ভ্রমণের জন্য নির্দিষ্ট কোনোদিন কিংবা মৌসুম নেই। প্রকৃতির সাথে মিতালী করতে চাইলে বছরের যেকোনো সময়ই তা সম্ভব। তাই কোনো এক ছুটিতে পরিবার-পরিজন নিয়ে বেড়িয়ে আসুন কুয়াকাটা থেকে।
বাংলাদেশের মানচিত্রের সবচেয়ে দক্ষিণে সাগরকন্যা কুয়াকাটা। প্রায় ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সমুদ্রসৈকতের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে অবলোকন করা যায় সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য। ভোরবেলায় দেখবেন আগুনের গোলার মতো সূর্যটা ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। আবার গোধূলিতে আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে সাগরের বুকে।
কক্সবাজার দেশের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র হলেও কুয়াকাটায় পর্যটকদের আনাগোনা দেখে মনে হয় আরেকটা কক্সবাজার। এখানকার সমুদ্রে ঢেউ কম, বাতাসের গর্জনও তেমন নেই। পর্যটকদের কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য আবাসিক হোটেল, খাবারের দোকান ও স্যুভেনির শপ।
সমুদ্রসৈকতের পশ্চিম দিকে ম্যানগ্রোভ বন শুরু হয়েছে। কাছাকাছি অবস্থিত এই সংরক্ষিত ফাতরার বন ইতিমধ্যে দ্বিতীয় সুন্দরবন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এখানে রয়েছে কেওড়া, গেওয়া, সুন্দরী, ফাতরা, গরান, বাইন, গোলপাতা ইত্যাদি ম্যানগ্রোভ প্রজাতির উদ্ভিদ এবং বানর, শূকরসহ অসংখ্য জীবজন্তু ও পাখি। সমুদ্রসৈকত থেকে ইঞ্জিনচালিত বোটে এক ঘণ্টার যাত্রাপথে ফাতরার বনে যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তিন ঘণ্টার প্যাকেজে ভাড়া জনপ্রতি ১০০ টাকা। এটা এক চমৎকার অভিজ্ঞতা। বিশেষ ব্যবস্থায় সুন্দরবনেও যাওয়া যায়।
কুয়াকাটার ইতিহাসে মিশে আছে রাখাইন আদিবাসী সম্প্রদায়। ২৩০ বছর আগে তৎকালীন বার্মার আরাকান থেকে রাখাইন সম্প্রদায় জাতিগত কোন্দলের কারণে কাঠের নৌকাযোগে সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে এখানে আস্তানা গাড়ে। তারাই এ অঞ্চলকে আবাসযোগ্য করে। দেশের সর্ববৃহৎ বুদ্ধমন্দিরটি কুয়াকাটার মিস্ত্রিপাড়ায় অবস্থিত। কুয়াকাটা থেকে সাত কিলোমিটার পূর্বদিকে ৩৬ ফুট উঁচু গৌতম বুদ্ধের এই ধ্যানমগ্ন মূর্তিটি দেখার মতো।
কুয়াকাটায় দেখার আরেক আকর্ষণ শুঁটকিপল্লী। ইলিশ, রূপচাঁদা, হাঙর, লইট্যা, শাপলাপাতাসহ অসংখ্য প্রজাতির মাছ রোদে শুকিয়ে শুঁটকি বানিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা হয়। বিশাল এলাকায় চ্যাঙ বানিয়ে শুঁটকি তৈরির পদ্ধতি দেখা আরেক মজার অভিজ্ঞতা। কিছু শুঁটকি কিনেও আনা যায়।
আরো দেখতে পারেন, ইকোপার্ক, ঝাউবন, গঙ্গামতী লেক, লেবুচর, ক্র্যাবল্যান্ড (তুফানের চর), সোনার চর, নারকেল বাগান। রাখাইন মহিলা মার্কেটে তাদের হস্তশিল্প দেখতে পারেন। কক্সবাজারের মতো ঝিনুক মার্কেট রয়েছে। কুয়াকাটার স্মৃতি ধরে রাখতে কিছু কিনতেও পারেন।
ঢাকা থেকে কীভাবে যাবেন:
