‘হ্যালো লায়লা! আমরা আপনার ভয়েস শুনতে পেয়েছি !
জাহিদ আল আমীন, জার্মানি থেকে: তিন বছর বয়সী সহোদরা হুমা ও জিয়াদ। কিছুটা সৌভাগ্য নিয়েই জন্মেছে এই জমজ শিশু দুটি। তাদের বাবা চিরদু:খি এই বাংলাদেশের মানুষ। তবে তাদের মা একজন তার্কি! এই মাতৃপরিচয়ে তাদের জীবনে একটুখানি নির্ভরতা ও নিশ্চয়তা এনে দিয়েছে। আর কিছু হোক বা না হোক, বিনে চিকিৎসায় যে মরতে হবে না।
হুমা আর জিয়াদকে হয়তো কবি দাউদ হায়দারের মতো করে বলতে হবে না :
‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ,
মাতৃজরায়ু থেকে নেমেই জেনেছি আমি
সন্ত্রাসের ঝাঁঝালো দিনে বিবর্ণ পত্রের মত
হঠাৎ ফুৎকারে উড়ে যাই
পালাই পালাই সুদূরে........
এই জমজ ভাই-বোনদের গল্পের একটি শানে নুযূল আছে। তাদের মা তুবা আহসান ভালোবেসে বিয়ে করেছিল বাংলাদেশি যুবক মুসাদ্দিক আহসানকে। করোনার মহাদুর্যোগ থেকে এই পরিবারটিও রক্ষা পায়নি। সম্প্রতি তুবা আহসান এবং তার পরিবারের কয়েক সদস্যের শরীরে করোনার লক্ষণ দেখা দেয়। করোনাঘাতে প্রায় বিনে চিকিৎসায় তুবার শ্বশুর মারা যান।
এমন পরিস্থিতিতে তুবা তুরস্কে থাকা তার তার বড়বোনকে জানান যে, সে এবং তার পরিবার বাংলাদেশে কোন চিকিৎসা পাচ্ছে না। এমনকি তাদের সবার করোনার টেস্টও করা হয় নি। জীবন-মৃত্যুর ফয়সালা আসমান থেকে আসে। তবে এইদেশে তাদের জীবন কোনমতেই নিরাপদ নয়। হয়তো বিনে চিকিৎসাতেই ধুঁকে ধুঁকে তাদের মরে যেতে হবে।
যথারীতি তুবার বড়বোন বিষয়টি টুইট করেন। দৃষ্টিগোচর হয় তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের। প্রেসিডেন্ট এ ব্যাপারে তরিৎ ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দেন। তুরস্কের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কালবিলম্ব না একটি এয়ার এম্বুলেন্স পাঠায়। বিশেষায়িত সেই এয়ার এম্বুলেন্সে করে শেষ রমজানের শেষ বিকেলে ঢাকা ছাড়েন তুবা, তার স্বামী এবং তিন বছরের দুই জমজ কন্যা। বিমানবন্দরে তাদেরকে বিদায় জানাতে আসেন তুর্কি রাষ্ট্রদূত মোস্তাফা ওসমান তুরান ও ডেপুটি হেড অব মিশন এনিস ফারুক এরদেম।
আতাতুর্ক বিমান বন্দর থেকে পরিবারটিকে সরাসরি ইস্তাম্বুল হেলথ সাইন্স ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়।
তুরষ্কের নাগরিক শিশু হুমা-জিয়াদ ও তাদের মা এবং বাংলাদেশী বাবাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে....
