তিনদিনের ছুটি কাটিয়ে রাতের ট্রেনে চেপে বসলো মাশকুর। সকালে অফিস ধরবে এই ভাবনায়। একটু পরেই ট্রেন ছাড়বে ঢাকার উদ্দেশ্যে। মোটামুটি লম্বা জার্নি। ট্রেনে দু’জনের করে দুটো দুটো মুখোমুখি সিট। মাশকুরের পাশের সিটে মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক। ট্রেন ছাড়ার হুইশেল শুনে সবাই শেষদফা ঠিকঠাক হয়ে বসছে। পাশের সিটের লোকটি অনেকটা হেলান দিয়েই নাক ডাকছে। আজব লোক তো। এত তাড়াতাড়ি মানুষ ঘুমিয়ে যেতে পারে?
মুখোমুখি সামনের সিটে বয়স্ক দম্পতি। ট্রেন ছাড়ার পর পাশের লোকটাকে আলতোভাবে একটু সরিয়ে দিয়ে মাশকুরও শরীরটা ছেড়ে দিয়ে হেলান দিয়ে বসলো। ঝক ঝক শব্দে ট্রেন এগিয়ে চলল।
রাতের ট্রেনের জানালায় স্তব্ধ আকাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হালকা আলোর আকাশ। কাছের গাছগুলো, পাহাড়গুলো দ্রুত ছুটে যাচ্ছে পেছনে। কোথাও আবার আদিগন্ত বিস্তীর্ণ মাঠ। বাংলাদেশের প্রায় সবক’টি ট্রেনেই চড়লে প্রচুর শব্দ পেতে হয়। এসিরুম না হওয়া সত্ত্বেও এই ট্রেনে শব্দ কম। সম্ভবত ট্রেনের বগিগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে ঝকঝক শব্দ পাওয়া গেলেও বাতাসের বিরক্তিকর শোঁ শোঁ শব্দটা কম। মাঠগুলো পার হওয়ার সময় বরং বাইরের ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দই পাওয়া যাচ্ছে বেশি।
নদীঘাটে এতোরাতেও অনেক মানুষ দেখা যাচ্ছে। মাথায় বোঝা নিয়ে উঠছে নিচের দিক থেকে। সম্ভবত বালু তোলার কাজ। সিমেন্ট কারখানাগুলো লোকে লোকারণ্য। আলো জ্বলছে, মেশিনের শব্দ ভেসে আসছে। অদ্ভূদ সুন্দর দৃশ্য-শব্দের মিল। একে একে শব্দ করে পার হচ্ছে সব।
ইয়ারফোনে গান বাজিয়ে চোখ বুজলো মাশকুর। পাশের সিটের ভদ্রলোকের গলা পরিষ্কার করার দু’তিনটা কাশিতে চোখ খুলল সে। ট্রেন তখন খোলা মাঠের মাঝ দিয়ে যাচ্ছে যেন। ট্রেনের বাতি তখন নেভানো। অন্ধকার রাতেরও একটি নিজস্ব আলো থাকে। বাইরের সেই আলোতে ট্রেনের ভেতরটা মোটামুটি দৃশ্যমান। পাশের সিটের ভদ্রলোক এখন জেগে আছেন। মাঝবয়সী ভদ্রলোক। পোশাক-আশাকে ধারনা করা যায় চাকুরীজীবী।
মোটামুটি মধ্যমসারির পদ থেকে নিচের দিকের সব চাকুরীজীবীরাই শার্ট পড়েন বেশি। সাথে প্যান্টে জামা ইন করাও থাকে। উনিও সেরকম। ফিসফিস করে কথা বলছেন মোবাইলে। মুখের সামনে বাম হাত রেখে এতোই আস্তে আস্তে কথা বলছেন, অপরপ্রান্তের মানুষটার কথা ভেবে যেন মায়াই হলো। আহা, বেচারা কিংবা বেচারী, কিছু কি শুনতে পাচ্ছেন তার কথা?
