দক্ষিণ এশিয়া ও সার্কভুক্ত দেশগুলোর প্রাকৃতিক নৈসর্গের অন্যতম পুণ্যভূমি হলো ‘ভুটান’। সুবিশাল হিমালয়ের কল্যাণে উঁচু পর্বতমালা, ঘন বনজঙ্গল আর সবুজ ভ্যালি ভুটানের প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের অন্তর্গত। প্রকৃতির অকৃত্রিম মমতা এবং সবুজে ছাওয়া বিস্তৃত অঞ্চল পর্যটকদের কাছে মনোহরী।
ঘনসবুজে ঢাকা ভুটান শান্ত, নিরিবিলি এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। এক অন্য আবেশ, অন্য অনুভ‚তির দেশ এই ভুটান। উপভোগ করার মতো অনেক কিছুই রয়েছে সাজানো-গোছানো এই দেশটিতে। তাই ভ্রমণপিপাসুদের প্রথম পছন্দ এই ভুটান।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ভুটান ভারতীয় উপমহাদেশে হিমালয় পর্বতমালার পূর্বাংশে অবস্থিত। দেশটির উত্তরে চীনের তিব্বত অঞ্চল এবং দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে ভারত। ৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের পুরো দেশটাই পাহাড়বেষ্টিত। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করার মতো সমতল কোনো জায়গাই ভুটানে নেই। মাথাপিছু গড় আয় ১ হাজার ৫০ মার্কিন ডলার। সনাতন সংস্কৃতিই হলো ভুটানের ঐতিহ্য। ভুটানই পৃথিবীর একমাত্র ধর্মরাষ্ট্র যেখানে সকল আইনকেই ঈশ্বরের আইন বলে ধরে নেয়া হয়।
ভুটানের মোহময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং ট্যুরিস্ট অ্যাট্রাকশন যারা ভ্রমণ ভালোবাসেন-তারা কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারেন না। সব মিলিয়ে সার্কভুক্ত ক্ষুদ্র এই রাষ্ট্র ভ্রমণ পর্যটকদের জন্য বয়ে আনতে পারে সুখকর এবং নতুন এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
এই দেশে বড় কোনো শিল্পকারখানা নেই। লোকসংখ্যা প্রায় ৭ লাখ। আয়ের মূল উৎস বিদ্যুৎ, ফল ও পর্যটন। হিমালয়ের কল্যাণে উঁচু পর্বতমালা, ঘন বনজঙ্গল, সবুজ ভ্যালি এই ভুটানের প্রাকৃতিক রূপ বৈচিত্র্য। দেশটিতে রয়েছে দেজং (প্রাসাদদুর্গ), বৌদ্ধমন্দির ও পর্বতের গায়ে অসংখ্য গুহা সেখানকার গৌরবময় প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে। আর এই কারণে ভুটান এই অঞ্চলের অন্যতম পর্যটনসমৃদ্ধ দেশ। প্রকৃতির অকৃত্রিম মমতা এবং সবুজে ছাওয়া বিস্তৃত অঞ্চল পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। আগস্ট থেকে অক্টোবর এই তিন মাস ভুটানে বেড়ানোর উৎকৃষ্ট সময়। ভ্রমণের জন্য দেশটি বেশ নিরাপদ। পর্যটকরা স্বাচ্ছন্দ্যে তাদের পছন্দের স্থানগুলোতে ঘুরতে পারেন। শান্তিময় ভ্রমণের জন্য ভুটান সব পর্যটকের কাছে যেন এক স্বর্গরাজ্য।
থিম্পু:
ভুটানের রাজধানী থিম্পু। পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম রাজধানী শহর এটি। উচ্চতা ২৩০০ মিটার। চকচকে ঝকঝকে একটা শহর ওয়াং-চু উপত্যকার গা-ঘেঁষে বসে আছে রাজধানীটি শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে চু নদী ভুটানের সব থেকে আকর্ষণীয় এবং নান্দনিক সৌন্দর্যের আতুড়ঘর হলো এই থিম্পু।