তুবার মতো লায়লারও একটি গল্প আছে। সুইডেনে বসবাসরত ৪৭ বছর বয়সী তুর্কি নাগরিক এমরুল্লাহ গুলুসকেন করোনায় আক্রান্ত হয়েও সেখানে ঠিকভাবে চিকিৎসা পাচ্ছিলেন না।
এমরুল্লাহর মেয়ে লায়লা একটি ভিডিও টুইট করেন। যেখানে তিনি জানান, তার বাবা করোনায় আক্রান্ত হয়েছে তবে ঠিকভাবে চিকিৎসা পাচ্ছেন না। কঠিন মুহূর্তে নিজ দেশকে পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। ভিডিওটি নজরে আসে তুরস্কের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. ফাহরেদ্দিন খোজার। তিনি টুইটের জবাবে তার ভেরিফেইড ফেসবুক পেজে বলেন, ‘হ্যালো লায়লা! আমরা আপনার ভয়েস শুনতে পেয়েছি।
আমরা এয়ার অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে সুইডেনে আসছি।’ এরপরই সুইডেন থেকে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তার তিন সন্তানকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
দেশে ফিরে লায়লা ফিরতি টুইটে বলেন, আমি জানতাম আমার দেশ আমাদের সমর্থন করবে। তারা এই কঠিন সময়ে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী খোজাকে ধন্যবাদ জানাই। আল্লাহ আমাদের দেশকে রক্ষা করুন।
এর আগে গত ২১ এপ্রিল, ২০২০ ১৫৪ জন তুর্কি নাগরিককে করোনা দুর্যোগের প্রেক্ষিতে বিশেষ বিমান করে নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। তুর্কি সংবাদসংস্থা আনাদোলু জানায়, ৭৯টি দেশে অবস্থানরত ৭৫০ জন করোনা আক্রান্ত তুর্কি নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করে। এর মধ্যে উন্নত বিশ্বের অনেক দেশও রয়েছে, যেখানে তুর্কির দ্বৈত নাগরিকগন যথাযথ চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান
আপাত দৃষ্টিতে এটাকে আলগা পিরীতি পিরিতি মনে হতে পারে। কেউ ভাবতে পারেন, সারা দুনিয়া খুঁজে করোনা রোগীদের দেশে ফিরিয়ে এনে বড় একটা বাহাদুরী দেখালো! বাহাদুরীই বটে। এমনটি মনে হওয়া স্বাভাবিক। বিপদে বন্ধুর পরিচয় দেয়া সহজ কোন কম্ম নয়। সবাই এটা করে দেখাতে পারে না। এর রহস্য বুঝতে হলে সাম্প্রতিক সময়ের তুরস্ককে সামান্য হলেও স্টাডি করার প্রয়োজন পড়বে।
জন হপকিন্স ইনষ্টিটিউট কর্তৃক ২৫ মে, ২০২০ তারিখে দেয়া সর্বশেষ তথ্যমতে তুরস্কে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ছাপ্পান্ন হাজার ৮শত সাতাশ জন। যা করোনায় সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, এমন দেশের তালিকায় নবম অবস্থানে। তুরস্কের সামনে দুই পরাশক্তি জার্মানি ও ফ্রান্স। আর পেছনে মহা ভারত ও পারস্য সম্রাজ্য তথা ইরান। করোনার লক্ষণ নিয়ে আসা রোগীদের পরীক্ষা করার ক্ষেত্রেও তুর্কির অবস্থান বিশ্বে আট নাম্বারে। তারা গত ২১ মে পর্যন্ত ১৭ লাখ ২৯ হাজার ৯শত ৮৮জনকে পরীক্ষা করেছে। এ পর্যন্ত চার হাজার করোনায় তুর্কি নাগরিক করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এই হিসেবে তুর্কির অবস্থান ১৪তম।