ট্রেন থামল ভৈরব ষ্টেশনে। ফ্লাটফর্মের দোকানগুলো খুব ছোট হলেও মোটামুটি সবই পাওয়া যায়। নেমে সিগারেট জ্বালালো মাশকুর। সামনের সিটের বয়স্ক লোকটাও দোকানে আসলো। দোকানীর কাছে জানতে চেয়ে চেয়ে কয়েকটা চিপস, ক্যাটভেরি, ওয়েফার, কিটকাট নিল। একটা ছোট পানির বোতল আর দু’পিস কেকও নিল আলাদা পলিতে। দাম জিজ্ঞেস করে যেন হতাশ হলেন মনে হলো। শেষে কেক আর পানির বোতলের পলিটি ফেরত দিয়ে দুই খিলি পান নিয়ে ফেরত গেল।
ট্রেনে ফেরার পর দেখা গেল ব্যাগের উনারা ব্যাগের মধ্যে যত্ন করে চিপসের পলিটি রেখে পান মুখে দিচ্ছেন। পাশের সিটের ভদ্রলোক তখনও ফোনে ব্যস্ত। ফিসফিস করে কথা বলছেন আর মৃদূ শব্দে হাসছেন। লোকটির হাসিটি সুন্দর। মাশকুর একটু তাকিয়ে দেখলো হাসিটা। উপরের ঠোঁটটা একটু বাঁকিয়ে মুচকি হাসির মতো হাসতে পারেন লোকটি। সবাই মুচকি হাসি দিতে নিচের ঠোঁট বাঁকান। কিন্তু এই ভদ্রলোকের বিষয়টি অন্যরকম। প্লাটফর্মের জ্বলা আলো আড়াল করার জন্য এখন উনার চোখের উপর হাত তোলা। দারুন রোমান্টিক লোক মনে হলো লোকটাকে। এত রাতে হয়তো বাড়ি থেকে ঢাকায় কর্মস্থলে ফিরছে। তবুও ট্রেনে বসে বসে স্ত্রীকে সঙ্গ দিচ্ছে হয়তো, এই ভেবে ভালোও লাগলো মাশকুরের।
লোকটাকে দেখে তারও কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছিল। কিন্তু সে কাকে ফোন করবে? যাকে ফোন করার কথা সেতো এখন ঘুমাচ্ছে। জেগে থাকলেও কথা বলার অবস্থায় নেই। ভাবনায় ডুবলো মাশকুর- সেকি জানে যে প্রায় রাতে আমি তার বন্ধ নাম্বারটা প্রেস করে মোবাইল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকি? আমার আর ডায়াল করা হয় না।
দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে মাশকুর ইয়ারফোনটা আবার ওন করে। মৌসুমী ভৌমিকের গান বেজে ওঠে, ‘এখন নাকি শব্দগুলো এক মূহুর্তে সাগর পেড়োয়, এখন নাকি যন্ত্রগুলো এপার থেকে আমার কথা তোমার পারে পৌছিয়ে দেয়!!’ দারুন কোইন্সিডেন্টতো!
