খাকারি দিচ্ছেন। আমি তখন পাঁচ লাইনের একটা লিমেরিক লিখেছিলাম। দৈনিক সংবাদের ছোটদের পাতা খেলাঘর তখন সম্পাদনা করেন আবদুল আজিজ। লিমেরিকটা তিনি খেলাঘর পাতায় ছাপলেন অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে। দুই কলামে একটা ইলাস্ট্রেশনসহ। ইলাস্ট্রেশনে মোহাম্মদ মোদাব্বেরের আবয়বয়ের সঙ্গে মিলে যায় এমন একজন টাক মাথার ভাষণরত বুড়োর ক্যারিকেচার ছিলো। সম্ভবত মানিক দে-র আঁকা। সুধীমহলে ব্যাপক নড়াচড়া শুরু হয়েছিলো ছড়াটা নিয়ে। মোদাব্বের এবং তার সাহাবায়ে একরামরা নাখোশ হয়েছিলেন।
প্রায় চল্লিশ বছর আগে লেখা ছড়াটা ছিলো এরকম--
লোকটা নাকি বুদ্ধিজীবী, কামার কিংবা চাষী না
একাত্তরে দালাল ছিলো খেলতো কতো তাসই না।
লোকটা সেদিন সভাপতির আসনে
জানিয়ে দিলো সুচিন্তিত ভাষণে--
'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' না।
০২
মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর রচিত জাতীয় সঙ্গীতটি যাদের না পছন্দ্ তাদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসিতে লটকে পগাড়পার হয়েছেন। কিন্তু তাদের ছানাপোনা নাতিপুতিরা এখনো সুযোগ পেলেই মিনমিনে স্বরে জাতীয় সঙ্গীতটি কেনো বদলানো যাবে না বলে গাঁইগুঁই করে। এবং জাতীয় সঙ্গীতের বিরুদ্ধে কথা বলাটা 'মত প্রকাশের স্বাধীনতা' হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে কোঁ কোঁ করে। আমাদের কিছু তথাকথিত সুশীল এবং প্র-গতিশীল কিছু হাঁসজারু সেই 'মত প্রকাশের স্বাধীনতা'কে 'বাহবা বাহবা ভোলা ভুতো হাবা খেলিছে তো বেশ!' বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফেসবুক উলোট পালোট করে।
কলকাতার সারেগামা ওয়ালারা প্রতিশ্রুতিশীল ছেলেটাকে খামোখাই গাছে তুলে দিয়ে টাইমলি মইটা সরিয়ে নিয়েছেন। ওদের 'গ্র্যান্ডফিনালে' পর্বটা দেখেছি। প্রথম হওয়া কিংবা রানার আপ হওয়া তরুণদের পাশে তো ওর গায়কী দাঁড়াবার যোগ্যতাই রাখে না। ওদের ক্লাসিক্যাল বেইজের ভিত্তি যতোটা শক্তিশালী ওর ততোটাই নড়বড়ে। ওর তো পঞ্চমও হবার কথা নয়। যে পর্যন্ত তাকে টেনে এনেছে সারেগামা সেটা একেবারেই টিআরপি কেন্দ্রিক। এই ধরনের রিয়েলিটি শো-তে এমনটাই হয়।
এই পর্যন্ত ভালোই ছিলো কিন্তু একটা ইন্টারভিউতে ছেলেটা প্রিন্স মাহমুদের কথা এবং সুরে জেমসের গাওয়া 'আমার সোনার বাংলা'র প্রশস্তি করতে গিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের চাইতেও জেমসের গানটাকে আরো বেশি উচ্চতায় তুলে ধরতে চেয়ে পরিস্থিতি লেজেগোবরে করে ফেলেছে। ভিডিও ক্লিপটা আমি দেখেছি। সেই ভিডিওক্লিপের উপস্থাপকটাও নোবেলের মতোই মূর্খ-অর্বাচীন শিরোমণি। দুই মূর্খের কথোপকথনে রবীন্দ্রনাথ বেচারা রীতিমতো ধরাশায়ী, প্রিন্সের কাছে। এইট পাশ কুতুবের দাবি অনুসারে প্রিন্সের গানটাকে জাতীয় সঙ্গীত করার জন্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি মিছিলও হয়েছিলো! যে মিছিলের কোনো হদিস কেউ জানে না।
প্রিন্স আমার বিশেষ প্রীতিভাজন সুরস্রষ্টা। বাংলাদেশের আধুনিক গানের ক্ষেত্রটির অনেক উচ্চতায় ওর অবস্থান। বিশেষ করে ওর কথা ও সুরে 'মা' গানটি কাল অতিক্রমী, অমরত্ব পাওয়ার যোগ্যতা সম্পন্ন। অনেক মেধাবী এবং গুণী একজন মানুষ হিশেবে ওকে আমি সমীহ করি। প্রিন্স আমার বিশেষ প্রীতিভাজন এবং পরম স্নেহের কিংবা ভালোবাসার মানুষ হলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার ইতিহাসের প্রশ্নে আমি ওকে ছাড় দেবো না।