চলমান করোনা যুদ্ধে তুরস্ক সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। শুধু কথায় নয়, কাজে-কর্মেও অব্যাহতভাবে তার প্রমান দিয়ে আসছে। নিজেদের চাহিদা পূরণ করে অন্যান্য দেশেও জীবন রক্ষাকারী ভেন্টিলেশন সিস্টেম রপ্তানী শুরু করেছে। সিরিয়া যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া ড্রোণের নির্মাতা বায়রাকতার এবার ভেন্টিলেশন উৎপাদনের দায়িত্ব কাধে তুলে নিয়েছে। মার্চে শুরু হওয়া এই প্রকল্পটি ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, ইতালিসহ বেশ কয়েকটি তাদের ভেন্টিলেশন সাপোর্ট নিতে শুরু করেছে।
করোনাযুদ্ধের বাইরেও সত্যিকারের যুদ্ধেও তুরস্ক ফ্রন্টলাইনে।তুরস্ক গত এক দশক যাবৎ যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার ৪১ লাখ শরণার্থীর বোঝা ঘাড়ে বয়ে বেড়াচ্ছে। প্রতিবেশি সিরিয়া ও ইরাকের সঙ্গে তুরস্কের ১২৭৬ কিলোমিটার সুদীর্ঘ সীমান্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সন্ত্রাসী পিকেকে, আইএস এবং যুদ্ধাপরাধী বাশার আল আসাদের বাহিনী ও শিয়া মিলিশিয়াদের সঙ্গে অবধারিত যুদ্ধের মুখোমুখি। সিরিয়ার আফরীন ও ইদলিবসহ ইউফ্রেতিস নদী অববিাহিকার বিস্তীর্ণ এলাকা এখন তুর্কি সমর্থিত সিরিয়ার আর্মির শাসনে পরিচালিত হচ্ছে। ছায়া যুদ্ধ চলছে ইরান, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট, ইজরাইলের সঙ্গে।
কাতার আবরোধ ও সাংবাদিক জামাল খাশোগীর নির্মম হত্যাকান্ড তুরস্ককে দাড় করিয়ে দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোড়া সৌদ রাজতন্ত্রের সঙ্গে। ফেরাউনের দেশ মিশরের নব্য ফেরাউন আব্দুল ফাত্তাহ সিসির সঙ্গেও তুরস্কের এখন সাপে নেউলে সম্পর্ক। মিসরের কয়েক হাজার বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে জনগণের ভোটে নির্বাচিত একমাত্র প্রেসিডেন্ট হাফেজ ড. মুহাম্মদ মুরসি। মাত্র একবছরের মাথায় সামরিক ক্যু ও গণহত্যার মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত এবং পরবর্তীতে কারাগারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই অবিচারের বিরুদ্ধে মাত্র একজন নেতা উচ্চকণ্ঠ হয়েছেন। এরফলে জনসংখ্যা ও সামরিক শক্তির বিচারে সবচেয়ে বড় আরব রাষ্ট্রটির কু-নজরে পড়েছে তুরস্কের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী।
লিবিয়ার ত্রিপোলিতে জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের সমর্থনে তুরস্ক যুদ্ধ জাহাজ ভরে অস্ত্র ও সেনা পাঠিয়েছে। মিসর ও আরব আমিরাত সমর্থিত যুদ্ধবাজ নেতা খলিফা হাফতার রাজধানী ত্রিপলী অবরোধ করেছিলো। তার বিজয় ছিলো সময়ের ব্যাপার। এ বছরের শুরুর দিকে তুরস্ক লিবিয়ার রাজনীতিতে নাক গলাতে শুরু করে। তুর্কি সৈন্যদের পদভারে সাহারার দেশ লিবিয়ার যুদ্ধ কৌশল ও রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ সম্পুর্ণরূপে বদলে যায়। ইতিমধ্যেই তুর্কি বাহিনী লিবিয়ার বড় একটি অঞ্চল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের করতলগত করেছে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, খলিফা হাফতারের পতন এবং লিবিয়ায় একটি স্থিতিশীল সরকারে নেতৃত্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের ব্যাপার।
