কিছুক্ষণ আগে ট্রেন থেকে নেমেছে মাশকুর। মনে মনে চা দোকান খুঁজছিল সে। রেলস্টেশন থেকে বের হয়ে বাম দিকে আসতেই ভ্যানগাড়িতে একটি দোকান দেখতে পেল। এতো সকালে চা পাবে কিনা ভাবল একটু। তারপরও এগিয়ে গিয়ে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করতেই দোকানী হেসে উঠলো- আপনে পয়লা কাস্টোমার মামা, বহেন টুলে। মাশকুর ব্যাগটি কাঁধে ঝুলিয়ে টুলে বসলো। ঘড়ি দেখলো, মাত্র ৭টা বাজে। এখনো অনেক সময় অফিসের। তারপরও মনে মনে ভাবলো, আজ আর বাসায় যাবে না। এদিকে একটু সময় কাটিয়ে অফিসের দিকে চলে যাবে। তিনদিন পর অফিস করতে যাচ্ছে, একটু আগে যাওয়াই মঙ্গল।
মাশকুরের অফিসে ৯টায় শুরু হয়। তবে কোম্পানির চাকরি, হাজিরার বিষয়টি খুব বেশি কড়া। অন্তত দশ মিনিট আগে আঙ্গুলের পাঞ্চটা নিশ্চিত করা লাগে। মাঝে মাঝে মাশকুরের বিষয়টি ছোটবেলায় ছুটির দিনে সকালে টেবিলে বসে থাকার মতো মনে হয়। পড়তেও ইচ্ছে করে না, আবার মা তাকে বাইরেও যেতে দিত না। মায়ের ব্যাখ্যা ছিল- স্কুল খোলা থাকলে তুমি তো বিকাল পর্যন্ত ক্লাস করতা, এখন অন্তত ১১টা পর্যন্ত বাসায় পড়ো। মাশকুর তখন টেবিলে বসে বসে খাতায় আগডুম-বাগডুম আঁকতো, না হয় খাতা-কলমে ক্রিকেট খেলতো। মা মনে করতো মাশকুর পড়ছে। মাকে গোল্লা মারতে পেরে মনে মনে সে খুব খুশি হতো। এখন যেমন, তাড়াহুড়ো করে অফিসে গিয়ে টেবিলে বসে বসে সে পত্রিকা পড়ে, আর মনে মনে বলে দশ মিনিটের বিনিময়ে ৩০ মিনিট।
চা দোকানদার ছুরত মিয়া, বাড়ি নেত্রকোণায়। এখানে সে আর তার একটি মেয়ে থাকে। বউ মারা গেছে। বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা থাকে। বাবা-বোনের খোঁজ নেয় না। ছুরত মিয়ার জীবনে দুটো মাত্র টেনশন, এক মাইয়াডা, আর এই ভ্যানগাড়ির দোকানের হপ্তা ঠিক মতো উসুল করতে পারা। এলাকার নেতাকে তার হপ্তা দিতেই হয় বেচাবিক্রি হোক বা না হোক। এর উপরে টহলপুলিশের আবদার তো আছেই! ছুরত আলী এই দুই গোত্রের মানুষদের বলে মালকিন। বিড়িতে ফুঁ দিয়ে একগাল হেসে বলে- উনারা তো মামা দেশের মালকিন! তাহলে মালিক কে? মালিক তো গদির মালিক। দেহেন না গদিত বসনের লাইগা কত হাঙ্গামা!
মাশকুর মনে মনে বলল- বুঝা গেল রাজনীতির বাতাস দেশের কোণায় কোণাতেই বয়। এই বাতাস লাগেনি এমন মানুষ সম্ভবত নারিকেল জিঞ্জিরার শেষ প্রান্তেও নেই।
গল্পে গল্পে তিন কাপ চা খাওয়া হয়ে গেল তার। মাশকুরের ঘড়িতে তখন ৮টা বাজতে ১৩ মিনিট বাকি। সে উঠে পড়লো, ঠিক করলো হেঁটে অফিসে যাবে, তাহলে সময়টা কাজে লাগানো যাবে।
সে যখন অফিসের কাছাকাছি পৌঁছালো তখন সাড়ে ৮টার কাছাকাছি সময়। এর মধ্যে মোবাইলে রিং আসলো। অপরিচিত নম্বরের কল সাধারণত রিসিভ করা হয় না মাশকুরের। মাঝে মাঝে মোবাইল জিনিসটাই তার কাছে বিরক্তিকর মনে হয়। কোনো রকম সময়জ্ঞান, ভদ্রতা নেই মোবাইলের। ইলেকট্রিসিটির মতো কোনো নোটিশ ছাড়াই চলে আসে। মোবাইলের অপরপ্রান্তে আনাড়ি কণ্ঠে একটি মেয়ে বলল- মামা, কাইলকা বাসায় চিঠি আইছে একখান। লিখছে আমাগোরে দেখা করতে। যে ব্যাডায় চিঠি লইয়া আইছিল, হেই কইছে আধা লাখ টাকা দিব আমগোরে! আপনে কই মামা?
