আমাদের দেশের মানুষ বড়ই রসিক। কথায় কথায় রস ছড়ান। অনেকে দুঃখের সাগরে ভাসলেও রসের নাও ভাসাতে কসুর করেন না। কেউ কেউ আছেন নানা ধরনের তির্যক মন্তব্য করে নিজেদের রসিক সত্তার পরিচয় দেন। আবার আরেক দল আছেন যারা অন্যকে বোকা বানিয়ে নিজেদের ‘রসময়’ চরিত্রের প্রকাশ ঘটান। পাড়ার চায়ের দোকান থেকে শুরু করে অফিস ক্যান্টিন, ট্রেনের কামরা, এমনকী বাসর ঘরে পর্যন্ত একদল থাকেন, যাঁরা শুধুই অন্যকে বোকা বানিয়ে আনন্দ পান। আর তাঁরা কিছু কমন প্রশ্ন করেন। কিছু প্রশ্ন বোকা বোকা। কিছু চালাক চালাক। যেমন জলের নিচে কি কাঁদা যায়? মাছের কি কখনও জলতেষ্টা পায়? টাকা গাছে ধরে না, ব্যাংকও গাছ নয়। তবে শাখা থাকে কেন? ভাই, বাইরে কি বৃষ্টি হচ্ছে? চায়ের কাপে হ্যান্ডেল কোন দিকে থাকে? কোন চিল ওড়ে না? কোন মা কাঁদে না? কোন কিলে লাগে না? হোয়াট মানে কি? আপনার সাইকেলের চাকা ঘোরে! পৃথিবীটা কা র গোলাম?
এ রকম আরও অনেক রয়েছে। সেগুলো আপাতত তোলা থাক। তবে সব রসিকতার মান সমান হয় না। অনেকের কাছে অনেক স্থূলতাও রসিকতার মর্যাদা পায়। আবার অনেকের কাছে অনেক বুদ্ধিদীপ্ত রসও ঠিক রসিকতা হিসেবে বিবেচিত হয় না। অনেকে অবশ্য এখনকার রসিকতাকে ছ্যাবলামি বলে থাকেন। এটা যারা বলেন, তাদের আবার আঁতেল তকমা এঁটে দেওয়া হয়। আসলে গণসংস্কৃতিতে নিহিত রসবোধ ‘মোটাদাগের’ আর ইন্টেলেকচুয়াল রসবোধ অনেক সূক্ষ্ম ব্যাপার— এই সহজ সমীকরণ আজকের নয়। এর উৎস অতি প্রাচীন কালে। গোপাল ভাঁড়ের রসিকতাগুলোকে শিক্ষিত আঁতেল সমাজ কতটুকুই বা গ্রহণ করেন? আর আঁতেল সমাজের উপেক্ষায় তাঁর রসিকতাগুলো ঠিক কতটা গ্রন্থ সংকলিত হয়েছে, আর কতটা গণস্মৃতিতে ঘুরপাক খেতে খেতে হারিয়ে গিয়েছে, তা কীভাবে জানা যাবে?
