পাষাণ পাথরের শরীর বেয়ে চঞ্চল পায়ে হেলে দুলে মর্ত্যে অবিরত নেমে আসছে ঝর্ণা। সেই ঝর্ণার স্বর্গীয় রূপসুধা উপভোগ করতে আপনাকে যেতে হবে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। খৈয়া ছড়া ঝর্ণা আপনাকে ডাকছে, তার শীতল জলে প্রাণ জুড়াতে।
মিরসরাইয়ে পাহাড় আর জঙ্গলের অপূর্ব সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা পরিবেশে চমৎকার ঝর্ণা খৈয়া ছড়া। এমন ঝর্ণা বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়টি নেই। যদিও দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ জানতই না এই ঝর্ণার কথা। দুর্গম পাহাড় আর জঙ্গলের মাঝে যেন লুকিয়ে ছিল প্রকৃতির এই অপূর্ব উপহার। ২০১০ সালে সরকার বারৈয়াঢালা ব্লক থেকে কুণ্ডেরহাট ব্লকের ২৯৩৩.৬১ হেক্টর পাহাড়কে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করায় খৈয়াছড়া ঝর্ণা জাতীয় উদ্যানের আওতাভুক্ত হয়।
মিরসরাই উপজেলার খৈয়াছড়া ইউনিয়নের বড়তাকিয়া বাজারের উত্তর পার্শ্বে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার কিলোমিটার পূবে খৈয়াছড়া ঝর্ণার অবস্থান।
আকার আকৃতি ও গঠনশৈলির দিক দিয়ে এটা নিঃসন্দেহে এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঝর্ণা। মোট ৮টি মূল ধাপ এবং অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন ধাপ নিয়ে খৈয়াছড়ার অনন্য বৈশিষ্ঠ্য হলো অন্যান্য ঝর্ণার মতো এটি সরাসরি ওপর থেকে নিচে এসে পড়েনি। ঝর্ণাটির ৮টি ধাপের মধ্যে নিচ থেকেই দেখা যায় তিনটি ধাপ, তার ওপরের তিনটি ধাপ দেখতে হলে বাম পাশের প্রায় খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে হবে আরো শ’খানেক ফুট ওপরে। সপ্তম ধাপের ওপরে উঠলে দেখা মিলবে আরো একটি ধাপের। এর পাশ দিয়ে সামান্য হাঁটলেই দেখা মিলবে সর্বোচ্চ ধাপটির।
এতেও যদি মন না ভরে তাহলে এই ধাপের বাম পাশ দিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠে যান আরো ওপরে, সেখানে আশপাশের বহুদূর বিস্তৃত পাহাড় আর জঙ্গলের মনোহর দৃশ্য কিছুণের জন্য হলেও ভুলিয়ে দেবে উপরে ওঠার পরিশ্রম আর নিরাপদে নিচে ফিরে যাওয়ার ভাবনা।
ঝর্ণায় পৌঁছানোর রাস্তাটিও কম মনোমুগ্ধকর নয়। মিরসরাই বাজার থেকে সামান্য এগিয়ে বড়তাকিয়া বাজারের আগে নেমে যদি হাঁটা শুরু করেন, শুরুতে রাস্তা সমতলই থাকবে। অদূরে চোখে পড়বে জঙ্গলে ঢাকা বিশাল সব পাহাড়।যা হোক, খানিকণ হাঁটলেই রাস্তা উঁচু-নিচু হতে থাকবে। এভাবে একসময় এসে পড়বেন পাহাড়ি ঝিরিপথে। এরপরই শুরু হবে আসল অ্যাডভেঞ্চার।
এখানে কোনো রাস্তা নেই, ঝিরি ধরেই এগোতে হবে। শীতকালে যাওয়ার পথে পানি পাবেন অল্পস্বল্প। তবে বর্ষা বা বৃষ্টির দিনে কখনো হাঁটুপানিতে পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটবেন তো সেই পানিই কখনো কোমর ছাড়িয়ে বুক পর্যন্ত উঠে আসবে। মাঝেমধ্যে ঝিরি ছেড়ে পাশের টিলায় উঠে পড়তে পারবেন। এভাবেই হাঁটতে হবে দেড় ঘণ্টার মতো। চলার গতির ওপর নির্ভর করবে কতক্ষণে পৌঁছবেন গন্তব্যে।
ঝর্ণার কাছে পৌঁছানোর আগেই ঝমঝম পানি পড়ার শব্দে বুঝে যাবেন গন্তব্যের কাছে চলে এসেছেন। বাঁশের সাঁকো, ক্ষেতের আইল, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ, ছরা, অন্তত ৪টি পাহাড় পেরিয়ে যখন গাছপালার আড়াল থেকে দেখবেন খৈয়াছড়ার জলের প্রপাত, উঁচু থেকে প্রবল শব্দে নিচে পাথরের ওপর আছড়েপড়া পানি দেখে জলকেলির লোভ সামলানো শক্ত হয়ে পড়বে।