থিম্পু নদীর তীরে সিলভান ভ্যালিতে অবস্থিত এথনিক ভুটানিজ কলা, স্থাপত্যশিল্প, সংস্কৃতির পীঠস্থান। থিম্পু পৃথিবীর একমাত্র রাজধানী যেখানে রাজপথে কোনো সিগন্যাল বাতি নেই। পাহাড়ের ওপর স্থাপিত ১৬৯ ফুট দীর্ঘ সোনার জল দিয়ে তৈরি বিশালাকার শখ্যমুনি বুদ্ধের মূর্তি শহরে বিভিন্ন জায়গা থেকে দৃশ্যমান? থিম্পুতে আরও যা রয়েছে: হ্যান্ডিক্রাফট এম্পোরিয়াম, ট্র্যাডিশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট, পেন্টিং স্কুল এবং ন্যাশনাল লাইব্রেরি।
থিম্পু জং:
থিম্পু শহরের প্রাণকেন্দ্র হলো ১৬৬১ সালে নির্মিত এই থিম্পু জং। এখানে তাশিকো দেজং দালানটি দেশের প্রধান সচিবালয়। এখানে আছে সরকারি ডিপার্টমেন্ট, দ্যা ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি, রাজার থ্রোন রুম এবং সেন্ট্রাল মোনাস্টিক বডির গ্রীষ্মকালীন হেডকোয়ার্টার্স। এছাড়া দেশের ধর্মীয় প্রধানদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হচ্ছে।
জিগমে দর্জি ন্যাশনাল পার্ক:
ভুটানের সর্ববৃহৎ সংরক্ষিত বনাঞ্চল। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম অভয়ারণ্য হিসেবে এই পার্কের অবস্থান শীর্ষে। বিরল প্রজাতির ভুটানের জাতীয় ফুল ব্লু পপি পার্কে প্রচুর দেখতে পাওয়া যায়। রয়েছে ম্যাগনোলিয়া, জুনিপার্স ফুল এবং সচরাচর দেখা যায় না এমন বহু প্রজাতির অর্কিড। দৈত্যাকৃতির রুবার্ব এবং অতি পুরোনো পাইন ও ওক গাছ রয়েছে প্রচুর। এই অভয়ারণ্যে প্রাণীর মধ্যে দেখা মেলে ভুটানের জাতীয় পশু টাকিন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে দেখতে পাবেন রেড পান্ডা, গোল্ডেন লাঙ্গুর, লেপার্ড এবং শ্বেত ভালুকসহ অন্য প্রাণী।
সিমতোখা জং:
১৬২৭ সালে তৈরি এই জং থিম্পু ভ্যালির গেটওয়ে। থিম্পুর সবচেয়ে পুরোনো এই জংয়ে আছে রিগনে স্কুল ফর জংঘা অ্যান্ড মোনাস্টিক স্টাডিস। অন্যান্য আকর্ষণের মধ্যে রয়েছে- ফ্রেশকো এবং স্টেট কার্ভিংস।
মেমোরিয়াল কর্টেন:
এটি মূলত স্মৃতিস্তম্ভ। ভুটানের তৃতীয় রাজা জিগমে দরজি ওয়াংচুকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ১৯৭৪ সালে এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়। এর ভেতর রয়েছে নানারকমের পেইন্টিং এবং স্ট্যাচু যা বৌদ্ধ দর্শনের প্রতিবিম্ব।
থিম্পুর উইক অ্যান্ড মার্কেট:
কেনাকাটার জন্য থিম্পুর মনোরম এবং আকর্ষণীয় জায়গা হলো থিম্পুর উইক অ্যান্ড মার্কেট। হস্তশিল্প ও অ্যান্টিক জুয়েলারির জন্য এই মার্কেট প্রসিদ্ধ। এছাড়া ভুটানের ঐতিহ্যবাহী হাতে বোনা কাপড়, কাঠের তৈরি জিনিসপত্র ও গালিচার সুনিপুণ কারুকার্য দেখে আপনার সৌখিন মন নেচে উঠবেই। পর্যটকদের উদ্দেশ্য করেই এখানে হস্তশিল্পের মেলা বসে। হেঁটে উপভোগ করার মতো জায়গা এটি। ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন আকৃতির মুখোশ এখানকার অন্যতম আকর্ষণ।
থাসিংগাং:
এটি ভুটানের সর্ববৃহৎ জেলা। এখানকার দেজংগুলো ১৭ শতকে নির্মিত। থাসিংগাংকে বৌদ্ধভিক্ষু ও সন্ন্যাসীদের গুম্ফা নগরও বলা হয়। এই জায়গায় ভ্রমণে এলে আপনি লক্ষ করবেন কত নিবিষ্ট মনে ভিক্ষুরা ধর্মচর্চায় নিজেদের নিমগ্ন রেখেছেন।
থিম্পু পুনাখা:
থিম্পু শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পুনাখা। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী সুনিপুণ কারুকার্যে শোভিত এই পুনাখা। আকাশ পরিষ্কার থাকলে খুব সহজেই এখান থেকে হিমালয় দর্শন করতে পারবেন। ভুটানের সব থেকে উর্বর ভ্যালি এই পুনাখা। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পুনাখা জং, ফো ছু এবং মো ছু নদী। ফো চু (বাবা) ও মো চু (মা) নদীর পাশে লক্ষ্মী মেয়ের মতো সেজেগুজে থাকা পুনাখা বর্তমানে ভুটানের শীতকালীন রাজধানী। ওয়াং ডু উপত্যকার ওপরে পুনাখা জং। অতিকায় এই জং জুড়ে রয়েছে রাজকীয় স্থাপত্যশৈলী। জং-এর চারপাশে জ্যাকারান্ডা গাছ। মার্চ-এপ্রিলে এই গাছ ফুলে ভরে থাকে।।
পারো:
ভুটানের অন্যতম আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক দর্শনীয় স্থাপনার নিদর্শন হলো পারো। হিমালয়ের কোলে অবস্থিত ছোট্ট শহর পারো। পারো ভ্যালির ওপর ধাপে ধাপে ধান চাষ হয়। পারোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও ভোলার মতো নয়। বিশেষ করে বসন্ত ঋতুতে পারোর রূপ হয়ে ওঠে অতুলনীয়। অবিরাম বয়ে চলেছে ধবধবে সাদা নদী আর মাথায় রয়েছে। পরিষ্কার নীল আকাশ, ঠিক যেন লাল-নীল-সবুজের মেলা বসেছে। পারো থেকে সাইট সিইং এবং বেশ কয়েকটি গুম্ফা ছাড়াও রয়েছে পারো মিউজিয়াম, পারো জং। এসবই দেখার মতো জায়গা।
চ্যালেলা পাস:
পারো ভ্যালি থেকে দুই ঘণ্টার রাস্তা এই চ্যালেলা পাস। এই জায়গা এতোটাই মনোমুগ্ধকর যে আপনি দৃষ্টি ফেরাতে পারবেন না। শীতে নদী ও ঝরনাগুলো জমে কাচের মতো স্বচ্ছ হয়ে থাকে। পথের দুপাশে যেন রঙ-বেরঙের ফুলের পসরা সাজানো রয়েছে। থেকে থেকে মৃদু গতিতে তুষার ঝরার ঘটনাও আপনাকে শিহরিত করবে। কথিত আছে এই পাস তার ভক্ত পর্যটকদের আহ্বাণ করে সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য। পাসে দাঁড়িয়ে দেখা যায় পর্বতের সাদা চূড়া আর তার নিচে অপরূপ বিস্তীর্ণ উপত্যকা ভূমি।
বুমথাং:
বুমথাংকে বলা হয় ভুটানের আধ্যাত্মিকতার হৃদয়ভূমি। কারণ ভুটানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জং, মন্দির এবং মহল এই অঞ্চলে অবস্থিত। এখানে এলে দেখতে পাবেন ওয়াংগডিচোলিং প্যালেস, জাম্বে লাখাং মন্দির, এবং সবচেয়ে বড় ভুটানিজ মন্দির জাকার। একটু দূরেই অবস্থিত হট প্রিং এরিয়া। পথটা খুবই সুন্দর। এই এলাকায় বলু শিপ, মাস্ক ডিয়ার, হিমালয়ান ভাল্লুক চোখে পড়তে পারে।
টাইগার নেস্ট:
পারোর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ টাইগার নেস্ট। জায়গাটি ধর্মীয় এবং পর্যটনের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই মোনাস্ট্রি পারো থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে একটি ক্লিফের ওপর অবস্থিত। হেঁটে ওঠার পথটিও খুব সুন্দর। তিন হাজার ফুট হেঁটে উঠতে হবে আবার নেমে আসতে হবে। পায়ে হাঁটার বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই। ভুটান ট্যুরিজম দর্শনার্থীদের গলা ভেজাতে এখানে একটি সুন্দর কফি হাউজ রয়েছে।
অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ ভুটানের এসব স্পট এতোই বিখ্যাত যে কোনো পর্যটকই এসব জায়গা সহজে মিস করতে চান না। কাজেই আর দেরি না করে চলুন বেরিয়ে পড়া যাক ভুটানের উদ্দেশে।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট।
নিউইয়র্ক মেইল/ভুটান/২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/এইচএম