এর বাইরে আমেরিকার সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত হতে না দেয়া - এমন অজস্র ঘটনায় একদ পৃথিবীর পরাশক্তি এই দেশটি এখন বেশ ভালোভাবেই অর্থনৈতিক ধ্বসের মুখে পড়েছে। তারপরও চতুর্মুখী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
শ্রম আর মেধার ভিত্তিতে রাজনীতির খেলায় সবসময় জেতা যায় না। প্রয়োজন আত্নবিশ্বাস। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো বিচক্ষণতা। দরকার দূরদর্শীতা। অলৌকিক ভাগ্য। সর্বোপরি মহান আল্লাহর অশেষ রহমত। বাজির সবগুলো তাস এই মুহুর্তে সম্ভবত তুরস্কের ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষে। তাই সব বাধা, ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে এক নতুন তুরস্ক গড়ার পথে এগিয়ে চলছে।
একদা যে ছেলেটি ইস্তাম্বুলের পথে ঘুরে ঘুরে লেবুর শরবত বিক্রি করতেন। গত ১৭ বছর ধরে তিনিই তুরস্কের রাষ্ট্র ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। না, কোন স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে অথবা রাতের আধারে ব্যালটবাক্স ভরে তিনি ক্ষমতায় আসেন নি। ২০০৩ সাল থেকে অনুষ্ঠিত তুরস্কের সবক’টি নির্বাচন আন্তর্জাতিক বিবেচনায় স্ফটিক স্বচ্ছ। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বায়বীয় অভিযোগ তুললেও কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য-প্রমান উপস্থাপন করতে পারে নি। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকগণও তুরস্কের নির্বাচনের মান নিয়ে কখনো প্রশ্ন তুলেনি।
রাজনীতির পথ সময়ই কন্টকাকীর্ণ। আর দেশটি যদি হয় ৬২৪ বছর যাবৎ পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি অঞ্চল শাসন করা অটোমান সম্রাজ্যের সম্রাজ্যের সূতিকাগার তুরস্ক। দেশটি যদি হয় ইউরোপ ও এশিয়ার ভৌগলিক সেতূবন্ধনের যোগসূত্র। দেশটি যদি হয় উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোটের দ্বিতীয় শক্তিশালী সেনাবাহিনীর দেশ, দেশটি যদি হয় কট্টোর সেকুলার ও তুলানমূলকভাবে গ্রহনযোগ্য ইসলামী আদর্শ ভাবাপন্ন মানুষের শেয়ানে শেয়ানে লড়াইয়ের দেশ - তখন সেই পথটি আরও বেশি বন্ধুর হয়ে ওঠে। বাইরের শক্রর পাশাপাশি গৃহশক্রুদের সঙ্গেও মেকাবেলা করতে হয় বেশ কৌশল নিয়ে ভীষণ দাপটের সঙ্গে।
১৬ জুলাই, ২০১৬। তুরস্কের প্রেসিডেন্টকে অপসারণের লক্ষ্যে পরিচালিত সামরিক ক্যু চলাকালে একজন সাধারণ নাগরিক ষড়যন্ত্রকারী সৈন্যদের ট্যাংকের সামনে এভাবেই নিজেকে সপে দেয়।
সেই দাপট পুলিশের নয়, ক্যান্টনমেন্ট থেকেও নয়। জনগণের ভালোবাসা থেকেই আসে সেই দাপট। জনগণই তাদের নেতাকে বিশ্বমঞ্চে এমন ঔদ্ধত্য দেখানোর ছাড়পত্র দেয়। এইসব তুবা আহসান, লায়লা এমরল্লাহদের জীবন যখন বিপদের মুখোমুখি হয়, তাদের আহবানে, আর্তনাদে নেতাকে সাড়া দিতে হয়। তাদের হৃদয়গুলোকে জয় করে নিতে হয়। এমন বিন্দু বিন্দু ভালোবাসা জমেই একসময় ভালোবাসার প্রাচীর গড়ে ওঠে। এমন নেতার জন্ যারা সামরিক সাজোয়া যান আর ট্যাংকের সামনে হাসিমুখে প্রাণ দিতেও কার্পণ্য করে না।
বাহাদুরী তো এমন নেতাকেই সাজে!