দুর্ভাগ্যক্রমে আধুনিক পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীটি বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশি। আবহমানকাল ধরে বাংলার অতিথিপরয়ানতা বিশ্বময় প্রশংসিত। তাই কাটাতারের ওপারে আর্তমানবনতার কান্নায় রাষ্ট্র, সরকার, সীমান্তের প্রহরীরা শুরুর দিকে খড়গহস্ত হলেও বাংলার আপামর জনগণ তাদের হৃদয় নিংড়ানো সবটুকুন আবেগ ও ভালোবাসা নিয়ে সবহারানো রোহিঙ্গাদের পাশে দাড়িয়েছিলো। তাদের দেখে শিখে, প্রথমে সরকার এবং পর্যায়ক্রমে কাছে দূরের অপরাপর রাষ্ট্র ও মানবিক প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে এসেছে। সকলের সম্মিলিত উদ্যোগে মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে জাতিগত নিধন ও গণহত্যার শিকার হওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী শুধু প্রাণটুকুন হাতে নিয়ে পাহাড়, নদী, সাগর পাড়িয়ে বাংলাদেশের সীমান্তের এপারে এসেছে। পথিমধ্যে অনেক রোহিঙ্গা মায়ানমার সেনাবাহিনী ও মগজলদস্যূদের গুলি ও নির্যাতনে মারা গেছে, বাকীরা মরেছে পুঁতে রাখা স্থলমাইন অথবা সাগরের লোনা জলে।
মাত্র তিন সপ্তাহের ব্যবধানে রাখাইন থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। আগেই আশ্রিত ছিলো আর সাড়ে চার লাখ। সবমিলিয়ে প্রথমদিকে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ ও পুণর্বাসনে নানাধরণের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী যখন থেকে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ ও পূনর্বাসনের দায়িত্ব হাতে নিয়েছে, বান্দরবান ও কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা উদ্ধাস্তুদের মধ্যে অনেকটা শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে।
এখনো অনেক কাজ বাকী। খাদ্য-বস্ত্র, বাসস্থান, নিরাপত্তাসহ আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মৌলিক মানবিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করতে হবে। এই দায়িত্ব এখন যেভাবেই হোক বাংলাদেশ সরকারের ওপর ন্যস্ত হয়েছে। পাশাপাশি কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে কতদ্রুত রোহিঙ্গাদের নিজভূমে ফিরিয়ে দেয়া যায়, সেজন্য সবরকম চেষ্টা ও উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে। বাংলাদেশের বান্দরবান ও কক্সবাজারের সঙ্গে মায়ানমারের রাখাইন পার্বতাঞ্চলের ১৭০ কিলোমিটার সীমানা রয়েছে। অপরদিকে ভারতের মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মনিপুর এবং চীন সংলগ্ন অরুনাচল প্রদেশের সঙ্গে মায়ানমারের ১৬৪৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। ভূ-রাজনৈতিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার এই এলাকাটি ভারত এবং চীনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে কথিত ইউরোনিয়ামসহ বিভিন্ন খণিজ সম্পদের হিসেব-নিকেশ। এই অঞ্চলটির প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কু-দৃষ্টিও বহুদিনের। এশিয়ায় রাজ করতে হলে মায়ানমার, বাংলোদেশ এবং ভারত – এই তিন রাষ্ট্রের সীমান্তবর্তী বিলালায়তনের দুর্গম পার্বত্য এলাকাটি যুক্তরাষ্ট্রের বড় প্রয়োজন। সবমিলিয়ে এখানকার সমস্যাটি শুধুমাত্র মায়ানমারের সংখ্যালঘু হিন্দু ও মুসলিম রোহিঙ্গাদের নিয়েই নয়।