একটানা কথা বলে থামলো মেয়েটি। মাশকুর বুঝতে পারলো এটি পারুল। তার বাবা মারা গেছেন বছর খানেক হলো। ফুসফুসের ক্যান্সার হয়েছিল তার। চাঁদপুরের মজিদ মিয়া একসময় বেশ অবস্থাসম্পন্নই ছিলেন। নদীভাঙ্গণে সব বিলীন হয়ে যাওয়ার পর পরিবার নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। থাকতেন ক্রীড়া পরিষদের পাশের পরিত্যক্ত জায়গাটিতে। পারুল মজিদ মিয়ার মেয়ে। মেয়েটি চঞ্চল, ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছিল। ঢাকায় আসার পর মাশকুর একটি তাদের দেখে এগিয়ে গিয়েছি নিজের থেকেই কথা বলেছিল। দু’বছর ধরে মেয়েটির পড়া বন্ধ শুনে একটি পথশিশুদের স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল। কিন্তু কয়েকমাস পর স্কুল কর্তৃপক্ষই পালিয়ে গেছে। পরে মাশকুর শুনেছিল ভাল একটি ডোনেশন ম্যানেজ করতে পেরেছিল তারা। এরপর আর স্কুল চালায়নি। এর পর আর পড়া হয়নি তার। কারণ ততদিনে মজিদ মিয়া খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন।
মাত্রাতিরিক্ত ধুমপান করতো লোকটি। রিকসা চালিয়ে সংসার চালাতো। একটি বস্তির মতো এলাকায় ঘরও ভাড়া নিয়েছিল। চরম অর্থাভাবে থাকলেও স্ত্রী আর মেয়েকে কোনো রকম কাজে দেয়নি। কখনো কমদামি বিড়ি খেত না। নির্দিষ্ট ব্রান্ডের সিগারেটই খেত সে। সরকারি প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করেছিল মেয়েকে। মাঝের এই সময়টায় মাশকুরের সাথে যোগাযোগটা কম হতো। একদিন মজিদ মিয়ার সাথে কাকরাইলের মোড়ে মাশকুরের দেখা। সেদিন রাজমনির পাশের গলিতে চা খেতে খেতে কিছুক্ষণ কথা হয়েছিল। আগের মতো রিক্সা তখন বেশি চালাতে পারতো না। ক্লান্ত লাগতো বেশ। কাশি হতো মাঝে মাঝেই। মাঝে মাঝে কাশির সাথে লাল কফও আসতো। এসব শুনে মাশকুর পরামর্শ দিয়েছিল বেশি বেশি টমেটো, আদা, বাদাম, গাজর খাওয়ার। এসব খেলে কিছুটা ক্ষতিপূরণ হয়। অষ্ট্রেলিয়ার একটি জার্নালে মাশকুর পড়েছিল, ধুমপানের জন্য শরীরের যে ক্ষতি হয় টমেটোর মধ্যে থাকা কোমেরিক ও ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড সেই ক্ষতি পূরণ করতে পারে। নিয়মিত ধূমপান করলে নিকোটিনের কারণে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে। লেবু জাতীয় ফলের মধ্যে থাকা ভিটামিন ‘সি’ নিকোটিনের প্রকোপ কমিয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
তবে সিগারেটটা কমিয়ে দেয়ার পরামর্শই দিয়েছিল বেশি। মাশকুর নিজেও সিগারেট খায়, তাই সে কাউকে কখনো সরাসরি সিগারেট ছেড়ে দিতে বলে না, তবে কমিয়ে দেওয়ার পরামর্শ প্রয়োজন হলে দেয়।
একসময় মজিদ মিয়া খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন সিগারেট খাওয়া কমিয়েছিল। কিন্তু তখন আর লাভ হয়নি। ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। পারুল আর তা মা সালেহা, বলতে গেলে অথৈ সাগরে ভেসে যাওয়ার উপক্রম। মাশকুর যথাসাধ্য সাহায্য করতো তাদের। সালেহাকে একটি সুইং কারখানায় চাকরি পাইয়ে দিয়েছে আজ দু’মাস হলো।
মজিদ মিয়া মারা যাওয়ার পর মাশকুর পরামর্শ দিল সালেহাকে একটি মামলা করার। সালেহা প্রথমে একেবারেই মামলার পক্ষপাতি ছিল না। মাশকুরের অনড় অবস্থানের কারণে রাজি হন তিনি। মামলা করেন সেই সিগারেট কোম্পানির বিরুদ্ধে। থানা এই মামলা নিতেই চায়নি। প্রথমে হাস্যকর একটি বিষয় বলে তাদের বের করি দিয়েছিল। মাশকুর তখন মিডিয়া আর একটি অ্যান্টি ট্যোবাকো সংগঠনের সাহায্য নেয়। মামলা হয়। মামলায় তার ভাষ্য ছিল, ‘নির্দিষ্ট এই ব্যান্ডের সিগারেট খেয়েই তার স্বামীর ফুসফুসের ক্যান্সার হয়েছে, সে মারা গেছেন। এমনকি এই কোম্পানি সতর্কবাণী ছাড়ানোর আইন ঠিক মতো মানেনি। তারা ধূমপানের ফলে যেসব ঝুঁকি রয়েছে তা ক্রেতাদের জানাতে ব্যর্থ হয়েছে।’
