রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ রাশিয়াই পশ্চিমা কূটনীতির ক্রীড়নক
উত্তর ইউরেশিয়াতে অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম দেশ রাশিয়া। ভৌগোলিক কারণ কিংবা অর্ধ প্রেসিডেনসিয়াল ফেডারেল প্রজাতন্ত্রের দেশটি রাজনৈতিক কারণেও গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈশ্বিক কূটনীতিতে রাশিয়া বর্তমানে নাবিকের আসনে বসা একটি দেশ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বিভক্ত ইউরোপিয়ান ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা সম্প্রতি একটি বিষয়ে একমত হয়েছেন। তারা উভয়েই নিন্দা জানিয়ে স্বীকার করছেন পশ্চিমা গণতন্ত্রকে হেয়-প্রতিপন্ন করতে রাশিয়া গোপন অভিযান চালাচ্ছে। কিন্তু মিউনিখে নিরাপত্তা সম্মেলনে রাশিয়ার প্রতি আন্তঃদেশীয় ক্ষোভ থাকলেও পশ্চিমা কর্মকর্তা ও কূটনীতিকরা অস্বস্তির সঙ্গে আরেকটি সত্যও স্বীকার করেছেন: বিশ্বের যে কোনও সংঘাত নিরসনের ক্ষেত্রে রাশিয়া এখন গুরুত্বপূর্ণ।
কর্মকর্তারা বলছেন, ইউক্রেন থেকে কোরিয়া, পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে রাশিয়ার অবস্থান, সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দেশটির ভেটো ক্ষমতার অর্থ হচ্ছে যে কোনও কূটনৈতিক সমাধানের ক্ষেত্রে মস্কোকে অবশ্যই জড়িত করতে হবে।
নরওয়ের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফ্র্যাংক বাক্কে জেনসেন বলেন, ‘আমরা রাশিয়াকে ছাড়া কোনও রাজনৈতিক সমাধানে আসতে পারি না। আমরা সমাধানের ক্ষেত্রে যে পদক্ষেপ নেই সেটার কেন্দ্রে রাশিয়া থাকেই।’
প্রকাশ্যে মিউনিখে রাশিয়া ছিল ‘শয়তান’। ১৩ রুশ নাগরিকের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগ আনার পর সম্মেলনে বারবার সমালোচিত হয়েছে রাশিয়া। আর ২০১৪ সালে ইউক্রেন থেকে ক্রিমিয়াকে বিচ্ছিন্ন করায় আরও ব্যাপক সমালোচনা হয় দেশটির বিরুদ্ধে।
ট্রাম্পের আমেরিকা ফার্স্ট নীতির এক বছরের মাথায় এই ঐক্যবদ্ধতা নতুন পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। ট্রাম্পের নেতৃত্বের যুক্তরাষ্ট্রের প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে আসা ও ইরান পরমাণু চুক্তি নিয়ে যু্ক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তিত অবস্থান ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গে মতবিভেদ স্পষ্ট করেছে।
মিউনিখের এই বার্ষিক সম্মেলনে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা জড়ো হয়েছিলেন, যা সচরাচর ঘটে না। স্বাভাবিকভাবেই এতে আগ্রহ ছিল রুশ কূটনীতিকদের। সম্মেলনে মার্কিন নির্বাচনে রুশ সংযোগের বিষয়টি অস্বীকার করায় বাহ্যত বিরক্ত করেছে ওয়াশিংটনের নীতি নির্ধারকদের।
মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক ড্যান কেটস বলেন, ‘আমি অবাক হয়ে যাই। প্রতিবছরই রাশিয়ার কেউ না কেউ আসেন কিংবা কাউকে পাঠানো হয় সবকিছু ভুল প্রমাণ করতে।
তবে কূটনীতকরা জানান, পর্দার আড়ালে পরিস্থিতি ও সুর ছিল অন্যরকম। ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টোলেনবার্গসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সঙ্গে দেখা করেছেন।
রুশ সিনেটর অ্যালেকসি পুশকোভ বলেন, ‘কূটনৈতিকদের একটি নেটওয়ার্ক রয়েছে। সিরীয় গৃহযুদ্ধ সমাধানে মস্কো, আঙ্কারা, ওয়াশিংটন ও তেল আবিবকে প্রয়োজন।’ এই নেটওয়ার্ক একসঙ্গে কাজ করলে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব বলেও জানান তিনি।
জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগমার গ্যাব্রিয়েল কয়েকবার ল্যাভরভের সঙ্গে দেখা করেছেন। পূর্ব ইউক্রেন ইস্যুতে মস্কোর ওপর জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার ব্যাপারে আলোচনা করেছেন তারা। পরমাণু অস্ত্র মোকাবিলায় রাশিয়া তাদের ‘অপরিহার্য’ সহযোগী।
সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বলেছেন, কূটনৈতিক সাফল্যের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে ‘ইস্যু ভাগ করে’ গুরুত্ব দিতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে।
আন্তর্জাতিক সংকটগুলো সবকিছুই একটি আরেকটির সঙ্গে সম্পর্কিত। ইসরায়েলের প্রতিপক্ষ ইরানের মিত্র রাশিয়া। আর ইউক্রেনে বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরকে মস্কোর সমর্থনে ক্ষুব্ধ ন্যাটো। তবে ন্যাটো মিত্র তুরস্ক আবার রাশিয়ার কাছ থেকে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অস্ত্র কিনতে চায়। তাদের সমর্থনেই সিরিয়া থেকে মার্কিন সমর্থিত কুর্দি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে তুরস্ক।
এশিয়াতে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক পরীক্ষা বন্ধ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু পিয়ংইয়ংয়ে তেল নিষেধাজ্ঞা আরোপে সম্মত হয়নি রাশিয়া। সবসময়ই এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করে এসেছে তারা।
নরওয়ের জেনসেন বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও আপনি আলাদা আলাদা সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পারতেন। কিন্তু এখন একটি সংকট নিয়ে আলোচনা করতে চাইলেও সবকিছু সামনে চলে আসে।’
মিউনিখ সম্মেলনে ইরানে বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু। নিউ ইয়র্কে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর ফ্রান্স ইরানের বিরোধিতা করলেও মিউনিখে তারাই রুশদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। মিউনিখে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের সুযোগ এসেছিলো ইউক্রেন নিয়ে কিছু বলার। মার্কিন বিশেষ দূত বলেন, ‘সবকিছু এখন রাশিয়ার হাতে।’ তবে সমাধানে তার দেশের সেনারা সবসময়ই প্রস্তুত রয়েছে বলেও জানান।
মিউনিখে ৯ বছর আগে তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বিডেন রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ‘ঠিক’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে যাওয়া ও ন্যাটোর বিস্তারের গভীরতা উপলব্ধি করতে পারেনি পশ্চিমা দেশগুলো।
এখন ক্রিমিয়া ইস্যুতে ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়ার ওপর চলছে পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। স্নায়ুযুদ্ধের পর রাশিয়ার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক সবচেয়ে শীতল অবস্থায় রয়েছে। খুব সহজে এই সম্পর্ক ঠিক হবে না বলে মনে করেন কূটনীতিকরা।
নিউইয়র্ক মেইল/রাশিয়া/২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/এইচএম