তাই বাংলাদেশ সরকারকে খুব সাবধানে দাবার গুটি ফেলতে হবে। আশ্রিত রোহিঙ্গাদেরকে খুব সক্ষমতার সঙ্গে সার্বিক তত্ত্ববধান যেমন করতে হবে তেমনি আন্তর্জাতিক এই খেলায়ও বিচক্ষণতা ও দূরদর্শীতার পরিচয় দিতে হবে। জাতিসংঘ এবং অপরাপর সহযোগি সংস্থা ও দেশকে সঙ্গে নিয়ে রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক ক্যাম্পেইন অব্যাহত রাখতে হবে। ত্রাণ ও অন্যান্য সাহায্যের একটা স্থায়ী ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি তাদের ডিএনএ এবং ফিঙ্গার প্রিন্টসহ শতভাগ ডিজিটাল নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে। নারী ও শিশুদের জন্য বিশেষ উদ্যোগও নেয়া জরুরি। সাময়িক হলেও স্বাস্থ্য সম্মত পানীয় জল, টয়লেট এবং ন্যুনতম মাথাগোঁজার ঠাঁইটুকুন এর ব্যবস্থা করতে হবে। চিকিৎসাসহ অন্যান্য জরুরি প্রয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সেনাবিহনীর সার্বক্ষণিক তত্ত্ববধানে থাকলে এদের নিয়ে স্থানীয় বাংলাদেশিদের নিরাপত্তা এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে না।
এর পাশাপাশি জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশ সরকার শুরু থেকেই রোহিঙ্গা ইস্যুকে মায়ানমারের আভ্যন্তরীন সমস্যা হিসেবে আখ্যায়িত করে গা এড়ানোর ভান করছিলো। তবে আগস্টের শুরু হওয়া সমস্যাটি এখন ক্রমশ: নানান দিকে ডাল-পালা, শেকড় ছড়াচ্ছে। সময় বদলেছে। সরকার প্রধান শেখ হাসিনা নিজে ঘটনাস্থল পরদর্শণ করেছেন। রোহিঙ্গাদের খাওয়া-পরার আশ্বাস দিয়েছেন। জাতিসংঘে সাধারণ অধিবেশনে কতিপয় প্রস্থাবও উত্থাপন করেছেন। তবে এখনও মাইলস টু গো।
১৯৭৮ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান জিয়াইর রহমান এবং ১৯৯২ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান বেগম খালেদা জিয়ার বলিষ্ঠ পররাষ্ট্রনীতির কারণে মায়ানমার সরকার বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দু’টি ভিন্ন ভিন্ন দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদন করতে সক্ষম হয়েছিলো। এই চুক্তির আওতায় ১৯৭৮ সালে দুই লাখ এবং ১৯৯২ সালে আড়াই লাখ রোহিঙ্গাকে নিজভূমিতে প্রেরণ করা হয়েছিলো। নাফ নদী দিয়ে বঙ্গেপসাগরে এতোদিনে অনেক জল গড়িয়েছে। এখন ২০১৭। দুই দেশের আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক কাঠামো এবং বিশ্বরাজনীতিতে অনেক পালাবদল হয়েছে। ২৫ বছর আগে কাজটি এখন করে দেখানো খুব সহজ কাজ নয়। এর উপরে বাংলাদেশে গত কয়েকবছর যাবৎ জনগণের ভোটবিহীন একটি চেপে বসা সরকার দেশ চালাচ্ছে, ফলে পররাষ্ট্রনীতি জোরদার হওয়ার জন্য একটি সরকারে ভেতরে ও বাইরে যে জোর, যে তেজ থাকার কথার কথা, ২০১৪ পরবর্তী ক্ষমতাসীনদের সেই সক্ষমতা নেই। তাই বলে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। ভারত নির্ভর পররাষ্ট্রনীতির আচল ছেড়ে বের হয়ে সরকারকে বের হয়ে আসতে হবে।
জাতিসংঘ এবং ওআইসি, আসিয়েন, সার্কসহ সম্ভাব্য টুলসকে কাজে লাগানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যেতে হবে। শেষ পর্যন্ত মায়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে না নিলে নিদেন পক্ষে বাংলাদেশ ও মায়ানমারের সীমান্তে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি সেইফ জোন প্রতিষ্ঠার করার জন্য বাংলাদেশকেই উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে।
রোহিঙ্গাদেরকে কারণে বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ সাধ্যমতো সবটুকুন দিয়ে পাশে দাড়িয়ে মানবিকতার এক অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তবে আমাদের সীমিত সামর্থ্য। দীর্ঘদিন এই বয়ে চলা বাংলাদেশের পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব নয়। রোহিঙ্গারা যেন কোনভাবেই আরেকটি বিহারী ইস্যু হয়ে না দাড়ায়। সমস্যাটি বাংলাদেশের সমস্যা মনে করে সরকারকেই সবধরণের উদ্যোগের সবার সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে। রোহিঙ্গারা যেন কোন অমীমাংসিত ইস্যু না হয়। যেকোন প্রেকারেই হোক রোহিঙ্গা সমস্যার আশু এবং স্থায়ী সমাধান করতেই হবে।
জাহিদ আল আমীন, ফ্রাইবুর্গ, জার্মানি।
ই-মেইল: [email protected]