গত পাঁচ-সাত বছরে বাঙালির প্রধান বিচরণ ক্ষেত্রটি একান্তভাবেই ভার্চুয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় তার পরিভ্রমণ সাবলীল হয়েছে ব্যাপক মাত্রায়। এই শিফ্ট-কে আড়চোখে ঠেরে আঁতেলেকচুয়ালরা পাঁচকথা বলতে ছাড়েন না, এ সত্যও কম্বলে আড়াল করে রাখা যাবে না। কিন্তু প্রশ্ন এখানেই। গোটা ফেসবুক জুড়েই কি বাঙালি তার গণসমাজের তলায় জমে থাকা অখাদ্য এবং বিলো দ্য বেল্ট রসিকতাগুলোকে ফেসবুকস্থ করে আত্মপ্রসাদ লাভের একটা খোলা মাঠ করে ছেড়েছে? না কি, ফেসবুকের মতো খুল্লমখুল্লা ‘গণ’-মাধ্যমে দেখা মিলতে পারে স্মার্ট আর সাট্ল রসবোধের। এমন রসবোধ, যাকে ‘ছ্যাবলামি’ বলা গেলেও যেতে পারে, কিন্তু কিছুতেই ‘বাতিল’ বলে এড়িয়ে যাওয়া বোধ হয় যাবে না।
যেমন সেদিন একজন লিখেছেন, আগে বাঙালিকে জুতা দেখালেই কাজ হতো। এখন জুতা মারলেও খুব একটা কাজ হয় না। সে জুতার বাড়ি খেয়ে ওই জুতাটা প্লাস্টিক, রেক্সিন না চামড়ার ছিল, সে বিষয়ে আলোচনা শুরু করে দেয়! আসলেই যুগ বদলেছে। সঙ্গে বদলেছে বাঙালির অনুভব-অনুভূতিও।
যেমন বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পর বেশির ভাগ মানুষের মনে প্রশ্ন ছিল তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না। তার সঙ্গে যে একজন পরিচারিকা পাঠানো হয়েছে (যদিও জেল কর্তৃপক্ষ সেই পরিচারিকাকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে থাকাটাকে অনুমোদন করেনি), সেই পরিচারিকা বিনা দোষে কেন জেল খাটবেন, এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে বেশি। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এতিমদের নাম করে নিয়ে নিয়ে আসা টাকা আত্মসাৎ করেছেন, এ জন্য তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে দণ্ডিত হয়েছেন, এটা অনেকের কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার মনে হয় নি। অনেকে অবশ্য ‘এই সামান্য টাকা’ নিয়ে সাজা প্রদানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।
বর্তমান সরকারের আমলে সংঘটিত বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগকে এই ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে ঘোল পাকিয়েছেন অনেকে। অনেকে আবার খালেদা জিয়ার দুর্নীতির সঙ্গে শেয়ারবাজার-ব্যাংকিংখাতের লুটপাটকে মেলানোটা এক ধরনের মতলববাজি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাদের মতে, খালেদার দুর্নীতিকে লঘু করে দেখা, এই দুর্নীতির সঙ্গে অন্য কোনো ইস্যুকে মিলিয়ে ফেললে সেটা হবে চরম ভুল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে হলে খালেদা জিয়ার দুর্নীতি নিয়ে পরিষ্কারভাবে কথা বলা উচিত। দেশের একজন শীর্ষনেত্রী দুর্নীতিবাজ হলে সেটি দেশের লজ্জা। বেগম খালেদা জিয়া দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। একবার না- দুইবার। তিনি দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান, যিনি আবারো প্রধানমন্ত্রী হতে চান। বেগম খালেদা জিয়া যদি ১ টাকার দুর্নীতি করেন- সেটি হাজার কোটি, লক্ষ কোটি টাকার দুর্নীতির চেয়েও বেশি ক্ষতিকর।
তবে বেগম জিয়ার জেলে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে সবচেয়ে আলোচিত মন্তব্যটি করেছেন জাতীয় পার্টির একজন এমপি। কারাগারে থাকা অবস্থায় জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের লাগানো গাছের বরই খালেদা জিয়াকে খেতে দিতে কারা কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়েছেন এই এমপি। গত ৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ইয়াহইয়া চৌধুরী এ অনুরোধ জানান।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আদালত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার পর তাকে রাজধানীর নাজিম উদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একসময় এই কারাগারে বন্দি ছিলেন জাপা চেয়ারম্যান এরশাদও।
‘ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না’ মন্তব্য করে ইয়াহইয়া চৌধুরী বলেন, ‘বেগম জিয়া একদিন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে বিনা অপরাধে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, সেই জেলখানায় এখন খালেদা জিয়া! ২৮ বছর আগে কারাগারে থাকা অবস্থায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একটি বরই গাছ লাগিয়েছিলেন। সেই গাছে এখন বরই ধরেছে। কারাবিধান অনুযায়ী, এই বরই খাওয়া যাবে কিনা, জানি না। সুযোগ থাকলে খালেদা জিয়াকে সেই বড়ই খেতে দেওয়া হোক।’
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কারাগারে গিয়ে বরই গাছ কেন লাগিয়েছিলেন, সেটা আমরা জানি না। আর জাতীয় পার্টির এমপি ইয়াহইয়া চৌধুরী কেন বেগম জিয়াকে সেই গাছের বরই খাওয়ার প্রস্তাব এনেছেন, সেটাও একটা রহস্য বটে!
