এ যেন প্রেমিক যুগলদের দেয়াল
‘পাথরে লেখো নাম, পাথর ক্ষয়ে যাবে। হৃদয়ে লেখো নাম, সে নাম রয়ে যাবে’। মান্না দে’র বিখ্যাত গান। কিন্তু সে গান হয়তো ভারতের গড়পঞ্চকোট পর্যন্ত পৌঁছায়নি। হয়তো সেই কারণেই ভগ্নপ্রায় মন্দিরের অসাধারণ কারুকর্যকে ছাপিয়ে দেওয়ালের প্রতি ইটে লেখা প্রেমিক প্রেমিকাদের নাম।
এভারেস্ট জয় করে তা স্মরণীয় করতে পর্বতআরোহীরা সেখানে দেশের পতাকাসহ নাম লিখে আসেন। কিন্তু ভেঙে পড়ে মন্দিরের দোর থেকে শুরু করে উইয়ের বাসা তৈরি হওয়া গর্ভগৃহের ছাদে প্রেমিক যুগলের নাম লেখা কি স্বাভাবিক? ভারতের প্রত্নতত্ববিদরা অবাক। তারা বলছেন, ‘আমাদের দেশে সব হয়। অস্বাভাবিক হোক,অযাচিত হোক সবই ঘটে’।
গড়পঞ্চকোট, পুরুলিয়ার অন্যতম দর্শনীয় স্থান। এর অতীত ইতিহাসও যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী। গড়পঞ্চকোটের ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আর একটি দ্রষ্টব্য স্থল কাশীপুর রাজবাড়ী। এটি আরেক ইতিহাস বহন করে। মুঘল আক্রমণের সময় পঞ্চকোট রাজারা তাদের গড় কাশীপুরে স্থানান্তরিত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। লাল ইট, পাথর ও কাঠের তৈরি এই রাজবাড়ীর স্থাপত্য ও শিল্প কলা অসাধারণ। টেরাকোটার শিল্পবৈশিষ্ট্য সম্পন্ন কয়েকটি মন্দির আজও অতীতের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
বর্গীরা বাংলা আক্রমণ করে সতেরো শতকে। ভেঙে দেয় বাঙলার বহু শিল্প সৃষ্টি। সৃষ্টির যেদিকেই তাকানো যায় রয়েছে রাজ্য সরকারি সতর্কতা। কেউ যেন কোনওভাবে দর্শনীয় স্থান কোনওভাবে খারাপ করার চেষ্টা না করে। ধরা পড়লে কড়া শাস্তি হবে। এখানেই যেন আসল ঘোঁট পাকানো। দেখতে পেলে তবে শাস্তি। ওই সতর্কীকরণ দেওয়া সাইন বোর্ড ছাড়া তা দেখার কেউ নেই। সেখানে কে কি করছে কে দেখে।
তেমন ভাবেই প্রেমিক যুগল প্রেম করেছেন। নিজেদের শেষ হওয়া রাজ বংশের বংশধর ভেবে তাদের নাম খোদাই করে দিয়ে গিয়েছে। কোথাও লেখা সীমা প্লাস সোনু, কোথাও লেখা শিবনাথ প্লাস সন্ধ্যার। জোড়া শালিকের প্রেম চিহ্ন ওই প্লাস চিহ্ন। ‘আই লাভ ইউ’ লেখা ভাঙা সিঁড়ির দেয়ালেও। এমন নাম লেখা নাটমন্দিরের ছাদের দেয়ালেও।
ছাদ যথেষ্ট উঁচু। কিভাবে সেখানে প্রেমিক প্রেমিকাদের হাত পৌঁছাল তা বোঝা দায়। সবই বোধ হয় প্রেমের ক্ষমতা। সমস্ত উচ্চতা বাধা বিপত্তি সবই সহজেই পেরোয়। সেখানে কোথায় লাগে ইতিহাস। তুচ্ছ স্থাপত্য, শিল্প।
ইতিহাস অনুযায়ী সেই সময় বাংলার নবাব আলিবর্দী খাঁ’কে তার রাজ্য ছিনিয়ে নেবার হুমকি দিয়েছিল সরফিরাজ। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে মারাঠা রাজা রাঘজী ভোঁসলের সাহায্য চায়। এই ভোঁসলে তার কিছু বাহিনীকে বাংলা আক্রমণে পাঠায়। মারাঠি এই হামলাকারীরাই বর্গি। এরা পাঞ্চেত হয়ে বাংলায় প্রবেশ করে। চালায় লুট এবং ধ্বংসলীলা। এতেই ভাঙা পড়ে ওই রাজার বাড়ি এবং মন্দির।