স্থাপত্য ঐতিহ্যের দিক থেকে বিশ্বব্যাপী ভারতের বিশেষ সুনাম রয়েছে। দীর্ঘকাল যাবৎ মুসলিম শাসকরা ভারতবর্ষ শাসন করেছেন। ভারতের সর্বত্রই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মুসলিম শাসকদের নির্মিত প্রাসাদ, অট্টালিকা, কেল্লা, মসজিদ, সমাধিসৌধ, সরাইখানা, মাজার, প্রমোদ উদ্যান, স্থাপত্য ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ ভারতের এমনই একটি শহর লক্ষ্ণৌ। শহরের দালানগুলোর চূড়ায় আছে একাধিক গম্বুজ আকৃতির স্থাপত্য। এজন্য অনেকেরই কাছে এ শহরটি মসজিদের শহর নামে পরিচিত। দিল্লীর নিকটে অবস্থিত লক্ষ্ণৌ মূলত দু'ভাগে বিভক্ত। নতুন আর পুরনো অংশ। লক্ষ্ণৌর পুরনো অংশই মূলত ভ্রমণপিয়াসী মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
ইতিহাস:
লক্ষ্ণৌ নামকরণ নিয়ে দু’ধরনের মতবাদ আছে। কিংবদন্তি শ্রীরামের ভাই লক্ষ্মণের রাজধানীর নাম ছিল লক্ষ্মণপুরা বা লক্ষ্মাণাব্রত। আর সেই থেকেই এসেছে লক্ষ্ণৌ শব্দটা। গোমতী নদীর তীরে উত্তরপ্রদেশের রাজধানী লক্ষ্ণৌতে প্রবেশ করলেই নবাবি আমেজ মনকে গ্রাস করে।
কীভাবে যাবেন:
ট্রেন: কলকাতা বা হাওড়া থেকে ট্রেনে জম্মু তেওয়াই এক্স:, হাওড়া-দেরাদুন উপাসনা এক্স:, হাওড়া অমৃতসর এক্স:, হাওড়া অমৃতসর মেল প্রভিতি ছাড়াও অনেকগুলো ট্রেন পাবেন।
বাসে: এলাহাবাদ সিভিল লাইনস বাস ষ্ট্যান্ড থেকে (২৬০১২৫৭) প্রতি ঘন্টায় (কখনও আধঘন্টা থেকে ৪০ মি: অন্তর) পাবেন লক্ষ্ণৌর বাস। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি এসি বাসও আছে। দুরত্ব ২৩৭ কিমি, সময় নেয় কমবেশি ৫ ঘন্টা। এছাড়াও প্রচুর শেয়ার টাটাসুমো পাওয়া যায়।
প্লেনে: লক্ষ্ণৌ (Amausi Intl. Airport (LKO)) বিমানবন্দর শহরের কেন্দ্র থেকে ১৩ কিমি দূরে অবস্থিত। দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা, বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদ ও বিশাখাপত্তনম যেতে প্রতিদিন ছারে এয়ার ইন্ডিয়া লিমিটেড, জেট এয়ারওয়েজ, কিংফিশার এয়ারওয়েজ, সৌদি আরবিয়ান ইয়ারলায়ন এয়ার সাহারা এবং ইন্ডিগো।
কোথায় থাকবেন:
পযর্টকদের প্রিয় শহর লক্ষ্ণৌতে পাবেন অতি সাধারণ লজ বা ধর্মশালা থেকে মাঝারি ও ভালো মানের হোটেল।
ধর্মশালা:
লক্ষ্ণৌ (চারবাগ) স্টেশনের অদুরে (এম জি স্টেশনের সামনে) চারবাগে মুন্নিলাল কাগজি ধর্মশালা।
চারবাগ নিউ মার্কেটে মুসলিম মুসাফিরখানা।
এক কিমি দূরে নাকা হিন্দোলায় বিনায়ক ও শীতল ধর্মশালা।
২ কিমি দূরে আমিনাবাদে ছেদিলাল ধর্মশালা।
৫ কিমি দূরে কিং জর্জ মেডিকেল কলেজের কাছে চৌক এলাকায় লালা ভোলানাথ ও শাহ্গঙ্গা প্রসাদ ধর্মশালা।
কাইজারবাগে শুভম সিনেমার কাছে ঘাসিয়ারি মান্দিতে লখনউ কালীবাড়ি-যাত্রীনিবাস।
লক্ষ্ণৌ পর্যটন বিভাগের বাংলো: রাহী হোটেল গোমতী (২৬২০৬২৪/২৬১২২৯১/২৬১৪২৮৪)
উত্তরপ্রদেশের এই রাজধানী শহরে সাধারণ মান থেকে বিলাসবহুল হোটেল সবই পাবেন।
কী দেখবেন:
লক্ষ্ণৌ শহরের দর্শনীয় স্থানগুলো একদিনে অটো ভাড়া করে দেখে নেওয়া যায়। যদি আপনি এই নবাবি শহরে দু’রাত কাটাতে চান, তবে দ্বিতীয় দিন গাড়ি ভাড়া করে বেড়িয়ে আসতে পরেন কানপুর ও বিঠুর থেকে। প্রথমে লক্ষ্ণৌ শহর থেকেই শুরু করা যাক।
১. বড়া ইমামবাড়া: ১৭৮৪ সালে ভংকর দুবিক্ষের সময় নবাব আসফউদ্দোলা প্রজাদের কাজের বিনিময়ে অর্থ ও আহার দানের সিদ্ধান্ত নিলেন। রাজকোষ থেকে অকাতরে অর্থখরচের বিনিময়ে গড়ে উঠল বড়া ইমামবাড়া ও আসফি মসজিদ। বড়া ইমামবাড়ার প্রধান বৈশিষ্ট হল কোনও কড়ি-বরগা বা স্তম্ভের ব্যবহার ছাড়া নির্মাণ করা হয়েছে সুবিশাল (৫০ ফুট ) সেন্ট্রাল হল ও ছাদের অংশে অভিনব ভুলভুলাইয়া।
২. ছোটা ইমামবাড়া: নবাব মহম্মদ আলী শাহ (১৮৩৭-৪২) নির্মিত হোসনাবাদ ইমামবাড়ার জনপ্রিয় নাম ছোটা ইমামবাড়া। এখানকার মুখ্য আকর্ষণ বেলজিয়াম কাঁচের ঝাঁড়বাতি এবং সোনার পাত দিয়ে ধার বাঁধানো আয়না।
৩. রুমি দরওয়াজা: ১৭৮৬ সালে নবাব আসফউদ্দোলা ৬০ ফুট উঁচু এই গেটওয়ে নির্মান করান প্রাচীন কনস্টান্টিনোপাল-এর একটি দরজার অনুকরণে।
৪. হোসনাবাদ পিকচার গ্যালারি: নবাব মহম্মদ আলিশাহের তৈরি এই বারদয়ারি হাভেলিতে দেখবেন অবোধের বিভিন্ন নবাবদের লাইপ সাইজ পোট্রেট। কাছেই দেখবেন ২২১ ফুট উঁচু হোসনাবাদ ক্লক টাওয়ার। ইউনাইটেড প্রোভিন্সের প্রথম লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার জর্জ কাউপারের আগমন উপলক্ষে এক লক্ষ পঁচাত্তর হাজার টাকা ব্যয়ে এটি নির্মিত হয় ১৮৮৭ সালে।
৫. রেসিডেন্সি: ১৭৮০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে নির্মিত ব্রিটিশ রেসিডেন্টদের এই প্রাসাদপম আবাস আজ ভগ্নদশাপ্রাপ্ত হলেও খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা আছে। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রহের ছাপ রেসিডেন্সির প্রতিটি দেওয়ালে দেখতে পবেন। কামানের অসংখ্য গোলা এবং দেওয়ালে গোলা ও বুলেটের চিহ্ন সুস্পষ্ট।
এই প্রধান দর্শনীয় স্থনগুলো ছাড়াও লক্ষ্ণৌতে দেখবেন-
দিলখুশ প্যালেস
জামা মসজিদ
লা-মাটিনিয়ার
কেসববাগ প্যালেস কমপ্লেক্স
ছত্তরমঞ্জিল
মোতিমহল
সিকান্দারবাগ ও মিউজিয়াম।
দ্বিতীয় দিন গাড়ি ভাড়া করে দেখে আসুন কানপুরের বিখ্যাত-
জুলজিকাল গার্ডেন
জেকেগ্লাস টেম্পেল
তপেশ্বরী দেবীমন্দির
পাঙ্কি হনুমান মন্দির
আনন্দেশ্বর মন্দির
কানপুর থেকে আরও ২২ কিমি দূরে গঙ্গার ধারে পৌরণিক বিঠুর নগরী। পুরাণমতে মহাপ্রলয়ের পর সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা বিঠুরে অবস্থান করে নতুন করে গড়ে তুলেছিলেন এই মহাবিশ্ব। বিঠুরই সেই পবিত্র ভূমি যেখানে দীর্ঘ তপস্যার পর মহাকবি বালমীকি রামায়ণ রচনা করেন। শ্রীরাম বিঠুরের বালমীকি আশ্রমে সিতাদেবীকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন এবং এখানেই জন্ম হয় লব কুশের।
পায়ে হেটেই বিঠুরের স্পটগুলো ঘুরে দেখা যায়-
বালমীকির আশ্রম
সীতাকুণ্ড (লোকে এখানেই জানকী পাতালে প্রবেশ করেন),
পবিত্র ব্রহ্মাবর্ত ঘাট (এখানে পিতামহ ব্রহ্মার খরমবেদিকে পুজো করা হয়),
পদ্মর ঘাট
জানকী মন্দির
লব-কুশ মন্দির
ধ্রুব টিলা (বলা হয় এখানেই বালক ধ্রুব একপায়ে দাড়িয়ে দীর্ঘ তপস্যা করেছিলেন),
নানাসাহেবের স্মারক (মহাবিদ্রহের নায়কের বিধ্বস্ত প্রাসাদ ও স্টাচু)।
কী কেনাকাটা করবেন :
লক্ষ্ণৌতে চিকেনের ও জরির কাজ, ঘর সাজানোর জিনিষ, আতরখস ইত্যাদি কেনার জন্যে চার বাগের নিউ মার্কেট, চৌক বাজার (শুক্রবার বন্ধ) কিংবা হজরতবাগের গভ:ইমপোরিয়াম (রবিবার বন্ধ)।
প্রয়োজনীয় তথ্য ও ফোন নাম্বার-
ছত্রপতি সাহুজি মহারাজ মেডিকেল কলেজ-২২৬৫৬১৪, ২২৬৬১৭৫, ২২৬৮৭০১, শ্যামপ্রসাদ মুখার্জি সিভিল হসপিটাল-২২২৪৬৩৬,২২২৯৫৬৮, টুরিস্ট অপিস ২৬৩৮১০৫/২৩০৮৯১৬।
নিউইয়র্ক মেইল/কলকাতা/২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/এইচএম