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কারাগারে থাকাকালে বরই গাছ লাগানোর একটি কারণ হতে পারে— কোনো রকম যত্নআত্তির বালাই ছাড়াই গাছটি বছরের পর বছর দিব্যি বেঁচে থাকে। জেলখানায় গাছের যত্ন ঠিক মতো হবে না মনে করে তিনি বরই গাছটি লাগিয়ে থাকতে পারেন। আর বরই গাছে অনেক কাঁটাও থাকে। মনের গহীন কোণে বরই কাঁটায় প্রতিপক্ষকে বিদ্ধ করার একটা গোপন অভিলাষ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের থাকাটাও অসম্ভব নয়!
ফেসবুকে একজনকে দেখলাম এই বরই গাছ নিয়ে অনেক প্রশ্ন করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘এরশাদ যে বরই গাছটা লাগিয়েছিলেন, সেটা কি ধরনের বরই। অর বরই, চুক্কা (টক) বরই, আপেল কুল, বাউকুল, থাই বরই, নাকি অন্য কোনো জাতের বরই?’’
‘‘আর যাকে এই বরই খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, তার দাঁত কি ঠিক আছে?’’ অতঃপর তিনি বরই খাওয়ার কয়েকটি উপায়ও বাতলে দিয়েছেন। যেমন: ‘‘চুক্কা (টক) বরই হলে ছোট পুটি ও টেংরা মাছ দিয়ে “ঢেল-ঢেলা (পাইন্না)” ঝোল রেধে খাওয়া যেতে পারে।
আর দেশি জাতের বরই হলে হামালদিস্তা বা ছেচনি দিয়ে ছেচে একটু নুন-গুড়-চিনি-মরিচ দিয়ে মাখিয়ে খাওয়া যেতে পারে।’’
তবে রাজনীতির মানুষেরা বরই নিয়ে, বরই গাছ নিয়ে যা কিছুই করুক বা বলুক না কেন এই গাছ কিন্তু একসময় অবহেলাতেই বেড়ে উঠত। এখন কিন্তু বরইয়ের সেই দিন আর নেই। বরইয়েও এখন ‘উন্নয়ের জোয়ার’ লেগেছে। বড় যত্ন করে চাষ করা হয়। ফলটি যেমন অর্থকরী, তেমনি পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। পুষ্টি ও পথ্যবিদদের মতে, বরইয়ে ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়ামসহ আছে নানা কিছু। রোগ প্রতিরোধে যেমন ভূমিকা রাখে, অন্যদিকে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও বাড়িয়ে দেয়। বরই সবার জন্য ভালো হলেও ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য কিন্তু নয়। পাকা বরইয়ে চিনি থাকে, তাই ডায়াবেটিসের রোগীদের পাকা বরই না খাওয়াই ভালো। আর যাঁদের শ্বাসকষ্ট আছে, কাঁচা বরই বেশি খেয়ে ফেললে তাঁদের শ্বাসকষ্ট কিন্তু বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
বরইয়ের আরও কিছু অনন্য গুণ আছে। যেমন: বরইয়ের উপাদানগুলো শরীরে শক্তির জোগান দেয়। অবসাদ কেটে যায় দ্রুত। বরই অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ। এটি যকৃতে সুরক্ষা বর্ম তৈরি করে এবং ক্যানসারের বিরুদ্ধেও লড়তে পারে। বরই বয়সের ছাপ পড়তে বাধা দেয় শরীরে। ত্বকের রুক্ষতা দূর করে ত্বককে কোমল করে বরই। রোদে পোড়া ত্বক সুরক্ষার কাজেও কার্যকর।
ক্ষুধাবর্ধক এবং হজমে বরই কোষ্ঠকাঠিন্যসহ অন্যান্য হজমজনিত সমস্যার সমাধান করে। ক্ষুধাবর্ধক হিসেবে কাজ করে। বরই একই সঙ্গে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসসমৃদ্ধ হওয়ায় হাড় গঠনে এবং দাঁতের সুরক্ষায় ভূমিকা রাখে।
কাজেই আসুন, আমরা বেশি বেশি বরই খাই, বরই গাছ লাগাই!
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: বরইয়ের কাঁটা ও রাজনৈতিক বরই থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকুন!