প্রথমে তাদের গ্রাম পুড়িয়ে ছাই করা হয়েছে। এখন মিয়ানমার সরকার আক্ষরিক অর্থেই তাদেরকে পৃথিবী থেকে একেবারে মুছে ফেলার জন্য বুলডোজারসহ ভারি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ব্যাপক আকারের হত্যাযজ্ঞের গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণাদি নষ্ট করছে কর্তৃপক্ষ।
শুক্রবার মিয়ানমারের সহিসংতা কবলিত রাখাইন রাজ্যের স্যাটেলাইট ছবি প্রকাশ করেছে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস। এসব ছবি সংগ্রহ করেছে কলোরাডোভিত্তিক ডিজিটাল গ্লোব। এসব ছবিতে দেখা গেছে, গত কয়েক সপ্তাহে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ অনেকগুলো গ্রাম বুলডোজার দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর আগে যেসব খবর প্রকাশ হয়েছিল এ বিষয়ে সেগুলোর চেয়ে এবারকার ভয়াবহতা ছিল বেশি। গত বছর ২৫ আগস্টের পর সেনাবাহিনী সহিংসতা তীব্র করলে রোহিঙ্গা গ্রামগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। নৃশংস ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের’ মুখে ৬ লাখ ৮৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেয়।
মিয়ানমার সরকার দাবি করছে, তারা এলাকাটিতে বড়ধরনের পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেছে। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ অভিযানে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের দাবি, বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত শুরু হওয়ার আগেই মিয়ানমার সরকার ঘটনাস্থলে অপরাধের প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করছে। বুলডোজার দিয়ে নিশ্চিহ্ন করার ঘটনায় আতঙ্কিত রোহিঙ্গারাও। তারা মনে করছেন, সরকার ইচ্ছাকৃতভাবেই রোহিঙ্গা সংস্কৃতির অবশিষ্ট ধ্বংস করছে। যাতে করে রাখাইনে নিজেদের গ্রামের তাদের ফেরা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
অগ্নিসংযোগে বাড়িঘর পুড়ে যাওয়ায় গৃহহারা এক রোহিঙ্গা নারী সম্প্রতি তার গ্রাম মুইন হ্লাত গিয়েছিলেন। সেখানে যা দেখেছেন তাতে তিনি হতবাক হয়ে গেছেন। গ্রামটির বেশিরভাগ বাড়িঘর গত বছর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। জুবাইরিয়া নামের ওই নারীর ভাষায়, ‘কোনও কিছুই নেই, এমনকি গাছও নেই। তারা বুলডোজার দিয়ে সবকিছু নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে। অনেক চেষ্টা করেও কিছুই চিনতে পারছি না’।
১৮ বছরের এই নারী জানান, ওই এলাকার কিছু বাড়িঘর পরিত্যক্ত ছিল কিন্তু খুববেশি ক্ষতিগ্রস্ত ছিল না। সেগুলোও এবার ধূলিস্যাৎ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার যেসব স্মৃতি ছিল সেগুলো এখন আর নেই। সবকিছু মুছে ফেলা হয়েছে।’
স্থানীয় বৌদ্ধদের সহযোগিতায় রোহিঙ্গাদের গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়াই শুধু নয়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ ও গণহারে লুটতরাজ চালানোর অভিযোগ রয়েছে।
আকাশ থেকে তোলা রাখাইনের প্রথম ছবি প্রকাশিত ৯ ফেব্রুয়ারি। ওই সময় মিয়ানমারে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) দূত ক্রিস্টিয়ান উড়োজাহাজ থেকে তোলা ছবি প্রকাশ করেন। তিনি মংডুর দক্ষিণাঞ্চলের ওই এলাকাকে ‘বুলডোজারে গুড়িয়ে দেওয়া বিস্তৃত’ এলাকা বলে বর্ণনা করেন।
ডিজিটাল গ্লোবের স্যাটেলাইট ছবিতে অন্তত ২৮টি গ্রাম বুলডোজার ও অন্যান্য যন্ত্র দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। ৩০ মাইল এলাকাজুড়ে মংডুতে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারিতে এ কর্মকাণ্ড চালায় মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। গুড়িয়ে দেওয়া কিছু এলাকায় নির্মাণ শ্রমিকরা নতুন ভবন ও ঘরের কাঠামো এবং হেলিপ্যাড নির্মাণ করছে। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পক্ষ থেকেও শুক্রবার ৫৫টি গ্রাম বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়ার কথা জানানো হয়েছে।
