তুহিন সানজিদ : কতদিন মা বলে ডাকি না। মায়ের স্পর্শ পেতে, মাকে ছুয়ে দেখতে খুব ইচ্ছে করে। মাকে খুব মনে পড়ে, প্রতিটি মুহুর্তে। কথাগুলো বলছিলেন নিউইয়র্কের পরিচিত মুখ বিশিষ্ট সাংবাদিক মঈনুদ্দিন নাসের। মায়ের র্স্মতিচারণ করতে গিয়ে চোখ ভিজে আসে তার। ছোটবেলায় মা হারানোর স্মৃতি হাতড়ে বালেন ” মা” পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর ডাক। মা কি জিনিষ এটা যখন বুঝতে শিখেছি ঠিক তখনি জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সম্পদটি হারিয়েছি। বুঝতে পারলাম আনেক বড় কিছু হারিয়ে ফেলেছি আমার জীবন থেকে। তারপর থেকে আমার জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনা। তিন বছর আর লেখাপড়ায় মন বসাতে পারিনি। পড়াশোনার মধ্যে ১২ বছর আমার ’ব্রেক অফ স্টাডি ছিল ’ সেটা শুধুমাত্র অকালে মাকে হারানোর কারণেই। পৃথিবীর কোনো কিছুই ভালো লাগতো না, সবসময় মায়ের মুখটা সামনে ভাসতো। পড়াশোনায় মন বসতো না। আমি কেমন যেন অস্বাভাবিক হয়ে হিয়েছিলাম। সেখান থেকে নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে আমার ১২বছর সময় লেগেছে।
মঈনুদ্দিন নাসেরের জন্ম চট্টগ্রামের চন্দনাইশে। বাবা কাজী আব্দুস শাকুর ও মা সানোয়ারা বেগমের প্রথম সন্তান তিনি। স্কুল জীবন থেকেই বাম রাজনীতির জড়িয়ে পড়া নাসের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেন। ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামের স্থানীয় পত্রিকা ” সাপ্তাহিক সমাজ ” এর মাধ্যমে তার সাংবাদিকতার যাত্রা শুরু। এরপর ডেইলি লাইফ এ স্পোর্টস রিপোর্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকা চলে যান তিনি। মেডিকেল জার্নাল ”দি পালস ” এ কাজ শুরু করেন। এরপর ঢাকা কুরিয়ার, ফ্রাইডে, দৈনিক জনতা, টেলিগ্রাফ এবং পরে ওই সময়ের বিখ্যাত পত্রিকা ” হলিডে”র বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৪ সালে ফেলোশিপ নিয়ে তিনি মার্কিন কংগ্রেসে কাজ করেন। পওে তিনি যোগদান করেন দেশের অন্যতম বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক ” ডেইলি স্টার” এ। এরপর ডেইলি ইনডিপেনডেন্ট। ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশ ছেড়ে আমেরিকায় পাড়ি জমানোর আগে তিনি এই পত্রিকার সিটি এডিটর ছিলেন। বর্তমানে তিনি নিউইয়র্ক সিটির সরকারি কর্মকর্তা।
মাকে নিয়ে আলাপচারিতায় তিনি বলেন, মাত্র ১৪ বছর বয়সেআমার মায়ের বিয়ে হয়। আমার যখন জন্ম হয় তখন তিনি কিশোরী। তারপর আমার আরো ছয় ভাইবোনের জন্ম। এত অল্প বয়সে সংসার সামলেছেন, আমাদের পড়াতেন তিনি নিজে। বাসায় কোনো গৃহশিক্ষক রাখার দরকার হয়নি। অথচ তিনি মাত্র নবম শ্রেনী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। গ্রামের সবার কাছে আমার মা ছিলেন অত্যন্ত প্রিয় মানুষ। কারো কোনো সমস্যা হলেই ছুটে আসতো আমার মায়ের কাছে। ব্যাক্তিগত, পারিবারিক সব ধরনের সমস্যার সমাধান তাকেই করতে হতো।
তিনি বলেন, ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়াটা বাবা পছন্দ করতেন না। কিন্তু মা আমার বাবাকে বুঝিয়েছিলেন, রাজনীতি করে যা শিখতে পারবে, তা পড়াশোনা করে শিখতে পারবে না। তিনি ছিলেন অত্যন্ত তীক্ষè বুদ্ধিসম্পন্ন একজন মানুষ। রাজনীতির প্রতি তার অন্যরকম ভালোবাসা ছিল কারণ আমার নানা রাজনীতি করতেন।
তিনি বলেন, আমার মা ছিলেন আমার জীবনের অন্যতম শিক্ষক। সব আবদার তার কাছেই করতাম। তিনিই আগলে রাখতেন আমাকে। ছোটবেলা থেকেই তিনি আমাকে শিখিয়েছেন মিথ্যা কথা না বলতে। সবসময় মা বলতেন ” জীবনে টাকা-পয়সা, সম্পদের প্রয়োজন আছে কিন্তু কাউকে ক্ষতি করে সম্পদের মালিক হওয়ার দরকার নেই ”।
স্মৃতিকাতর প্রবীন এই সাংবাদিক বলেন, ১৯৭৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার আগে সন্তান জন্মদানের সময় মাত্র ৩৩ বছর বয়সে আমার মা মারা যান। এরপর আমার জীবনটা একেবারে তছনছ হয়ে যায়। জীবন চলার পথ হারিয়ে ফেলি। কি করবো, কোথায় যাবো এতটুকু সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাও ছিল না। লেখাপড়া করতে পারতাম না। চার বছর পর পরীক্ষা দেই। এরপর পড়াশোনা শেষ করার আগে ১২ বছর আমার ’ব্রেক অফ স্টাডি ছিল ’। সেটা শুধুমাত্র অকালে মাকে হারানোর কারণেই। বৃদ্ধ বয়সে এসেও মনে হয় মাকে হারানোর পর সেই এলোমেলো জীবনটা আজও হয়তো ঠিক করতে পারিনি। এখনও সবখানে মাকে খুঁজি।
তিনি বলেন, নবম শ্রেনিতে পড়ার সময় বাবা আামাকে চট্টগ্রাম শহরে রেখে আসার সিদ্ধান্ত নেন। মা এই সিদ্ধান্তে খুশি হতে পারেননি। তিনি চাইতেন তার কাছে থেকে আামি গ্রামেই পড়াশোনা করি। কিন্তু বাবা একপ্রকার জোর করেই আমাকে শহরে নিয়ে যান। যেদিন আমাকে বাড়ি থেকে চট্টগ্রাম নিয়ে যাচ্ছিলেন- সেদিন অন্যদিনের মতো মা আমাকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসেননি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। যতবার পিছন ফিরে দেখেছি মা আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন আর বারাবার আঁচল দিয়ে চোখ মোছেন। মায়ের অশ্রুভেজা করুণ চোখের চাহনির সেই দৃশ্য আজও ভুলতে পরিনি। এটুকু বলতে বলতে কন্ঠ থেমে আসে মঈনুদ্দিন নাসেরের। দু’চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রু লুকাতে ফিরে তাকান অন্যদিকে। আর কথা বলতে পারেননি তিনি। একসময় চেয়ারে হেলান দিয়ে তাকিয়ে থাকেন উপরের দিকে। দু’চোখের কোণা দিয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে অবাধ্য অশ্রু। মা হারা সন্তানের চোখের পানি মনে হয় এমনই-বাধা মানে না।