ট্রেন আবার চলতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর পাশের সিটের লোকটি উঠে কোথায় যেন গেল। সামনে বসা দুজনেই ঘুমিয়ে আছে। মহিলাটা পুরুষটার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। শারিরীক খুব ধকলের পর মানুষ যখন ঘুমায় মুছে সে প্রতিচ্ছবিটা ফুটে ওঠে। এই মানুষগুলোর মুখেও সেই পরিশ্রান্তিটা রয়েছে। তবে জৌলুসওয়ালা রেখা যেন ভেসে আছে মুখে। সুখি মানুষদের বেলায় যেমনটা হয়।
একজন লোকের গলায় মাশকুর ফিরে তাকালো। লোকটি গদগদ হয়ে বলল-ভাই সিটটা খালি? -না, একজন আছেন। সম্ভবত ওয়াশরুমে বা কোথাও গেছেন। এই কথা বলতে বলতে লোকটি বসেই গেল। বসে হাসিমুখে বলল- একটু বসলাম, টিকেট ছাড়া উঠেছি তো। পা ধরে গেছে। আসলে উঠে যাবো। মাশকুর স্বভাবসুলভ হাসি টেনে বলল -জি।
ট্রেনের বয়গুলো হাতে ট্রেতে করে এটা ওটা আনা নেয়া করছে। কামরায় বেশির ভাগ মানুষই ঘুমাচ্ছে। কে খাচ্ছে তাদের এসব খাবার! এর মধ্যে লোকটি পকেট থেকে মোবাইল বের করে দু’পা সিটে তুলে বসলো। বসার ধরনটা ভাল লাগেনি মাশকুরের। মনে মনে ভাবলো সে, এদিকের মানুষ কি সিটে পা তুলে বসে? এই ভাবতে ভাবতে মোবাইলটা পকেটে রেখে পা দুলাতে আরম্ভ করলেন তিনি। মাশকুর পাশের সিটের মালিক লোকটি ফেরার অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকটি ফিরে আসলো। হাত-পা ভেজা। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসেছেন। সিটে বসা লোকটি কিছু না বলেই উঠে গেল। লোকটি বসেই মাশকুরের দিকে তাকালো, সম্ভবত তার জিজ্ঞাসা সে বসতে দিয়েছে কি না লোকটাকে। কিন্তু মাশকুর কোনো সাড়া বা ইঙ্গিত দিল না।
মেসেজ আসলো লোকটার। পকেট থেকে মোবাইলটি বের করে, -এই কি হলো আবার? বলতে বলতে লোকটি আবার উঠে গেল। সামনের সিটের বয়স্ক লোকটা চোখ খুলে তাকিয়ে আবার চোখ বুজলো। মনে হলো, নিঃশব্দ প্রার্থনা করলো লোকটি। মাশকুর নিজেই একটু ইতস্ততবোধ করলো। বাইরে শব্দ যাচ্ছে না জেনেও সে মোবাইলে গান অফ করে দিল। ইয়ারফোনটা কান থেকে খুলল না। তাহলে ট্রেনের শব্দ পেতে হবে না এই ভেবে। সেও চোখ বন্ধ করলো।
সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন ট্রেন তেঁজগাও রেলগেটে। এখনো অনেক সকাল। আজ ট্রেনটি মোটামুটি ৪০ মিনিট আগেই এসেছে। সামনের সিটের বয়স্ক দু’জন নেই। হয়তো ক্যান্টনমেন্ট ষ্টেশনে নেমে গেছেন। পাশে বসা লোকটি ওই সিটে গিয়ে ঘুমাচ্ছেন। ট্রেন কমলাপুর এসে থামলো।
স্টেশন মোটামুটি ফাঁকা। কোলাহল নেই, খুব পরিষ্কারও মনে হলো। প্লাটফর্মে ঘুমানো লোকগুলোর মধ্যে অনেকেই জেগে গেছে, তবে বসে আছে কেউ কেউ। তিনদিন পর আজ থেকে আবার আমার যান্ত্রিক জীবন শুরু হতে যাচ্ছে। ঢাকায় নিয়মিত থাকলেও ভোর দেখা হয় না মাশকুরের। ঘুম ভাঙ্গে ৮টার পর। ব্যাগটা হাতে তাই সে ধীরে ধীরে হাঁটছিল। পেছন থেকে কথার আওয়াজ শুনে তাকালো। ট্রলি টেনে পাশের সিটের লোকটি দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে।
মাশকুরের পাশ দিয়ে যাওয়ার মুহুর্তে লোকটি বলে উঠলো -বলো কি! এখনকার ট্রেনেই তোমার জামাইও ঢাকায় আসছে! লোকটি দাঁড়িয়ে পড়রো। এরপর শান্ত বাক্যে বলল- রাতে বললা না যে! ..ও! ...এখন তাহলে! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এ জাতীয় কথা বলছিল।
মাশকুর হেঁটে এগিয়ে গেল। ট্রেনের তিনটি মানুষ নিয়ে সে ভাবতে চাইলো একটু। কিন্তু পরক্ষণেই অপ্রয়োজনীয় মনে হলো তার। তার চেয়ে এখন এককাপ গরম চা খুব বেশি দরকার।