logo
আপডেট : 27 February, 2018 12:49
বাংলাদেশে ভ্রমন
চিরহরিৎ বনের স্বাদ পাবেন লাউয়াছড়া অভয়ারণ্যে
মেইল ট্রাভেল ডেস্ক

চিরহরিৎ বনের স্বাদ পাবেন লাউয়াছড়া অভয়ারণ্যে

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান জাতীয় উদ্যান। এই উদ্যানটি উত্তরপূর্ব বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। শ্রীমঙ্গল থেকে এই স্থানটির দূরত্ব ৯.৪ কিলোমিটার।

 

ঘন সবুজ জঙ্গলে পরিপূর্ণ ১২.৫ কিলোমিটার আয়তনের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানটি পশ্চিম ভানুগাছ রিজার্ভ ফরেস্টের অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এই রেইন ফরেস্ট লাদেশে অবশিষ্ট চিরহরিৎ বনের একটি উল্লেখযোগ্য নমুনা। এটি একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী আইনের অধীনে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৬ সালের ৭ই জুলাই এই উদ্যানটিকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে।

 

ভীষণ ঘন ঝোঁপঝাড় ভেদ করে দৃষ্টি খুব বেশি দূরে যাবে না। কিন্তু ঝোঁপঝাড় ভেদ করে ঠিকই শুনতে পাবেন অসংখ্য পাখির ডাক, মাঝে মধ্যে দেখা পাবেন নানা প্রজাতির অসংখ্য বানরের। প্রচুর বৃষ্টিপাতের জন্য এই ঘনসবুজ বনাঞ্চলটি এরই মধ্যে রেইন ফরেস্ট হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। তাছাড়া এই বনাঞ্চলকে দেয়া হয়েছে জাতীয় উদ্যানের মর্যাদাও। বলছি সিলেটের লাউয়াছড়ার কথা। বাংলাদেশে রয়েছে ভ্রমণের জন্য অনেক রোমাঞ্চকর স্থান। যেসব জায়গায় ঘুরতে গেলে নিমেষেই মনের ক্লান্তি দূর করে নতুন উদ্যমে দৈনন্দিন কাজে মনোযোগী হওয়া যায়। এমন একটি আকর্ষণীয় স্পট হচ্ছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান।

 

মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই উদ্যান। চায়ের শহর শ্রীমঙ্গল থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ (কমলগঞ্জ) সড়কের পশ্চিম পাশে জাতীয় এ উদ্যানের প্রবেশপথ। বাংলাদেশের সাতটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও দশটি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে লাউয়াছড়া অন্যতম। চিরহরিৎ এ বনাঞ্চল বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের নিরাপদ আবাসস্থল। এছাড়াও নানান দুর্লভ জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ আর গাছপালার জন্য এ অরণ্য বিখ্যাত। সুন্দরবনের পরপরই পর্যটকদের কাছে বেশি জনপ্রিয় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান।

 

এই বনে রয়েছে ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ বন্যপ্রাণী ও গাছপালা। এর মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, চার প্রজাতির উভচর, ছয় প্রজাতির সরিসৃপ, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ২৪৬ প্রজাতির পাখি। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের গভীর জঙ্গলের উঁচু ডালে বিলুপ্ত প্রায় উল্লুক বসবাস করে। এ ছাড়া চশমা বানর, মুখপোড়া হনুমান, লজ্জাবতী বানর, মেছো বাঘ, শিয়াল, মায়া হরিণ ইত্যাদিও দেখা যায় এ বনে।

 

এখানে আছে অজগরসহ নানারকম সাপ। এ ছাড়া হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপও এ বনের সরীসৃপদের মধ্যে অন্যতম। পাখিদের মধ্যে আছে সবুজ ঘুঘু, বনমোরগ, হরিয়াল, তুর্কিবাজ, কালো মাথা টিয়া, লেজকাটা টিয়া, কালো ফর্কটেইল, ধূসর সাতশৈলী, কালো বাজ, হিরামন, কালো মাথা বুলবুল, ধুমকল, পেঁচা, ফিঙ্গে, সবুজ সুইচোরা, সবুজ কোকিল, ফিঙে, কেশরাজ ইত্যাদি।

 

বনের ভেতর দিয়েই বয়ে গেছে বেশ কয়েকটি পাহাড়ি ছড়া। তবে এসব ছড়াগুলোর বেশিরভাগই বর্ষাকালে পানিতে পূর্ণ থাকে। প্রধান সড়ক ফেলে কিছুদূর চলার পর ভেতর দিয়েই চলে গেছে ঢাকা-সিলেট রেললাইন। এরপরেই মূলত জঙ্গলের শুরু। মূল সড়ক ছেড়ে জঙ্গলের ভেতরে প্রবেশ করলে সাইরেনের মতো এক ধরনের শব্দ কানে আসে। এটি মূলত এ বনে থাকা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। উদ্যানে বেড়ানোর তিনটি পথ আছে। একটি তিন ঘণ্টার, একটি এক ঘণ্টার এবং অন্যটি আধঘণ্টার পথ। উদ্যানের ভেতরে একটি খাসিয়া পল্লীও রয়েছে।

 

আধঘণ্টার পথ: এই পথটির শুরু রেললাইন পেরিয়ে হাতের বাঁ দিক থেকে। পথের শুরুতে উঁচু উঁচু গাছগুলোতে দেখা মিলতে পারে কুলু বানরের। নানারকম গাছগাছালির ভেতর দিয়ে তৈরি করা এ হাঁটা পথে চলতে চলতে জঙ্গলের নির্জনতায় শিহরিত হবেন যে কেউ। এ ছাড়া এ পথের বড় বড় গাছের ডালে দেখা মিলবে বুনো অর্কিড। নির্দেশিত পথে হাতের বাঁয়ে বাঁয়ে চলতে চলতে এই পথ আবার শেষ হবে ঠিক শুরুর স্থানে।

