প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পকার্ডটা ডোনাল্ড ট্রাম্পের তালুবন্দী হলেও নারী কেলেঙ্কারির ঘটনা থেকে ছিটকে আসা কাদা ঠেকাতে পারেননি। ওই সময় অন্তত ২৫ জন নারী তাঁর বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন। ট্রাম্প কিন্তু বরাবরই তুড়ি বাজিয়েছেন—উড়ে যা যা, ফুঁ! একরকম ঘাড়ত্যাড়া ভাব নিয়েই নিজের কথা অটল থেকেছেন। দেশের লোকও যেভাবেই হোক, মেনে নিয়েছে তাঁকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী রয়েছেন।
না হলে হয়তো মোট ভোটের মধ্যে ৪২ শতাংশ নারীর ভোটই তিনি পেতেন না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও তিনি যেন এসব অভিযোগের বিষয়ে সরব হয়েছেন। বলছেন নারীবিরোধী বেফাঁস কথা। দেশের বিশিষ্ট নাগরিকেরা তাঁকে নারীর প্রতি সম্মান দেখাতে বলছেন।
অথচ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চান নারীর প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা আছে—এটা যেন সবাই বিশ্বাস করে। কিন্তু তাঁর কথা ও কাজে বিস্তর ফারাক। আদতে ট্রাম্প হয়তো দেশটিতে সবচেয়ে বেশি নারীবিরোধী প্রেসিডেন্ট।
সম্প্রতি হোয়াইট হাউস থেকে এক উপদেষ্টার পদত্যাগের পর ট্রাম্প যে ভাষণ দিয়েছেন, সেখান থেকে এটা স্পষ্ট। সাবেক দুই স্ত্রী কলবি হোল্ডারনেস ও জেনিফার উইলোবিকে নির্যাতনের অভিযোগে চলতি মাসের শুরুর দিকে হোয়াইট হাউসের দায়িত্ব ছাড়েন সেক্রেটারি অব স্টাফ রব পোর্টার। বিবিসি অনলাইনের খবরে জানানো হয়, এরই মধ্যে হোল্ডারনেসের স্বামীর নির্যাতনের প্রমাণস্বরূপ নিজের কালো চোখের ছবিও গণমাধ্যমে সরবরাহ করেছেন।
এর রেশ কাটতে না কাটতেই একই ধরনের অভিযোগে হোয়াইট হাউসের বক্তব্য রচয়িতা ডেভিড সোরেনসন পদ ছাড়ার ঘোষণা দেন।
কিন্তু এসব অভিযোগ সত্ত্বেও ট্রাম্প গত শুক্রবার এক বিবৃতিতে পোর্টারের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন। ট্রাম্প বলেন, ‘সে নির্দোষ। আমি মনে করি, এটা আপনারা মনে রাখবেন।’ এ কথা বলেই তিনি ক্ষান্ত দেননি। বলেন, ‘আমরা নিশ্চয়ই তাঁর মঙ্গল চাই। এখন তাঁর দুঃসময় যাচ্ছে...আমরা আশা, করি তাঁর সামনে বর্ণাঢ্য এক কর্মজীবন অপেক্ষা করছে।’
পোর্টারের কঠিন সময়! অথচ দুই নারীকে নিয়ে টুঁ শব্দটি ছিল না ট্রাম্পের মুখে। শুধু এতেই থামেননি ট্রাম্প, পরের দিন সকালে আবারও নির্যাতনের অভিযোগ ওঠা পুরুষদের পক্ষেই সাফাই গেয়ে টুইট করেন। টুইটে লেখেন, ‘নিছক কিছু অভিযোগে মানুষের জীবন চুরমার ও ধ্বংস হয়ে যায়। এর মধ্য কিছু সত্য ও কিছু মিথ্যা, কিছু পুরোনো, কিছু নতুন। কিন্তু যাঁর বিরুদ্ধ মিথ্যা অভিযোগ, তাঁর এ থেকে বাঁচার উপায় নেই। অথচ তাঁর জীবন ও ক্যারিয়ার শেষ। এখানে কি কোনো প্রক্রিয়া বলে কিছু নেই?’
দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের খবরে বলা হয়, পোর্টারের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ গত বছরের জানুয়ারিতেই জানত হোয়াইট হাউস। কিন্তু ট্রাম্প কি সেই বিষয়ে তদন্ত করেছেন?
এ ধরনের সমর্থন ট্রাম্পের জন্য নতুন কিছু নয়। ট্রাম্প সব সময়ই এ ধরনের অভিযোগ ওঠা পুরুষের পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছিলেন। ১৯৯৮ সালে মনিকা লিউনেস্কি কেলেঙ্কারি যখন খবরের শিরোনাম, তখনো ট্রাম্প তাঁর বন্ধু তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। বলেছিলেন, ক্লিনটন সত্যিকারের ‘ভুক্তভোগী’। এবং অভিযোগকারী মনিকা ‘ভয়ানক’ ও ‘অনাকর্ষণীয়’।
২০১৬ সালের এক ঘটনাকে এখানে উল্লেখ করা যায়। ফক্স নিউজের সাবেক প্রধান রজার অ্যালিসের বিরুদ্ধে ২৫ জন নারী যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছিলেন। তখনো ট্রাম্প রজারের পক্ষ নিয়েছিলেন। তিনি প্রথমে বলেছিলেন, ‘এই সব নারীর কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কারণ, আমি বলতে পারি, এখানে যারা অভিযোগ করেছ, তাদের অনেককে তিনি (রজার) কতটা সাহায্য করেছেন।’ বলেন, অ্যালিস ‘অত্যন্ত ভালো মানুষ’।
ট্রাম্প একই ধরনের কাজ করেন ২০১৭ সালেও। সেটাও ফক্স নিউজের বিল ও’ রেয়েলিকে ঘিরে। তাঁর বিরুদ্ধেও অভিযোগ ছিল যৌন হয়রানির। একপর্যায়ে তাঁকে বাধ্য হয়ে নিউজ চ্যানেলটিও ছাড়তে হয়েছে। এরপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বিল ওই সব নারীর সঙ্গে ১ কোটি ৩০ লাখ ডলার দিয়ে সবকিছু মিটমাট করে নেন। তখনো ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘বিল ভালো মানুষ। আমি মনে করি না বিল এমন কিছু করতে পারে।’
পর্নো তারকা স্টর্মি ডেনিয়েল ২০১১ সালে একটি ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ২০০৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর শারীরিক সম্পর্ক হয়। স্টেফানির মাইস্পেস অ্যাকাউন্টের একটি ছবিতে স্টেফানি ও ট্রাম্প। ছবিটি ২০০৬ সালের কোনো এক সময় তোলা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ছবি সংগৃহীত
পর্নো তারকা স্টর্মি ডেনিয়েল ২০১১ সালে একটি ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ২০০৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর শারীরিক সম্পর্ক হয়। স্টেফানির মাইস্পেস অ্যাকাউন্টের একটি ছবিতে স্টেফানি ও ট্রাম্প। ছবিটি ২০০৬ সালের কোনো এক সময় তোলা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ছবি সংগৃহীত
এবার ট্রাম্পের নিজের বিষয়ে আসা যাক। ২০১৬ সালে যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচার চলছে, তখন তাঁর বিরুদ্ধে অন্তত ২৫ জন নারী যৌন নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন। তখন ট্রাম্প প্রচার র্যালিতে তাঁর সমর্থকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, এসবই মিথ্যা। এমনকি গত বছর আলাবামা অঙ্গরাজ্যের সিনেট নির্বাচনেও ট্রাম্প নির্লজ্জের মতো রয় মোরের পক্ষ নেন। কয়েকজন নারীর অভিযোগ ছিল, তাঁরা যখন সদ্য কৈশোরে ছিলেন, তখন তাদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক ছিল মোরের। তবে মোর তা অস্বীকার করেন।
ট্রাম্প যে নারীবিরোধী, তা শুধু কথার কথা নয়। সিএনএনের মতামত পাতায় দীন ওবায়দেল্লাহ তাঁর লেখায় লিখেছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশই পুরুষ। অথচ ওবামার প্রথম মেয়াদে ৬০ শতাংশ ছিল পুরুষ। এমনকি ট্রাম্প ইউএস অ্যাটর্নি হিসেবে ৯৫ শতাংশ এবং জুডিশিয়াল নোমিনিজ হিসেবে ৮০ শতাংশ পুরুষকে বেছে নিয়েছে। ওবামার সময় এ সংখ্যা ৬০ শতাংশের কম ছিল।
এমনকি ওবামা নারী-পুরুষের বেতনবৈষম্য দূর করার যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তাও গত বছর বাতিল করার ঘোষণা দেন ট্রাম্প। এটা পরিষ্কার যে নারীরা আর ট্রাম্পকে বিশ্বাস করছেন না। গত নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ট্রাম্প ৪১ শতাংশ (এর মধ্য ৫২ শতাংশ ছিল শ্বেতাঙ্গ নারী) নারীর ভোট পেয়েছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি মারিস্ট জরিপে দেখা যায়, ট্রাম্প নারীদের আস্থা হারাচ্ছেন। নতুন এই জরিপে দেখা যায়, মাত্র ৩৩ শতাংশ নারী এখন তাঁর পক্ষে। তবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের যে কর্মকাণ্ড, তা ৫০ শতাংশ নারী সমর্থন করেন না।
সম্প্রতি বিল ও মেলিন্দা গেটস ফাউন্ডেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা মেলিন্দাও ট্রাম্পকে নারীদের সম্মান জানাতে আহ্বান জানান। তিনি এপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি আশা করি, আমাদের প্রেসিডেন্ট যখন কথা বলেন বা টুইট করেন, তখন মানুষকে সম্মান দেবেন। বিশেষ করে নারীদের বিষয়ে যখন কথা বলবেন, তখন বেশি সম্মান দেবেন।’
তাই আগামী নভেম্বরে দ্বিবার্ষিক নির্বাচনে নারীরা ট্রাম্পের নারীবিরোধী কথার জন্য রিপাবলিকান পার্টিকে ভালোই জবাব দেবেন বলে মনে করছেন দীন ওবায়দেল্লাহ।