নেমে পড়ূন বরফশীতল ঠান্ডা জলে। ডুবে যাওয়ার ভয় নেই, পানি কখনই বুক ছাড়াবে না, কাজেই সাঁতার না জানলেও সমস্যা নেই। তবে সাবধান থাকা ভালো। ঝরনার ডানদিক অপোকৃত গভীর।
আর যদি বৃক্ষকিংবা পাখিপ্রেমী হন, অর্থাৎ ঝর্ণা দেখা ছাড়াও বন্য পরিবেশের প্রতি যদি থাকে আগ্রহ, তাহলেও খৈয়াছড়া নিরাশ করবে না। ঝরনায় যাওয়ার রাস্তায় দুই পাশে দেখা মিলবে ঘুঘু, টিয়া, কাঠঠোকরাসহ হরেক রকম পাখপাখালির।
হাতে সময় নিয়ে যাওয়া ভালো, ঝর্ণা দেখে ফিরতে ফিরতে বেশ সময় লাগবে। খাবার সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারেন, তবে ঝর্ণায় যাওয়ার পথেই অন্তত তিনটি জায়গায় দেখা মিলবে স্থানীয় হোটেলের। শুরুরটি সোহেলের আর সবশেষেরটি জয়নাল আবেদিনের বাড়িকাম হোটেল। চাইলে সেখান থেকেও খেয়ে নিতে পারেন। খাবারের দাম তুলনামূলক সস্তা।
যেভাবে যাবেন: ঢাকার যেকোনো বাস কাউন্টার থেকে চট্টগ্রামগামী বাসে উঠে পড়লেই হবে। ভাড়া পড়বে ৪৮০ টাকা। পথে যানজট না থাকলে ছয় ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবেন মিরসরাই বাজার অথবা একটু সামনে এগিয়ে বড়তাকিয়া বাজারে। স্থানীয় লোকদের জিজ্ঞাসা করলেই তারা বলে দেবেন, কোন পথে যেতে হবে। সেখান থেকে সিএনজি অটোরিকশায় করে যেতে হবে খৈয়াছড়া স্কুলের সামনে।অটোরিকশায় মিনিট দশেক এগোলে রেললাইন পড়বে, রেললাইন পার হয়ে আরো কিছুণ পর ঝিরি পাবেন। ঝিরি ধরে ঘণ্টা দেড়েক হাঁটলেই ঝর্ণা।
চাইলে গাইডও নিতে পারেন, তবে নিজেরা গেলেই রোমাঞ্চের স্বাদ বেশি পাওয়া যাবে। ঝরনায় যাওয়ার রাস্তা একটিই, আর পথে আরো অনেক অ্যাডভেঞ্চারপিয়াসীর দেখা মিলবে, কাজেই পথ হারানোর ভয় নেই।
মনে রাখবেন: চিপসের প্যাকেট, সিগারেটের ফিল্টার, পানির বোতলসহ অন্যান্য আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলবেন না। এই ঝর্ণা বাংলাদেশের মানুষের সম্পদ। অপচনশীল এসব আবর্জনা ফেলে ঝর্ণার পরিবেশ নষ্ট করা কোনোভাবেই উচিত হবে না।
পথে জোঁক থাকতে পারে, সতর্ক থাকবেন। লবণ সঙ্গে রাখলে ভালো হয়। জোঁক কামড়ালে হাত দিয়ে টেনে ছাড়াতে যাবেন না, লবণ ছিটিয়ে দিলেই কাজ হবে।
ঝরনায় যাওয়ার রাস্তা অনেকটা দুর্গম। শিশু, বয়স্ক বা অপ্রাপ্তবয়স্কদের নিয়ে যাওয়া উচিত হবে না, ঝর্ণা পেরুনোর সময় সতর্ক থাকতে হবে নিজেকেও।
ঝর্ণার পাশের খাড়া পাহাড় দিয়ে একদম ওপরে ওঠা যায়। তবে পা ফসকে নিচে পড়লে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কাজেই পাহাড়ে চড়ার অভিজ্ঞতা না থাকলে উপরে ওঠার চেষ্টা না করাই ভালো।
যা যা সঙ্গে নেবেন:
এখন খৈয়াছড়ায়ই সব কিছুই পাওয়া যায়। যেহেতু নিয়মিত ট্যুরিস্ট যাচ্ছে। তারপরও কিছু জিনিস সঙ্গে নেওয়া ভাল। তবে কোনোভাবেই ব্যাগ ভারি করা যাবে না।
যা নিতে পারেন:
ব্যাগ,
গামছা,
বর্ষাকালে ছাতা,
রেইন কোট
অতিরিক্ত এক সেট কাপড়
পানির বোতল
কেডস/ সেন্ডেল,
ক্যামেরা+ব্যাটারী+চার্জার,
টিস্যু ও
ব্যক্তিগত ওষুধ।
পরিশেষ: বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পের মতো শেষ হইয়াও যেন হইল না শেষ সূত্রমতে খৈয়াছড়া ঝর্ণা দেখেই ভ্রমণ শেষ হয়ে যায়নি। ফেরার পথে বাড়তি অ্যাডভেঞ্চার মহামায়া ইকোপার্ক। মাত্র ২০ মিনিটের দূরত্বে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃত্রিম লেক তথা মহামায়া সেচ প্রকল্প এলাকা ভ্রমণ করে চোখ জুড়িয়ে নিতে পারেন। লেকে করতে পারেন নৌকাভ্রমণ।
নিউইয়র্ক মেইল/বাংলাদেশ/২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/এইচএম