কুয়াকাটায় আপনি দুপথে যেতে পারেন। নদী আর সড়কপথ। নদীপথে যেতে হলে প্রথমেই আপনাকে যেতে হবে ঢাকা সদরঘাট। সেখান থেকে প্রতিদিন পটুয়াখালীর উদ্দেশে যাত্রা করে চারটি অত্যাধুনিক লঞ্চ। তবে লঞ্চে যেতে চাইলে অন্তত একদিন আগেই টিকেট কেটে রাখা ভালো। সিঙ্গেল কেবিন ভাড়া লঞ্চভেদে ৯০০ থেকে ১১০০ টাকা, ডাবল কেবিন ১৮০০ আর ডিলাক্স (ফ্যামিলি) ২০০০ টাকা। এ ছাড়াও আছে লঞ্চের ডেক, যার ভাড়া ২০০ টাকা।
আপনি চাইলে লঞ্চেই রাতের খাবার অর্ডার করতে পারেন অথবা নিজের বাসা থেকে নিয়ে যেতে পারেন। লঞ্চের ভ্রমণ খুবই উপভোগ্য। লঞ্চগুলো ঢাকা থেকে ছাড়বে বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার ভেতর। সকাল ৬টা বা ৭টা নাগাদ পটুয়াখালী পৌঁছবেন। সকাল ৬টা থেকেই প্রতি একঘণ্টা পরপর কুয়াকাটার বাস ছেড়ে যায় পটুয়াখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে। লঞ্চঘাট থেকে বাস স্ট্যান্ডের ভাড়া ২৫-৩০ টাকা। আর সড়কপথে যেতে হলে আপনাকে যেতে হবে গাবতলী বাস টার্মিনালে। এসি, নন-এসি দুই রকম বাস সার্ভিসই পাবেন। নন-এসি ৫০০ টাকা আর এসি ৬৫০-৭০০ টাকা। সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত ৪টি বাস ছেড়ে যায় ঢাকা থেকে। আর নাইট কোচের সময় শুরু সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০:৩০ পর্যন্ত। এছাড়াও গাবতলী থেকে দু’একটা বাস সরাসরি কুয়াকাটার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। তবে সেগুলোর সার্ভিস তেমন ভালো নয়।
কোথায় থাকবেন:
কুয়াকাটা থাকার জন্য অনেক হোটেল রয়েছে। স্টার মানের হোটেল আছে দুটি। তাছাড়া আছে সরকারি ডাকবাংলো। এছাড়া মধ্যম মানের অনেক ভালো হোটেল রয়েছে। সিঙ্গেল বেডের ভাড়া এসব হোটেলে ৩০০ টাকার মতো। আর ৬-৭ জন থাকার জন্য ৪ বেডের রুম নিতে পারেন, যার ভাড়া পরবে ৮০০ টাকার মতো। সব হোটেলই সৈকতের খুব কাছে।
কোথায় খাবেন:
খাবারের জন্য কুয়াকাটাতে অনেক রেস্তোরাঁ রয়েছে। তবে অর্ডার দেয়ার আগে অবশ্যই দামটা জেনে নেবেন।
টিপস:
১. কুয়াকাটা থেকে ঢাকার বাস ছাড়ে সন্ধ্যা ৬:৩০ মিনিটে, ওই বাস মিস করলে ওইদিন আর ঢাকার মুখ দেখতে হবে না, কাজেই টাইমিংটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২. ক্যাম্পিংয়ের জন্য ফাতরার চর ভালো জায়গা, ওখানে সিকিউরিটি আছে, গঙ্গামতীর চর হলো সবচেয়ে ভালো, কিন্তু ওখানে সিকিউরিটি নাই।
৩. ট্রলারে করে সব জায়গায় যাওয়া যাবে না। আর সময় ও অনেক বেশি লাগবে। সেক্ষেত্রে বাইকে করে ঘুরে আসা যেতে পারে। বাইকগুলো ১৫টা স্পট ঘুরিয়ে আনবে। দামাদামি করে ৫০০ টাকার মধ্যেই বাইক ঠিক করা যেতে পারে।
৪. সাগরে ময়লা ফেলবেন না, সাগরকে যদি আমরা ঠিকমতো দেখেশুনে রাখতে না পারি, তাহলে এর ব্যর্থতার দায়ভার আমাদেরই নিতে হবে। এই সাগর আমাদের, একে পরিষ্কার রাখার দায়িত্বও আমাদের।
নিউইয়র্ক মেইল/বাংলাদেশ/২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/এইচএম