ওর লেখা 'আমার সোনার বাংলা' একটি মতলবী গান। এই গানে বঙ্গবন্ধুর সমান উচ্চতায় সে জিয়াকে স্থান দিয়েছে। প্রিন্স যদি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠ করে তাহলে সে ৪৭ পরবর্তী আমাদের দীর্ঘ আন্দোলনে সংগ্রামে কোথাও জিয়া নামের কাউকে খুঁজে পাবে না। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চের আগে প্রিন্স কেনো পুরো বাঙালি জাতির কেউই জানতো না জিয়ার নাম। ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস হলেও ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সেই ঘোষণা পাঠ করে জিয়া হয়ে গেলেন স্বাধীনতার ঘোষক! বিএনপি জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। মনে রাখতে হবে ইতিহাস কখনোই মিথ্যাকে ধারণ করে না। দেরীতে হলেও ইতিহাসে সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রিন্স তার কথিত সেই গানে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ উভয় দলের সমর্থকদের সমর্থন প্রত্যাশা করতে গিয়ে ইতিহাসের সঙ্গে আপসটা করে ফেললো। এই ধরণের আপস রাজনীতিবিদরা করে। শিল্পীরা এটা করেন না। রাজনীতিবিদরা মতলবী হয় কিন্তু শিল্পে মতলবী হলে শিল্পটা আর থাকে না। কোনো মতলবী শিল্প কালজয়ী হয় না।
প্রিন্সের আমার সোনার বাংলা গানটা নতুন করে পড়লাম।
প্রিন্সের সোনার বাংলায় কোনো হিন্দুর নাম নেই, সব মুসলমানের নাম। এমন কি নেই রবীন্দ্রনাথের নামও!
সরি প্রিন্স। আমাদের সঙ্গীতাঙ্গনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মেধাবীপুরুষটির কাছ থেকে শুধুমাত্র জনপ্রিয়তার প্রত্যাশায় এমন দেউলেপনা আমি প্রত্যাশা করি না।
০৩
নার্গিস পারভীন নামে একজন শিল্পী ছিলেন আমাদের। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মতো গাইতেন। বিস্ময়কর মিল ছিলো দু'জনার কণ্ঠে। রেডিওতে নার্গিসের গাওয়া দু'টি গান ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিলো--'ভালোবাসা দিয়ে মোরে এতো সুখ দিয়েছো/চাই না আর কিছু চাই না/যা পেয়েছি তা যেনো হারাই না/কী হতো সাজিয়ে পালঙ্ক তাজা ফুলের ঝালর দিয়ে/কী হতো পান্না হীরার জরোয়ায় গা সাজিয়ে/বেনারসির আঁচল দিয়ে /ঘোমটা টেনে কী হতো/তুমি যদি ঘোমটাখানি খুলতে না...।' কিংবা 'পোড়া চোখ কেনো তুই অন্ধ থাকিস না/কেনো তুই বন্ধ থাকিস না...।'
ব্যাপক পরিচিতি পাওয়া সত্তেও হারিয়ে গিয়েছেন নার্গিস পারভীন। কারণ, কারো মতো গাইতে পারলেই কেউ শিল্পী হয় না। নিজস্বতা থাকতেই হবে। তা না হলে হুবহু কিশোর কুমারের মতো কণ্ঠে 'একদিন পাখি উড়ে যাবে যে আকাশে' গাইবার পরেও আকবর নামের গায়কটিও বাতাসে মিলিয়ে যেতো না। জেমস্ কিংবা আইয়ুব বাচ্চুর মতো গাইতে পারলেই নোবেল নামের ছেলেটির টিকে থাকাটাও গ্যারান্টিড নয়। টিকে থাকবেন জেমস এবং বাচ্চুই। ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই দেয়।
ইন্টারভিউতে জাতীয় সঙ্গীত বিষয়ে নোবেল যা বলেছে তা জেনে বুঝেই বলেছে। ক্লিপটা দেখে আসতে পারেন। তার কথায় এরকম প্রতিক্রিয়া যে হবে সেটা সে উল্লেখও করেছে তার বাণীতে।
অবুঝ, আলাভোলা, নাবালক, মাত্র এইট পাশ বলে ওকে পাশ কাটিয়ে যাবার উপায় নেই। বাংলাদেশে এইট পাশ একটা বিপজ্জনক ডিগ্রি! সেটা ভুলে গেলে ভোগান্তি আছে ললাটে...
অটোয়া ০২ আগস্ট ২০১৯