 

এক ঘণ্টার পথ: এক ঘণ্টার ট্রেকিংয়ের শুরুতেই দেখবেন বিশাল গন্ধরই গাছ। এ পথে দেখবেন ঝাওয়া, জগডুমুর, মুলিবাঁশ, কাঁঠালিচাঁপা, লেহা প্রভৃতি গাছ। আরো আছে প্রায় শতবর্ষী চাপলিশ আর গামারি গাছ। পথের পাশে থাকা ডুমুর গাছের ফল খেতে আসে উল্লুক, বানর ও হনুমান ছাড়াও বনের বাসিন্দা আরো অনেক বন্যপ্রাণী। মায়া হরিণ আর বন মোরগেরও দেখা মিলতে পারে এই পথে।

 

তিন ঘণ্টার পথ: তিন ঘণ্টার হাঁটা পথটিও বেশ রোমাঞ্চকর। পথের বাঁয়ে খাসিয়াদের বসত মাগুরছড়া পুঞ্জি। এ পুঞ্জির বাসিন্দারা মূলত পানচাষ করে। পথে দেখা মিলবে বিশাল বাঁশবাগান। বাগানে আছে কুলু বানর আর বিরল প্রজাতির লজ্জাবতী বানর। লজ্জাবতী বানর নিশাচর প্রাণী। এরা দিনের বেলায় বাঁশঝাড়ে ঘুমিয়ে কাটায়। রয়েছে নানান প্রজাতির পাখি। এ পথের শেষদিকে দেখা মিলতে পারে বনের অন্যতম আকর্ষণ উল্লুক পরিবার। এরা বনের সবচেয়ে উঁচু গাছগুলোতে দলবদ্ধভাবে বাস করে।

 

ভ্রমণের উপযুক্ত সময়: প্রায় সারা বছরই ভ্রমণে যাওয়া যায় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। তবে ভ্রমণের জন্য অক্টোবর থেকে মার্চ মাস ভালো সময়।

 

যেভাবে যাবেন: লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানটি সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায়। ঢাকা থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৬০ কিলোমিটার, সিলেট শহর থেকে দূরত্ব হবে প্রায় ৬০ কিলোমিটার। এখানে যাওয়ার সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হতে পারে ট্রেন। কমলাপুর স্টেশন থেকে সিলেটগামী ট্রেনে উঠে নামতে হবে শ্রীমঙ্গলে। সময় লাগবে প্রায় ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটারের দূরত্বে এই উদ্যান। সুতরাং সহজেই সিএনজি অথবা রিকশাতে করে খুব কম সময়ে পৌঁছে যেতে পারবেন ওখানে। বাসে যেতে চাইলে ঢাকা থেকে মৌলভীবাজারগামী যে কোনো বাসে উঠে পড়লেই হবে। মৌলভীবাজার শহর থেকেও যেতে পারবেন উদ্যানে সিএনজি অথবা লোকাল বাসে চড়ে।

 

কোথায় থাকবেন: লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পাশেই থাকার জন্য আছে লেমন গার্ডেন রিসোর্ট। এ রিসোর্টে ২ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকায় বিভিন্ন মানের কক্ষ আছে। লাউয়াছড়ার কাছাকাছি আরো আছে ভানুগাছ সড়কে গ্র্যান্ড সুলতান গলফ রিসোর্ট। পাঁচতারকা মানের এ রিসোর্ট ব্যয়বহুল। ঢাকায় যোগাযোগ থেকে যোগাযোগেরও সুযোগ রয়েছে। ভানুগাছ সড়কে আরো আছে টি রিসোর্ট। এছাড়া শ্রীমঙ্গলের রাধানগরে চমৎকার দুটি রিসোর্ট হলো নিসর্গ নীরব ইকো রিসোর্ট এবং নিসর্গ লিচিবাড়ি ইকো রিসোর্ট।

 

প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য: লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে প্রবেশ মূল্য প্রাপ্তবয়স্ক ২০ টাকা, ছাত্র ও অপ্রাপ্তবয়স্ক ১০ টাকা, বিদেশি নাগরিক পাঁচ মার্কিন ডলার কিংবা সমমূল্যের টাকা। এ ছাড়া গাড়ি, জিপ ও মাইক্রোবাস পার্কিং ২৫ টাকা। জঙ্গল ভ্রমণে কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখা উচিত। উজ্জ্বল রঙের পোশাক পরে জঙ্গল ভ্রমণে যাওয়া উচিত নয়। বনে হৈচৈ করলে বন্যপ্রাণীদের দেখা যাবে না। তাই সর্বোচ্চ নীরবতা পালন করতে হবে। সঙ্গে নেয়া পানির বোতল, চিপসের প্যাকেট বনের মধ্যে না ফেলে সঙ্গে এনে বাইরে ফেলা উচিত।

ট্র্যাকিংয়ের সময় সঙ্গে পর্যাপ্ত খাবার পানি নিন। আইপ্যাকের প্রশিক্ষিত গাইড সঙ্গে নিয়ে ট্র্যাকিংয়ে যাওয়া উচিত। নয়তো পথ হারানোর ভয় আছে। বর্ষা মৌসুমে লাউয়াছড়া উদ্যানে জোঁকের উপদ্রব বাড়ে। এ সময় ভ্রমণে প্যান্ট মোজার মধ্যে গুঁজে নিন। বাড়তি সতর্কতা হিসেবে জুতার ওপরে গুল ছিটিয়ে নিতে পারেন।

 

 

 

 

 

নিউইয়র্ক মেইল/বাংলাদেশ/২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/এইচএম