বহির্বিশ্বের মানুষের প্রবেশাধিকার না থাকা মিয়ানমারের ওই অঞ্চলের পরিস্থিতি অনুধাবনের জন্য এসব ছবি গুরুত্বপূর্ণ। রাখাইনে স্বতন্ত্র সংবাদমাধ্যমের প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
সরকার কয়েক মাস ধরেই পুনর্গঠন পরিকল্পনার কথা বলে আসছে। সড়ক নির্মাণ, সেতু মেরামত ও আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে ব্যস্ততার কথা জানিয়ে আসছে মিয়ানমার। বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে বেশ কয়েকটি অস্থায়ী ট্রানজিট শিবিরও নির্মাণ করছে দেশটি। জানুয়ারিতে এই অস্থায়ী শিবির চালু হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের প্রাথমিকভাবে রাখা হবে এসব শিবিরে। তবে এখন পর্যন্ত কোনও রোহিঙ্গা ফেরত যাননি, উল্টো আরও রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশ আসছেন।
মংডুর স্থানীয় প্রশাসনের এক কর্মকর্তা মুইন্ট খাইন বলছেন ‘নতুন নির্মিত কিছু বাড়ি মুসলিমদের জন্য বানানো হচ্ছে’। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বা এ পর্যন্ত সরকারের যে পরিকল্পনা তাতে এই দাবির সত্যতা মিলছে না। অনেক রোহিঙ্গাই আশঙ্কা করছেন, তারা ‘কয়েক প্রজন্ম ধরে যে স্থানে বাস করছিলেন কর্তৃপক্ষ সেসব স্থান দখল করছে’।
২০১৭ সালে ডিসেম্বরে সরকার একটি তালিকা প্রকাশ করে। এতে ইঙ্গিত দেওয়া হয় ৭৮৭টি বাড়ি নির্মাণ করা হবে। এসব বাড়ির বেশির ভাগ বৌদ্ধ ও হিন্দুদের জন্য। এর মধ্যে মাত্র ২২টি বাড়ি ‘বাঙালিদের’ জন্য বরাদ্দ। মিয়ানমারের জাতীয়তাবাদীরা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী ও বাঙালি বলে বিবেচনা করে।
মুইন্ট খাইন জানান, সরকারের অন্য কোনও মোটিভ নেই। তিনি বলেন, ‘অবশ্যই আমরা আর্থ রিমুভার ও বুলডোজারের মতো যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছি। কারণ নতুন বাড়ি নির্মাণের আগে আমাদের জমি পরিষ্কার করতে হবে।’
রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর অবস্থা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আরাকান প্রজেক্টে’র ক্রিস লেভা জানান, যেভাবে রোহিঙ্গা গ্রামগুলো নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে তাতে করে নাগরিকত্ব না থাকা রোহিঙ্গাদের পক্ষে নিজেদের ভূমির মালিকানা দাবি করা কঠিন হয়ে পড়বে।
তিনি বলেন, ‘যেখানে তারা (রোহিঙ্গা) বাস করত সেই জায়গার মালিকানা কীভাবে তারা দাবি করবে যদি কিছুই থাকে না চেনার মতো? তাদের সংস্কৃতি, তাদের ইতিহাস, তাদের অতীত, তাদের বর্তমান– সবকিছুই মুছে ফেলা হয়েছে। আপনারা যখন ছবিগুলো দেখবেন তখন স্পষ্ট হয়ে যাবে যে মসজিদ, গোরস্থান ও বাড়ি অবশিষ্ট ছিল সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।’
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মিয়ানমার বিশেষজ্ঞ রিচার্ড ওয়েইর জানান, স্যাটেলাইট ছবিগুলো তিনি দেখেছেন। তাতে এখন আর কোনও ভূমির সীমানা নেই, গাছপালা ও বৃক্ষ নেই। সবকিছু মুছে ফেলা হয়েছে এবং তা ভয়াবহ উদ্বেগের। কারণ এসব স্থান ছিল অপরাধের ঘটনাস্থল। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলমান হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়নের কোনও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত হয়নি। ফলে যেটা নিয়ে আমরা কথা বলছি তা সত্যিকার অর্থে ন্যায়বিচারের পথে বাধা তৈরি করা।
ওয়েইর ও লেবা উভয়েই জানান, যেসব গণকবরের কথা জানা গেছে সেগুলো নিশ্চিহ্ন করা হয়নি। কিন্তু আমরা জানি না সবগুলো গণকবর কোথায় রয়েছে। কারণ সেখানে আমাদের প্রবেশ করার অনুমতি নেই।
সাক্ষাৎকারে পরিচয় প্রকাশ পেলে হামলার আশঙ্কার কথা জানিয়ে জুবাইরি নামের একটি অংশ ব্যবহার করার অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন না নতুন বাড়িগুলো রোহিঙ্গাদের জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে। বলেন, ‘এমনকি তারা যদি আমাদের ছোট্ট ঘরে থাকতেও দেয় তবু তা আগের মতো হবে না। আমাদের ভূমি থেকে বাড়িঘর নিশ্চিহ্ন করার পর কী করে আমরা খুশি থাকব?’
তথ্যসূত্র: এপি।
নিউইয়র্ক মেইল/মিয়ানমার/২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/এইচএম