প্রথম দিকে কোম্পানিটি আমলে না নিলেও পরে তারা আমলে নিতে বাধ্য হয়েছে। গত আটমাসে কম জায়গায় দৌড়ায়নি সে। জাতীয় প্রেসক্লাব, অ্যান্টি ট্যোবাকো সংগঠন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল, আর হিসাব ছাড়া দৌড়াদৌড়ি হয়েছে আদালতে। কোনো উকিলের সাথে আলাপ করে রাজী করানো হলেও পরে তিনি আর মামলায় থাকতে চাইতেন না। সিগারেট কোম্পানি বেশ কোমর বেঁধেই নেমেছিল তাদের পরাজিত করতে। তাদের ভাবনা ছিল, একবার যদি এই ধরনের মামলা লড়তে হয়, কিংবা শেষে হারতে হয়, তাহলে আরো মামলা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই তারা এই মামলায় জেতার জন্য, কিংবা মামলাটি উঠিয়ে নেয়ার জন্য বেশ তোড়জোড় করছিল। প্রথম প্রথম এটা ওটা অফার করে ব্যর্থ হয়ে কয়েকবার তাকে হুমকিও দেয়া হয়েছে। ভয় লাগানো হয়েছে। মাশকুরও ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয়। সে এর শেষ দেখেই ছাড়বেই।
মামলার শুনানী এখন শেষ পর্যায়ে এসে গেছে। হয়তো তাই কোম্পানিটি পারুল আর তার মাকে লোভ দেখানোর চেষ্টা করছে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে। কারণ রায় হলে মোটা অংকের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে কোম্পানিটিকে। মাশকুর জানে কয়েকবছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সিগারেট কোম্পানিকে আরজে রেনোল্ডস টোব্যাকোকে একজন চেইন স্মোকারের বিধবা স্ত্রীকে ২৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। ওই ধুমপায়ী ব্যক্তিও ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। যদিও বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত এর আগে কখনো হয়নি, মামলাই হয়নি। তাই রায় নিয়ে একটি শঙ্কা তার রয়েছেই। তবুও মাশকুর আশাবাদী, ন্যায়বিচার তারা পাবেই। কারণ তামাকনিয়ন্ত্রণের আইন তো রয়েছে দেশে। অসম্ভব কিছুই নেই। যুক্তরাষ্ট্রে রায় হতে পারলে বাংলাদেশেও সম্ভব।
শুরুর দিকেই পারুলদের নিরাপত্তা নিয়ে ভেবেছিল মাশকুর। তাই প্রথমদিকে ওদের কখনোই সামনে আনেনি। কিন্তু সর্বশেষ মানববন্ধনের দিনে তার মায়ের কাছ থেকে তাদের বাসার ঠিকানা নিয়েছিল মিডিয়াকর্মীরা। পাশাপাশি মিডিয়ার পরিচয় দিয়ে কিছু লোকও তাদের ঠিকানা নিয়েছিল।
পারুলের কথা শেষ হতেই মোবাইলে মাশকুর বলল- না মা, এ ধরনের কথা তারা অনেক বলবে তুমি তোমার মাকে বলো যেন এসবে কান না দেয়। পারুল বলে- মামা, মা কানতাছে, তুমারে অহনই একবার আইবার কইতাছে। ওই লোক আইজকাও আইবো। কাইলটা বইলা গেছিলো। …তুমি কই গেছিলা, এ চারদিন ধইরা আসো না ক্যান?
মাশকুর সান্ত্বনা দেয়ার ভঙ্গিতে বলল- আমি আসবো মা, ঢাকার বাইরে গিয়েছিলাম যে! পারুল উতলা হয়ে বলল- মামা, আমগো ভয় করতাছে, কয়েকটা ব্যাটায় আইসা কি কি যেন কয়! তুমার খোঁজ করে! তুমি আসো মামা!
মাশকুর মোবাইল রেখে তাড়াতাড়ি অফিসে গেল। গিয়েই এইচআর বিভাগে গিয়ে সর্টলিভ নিয়ে বের হয়ে ঝিলপাড়ের বস্তির উদ্দেশ্যে রিক্সা নিল। ঝিলপাড় পৌঁছানোর আগে কয়েকটি যুবক রিক্সার পথরোধ করে দাঁড়ায়। মাশকুর যতই তাদের বোঝানোর চেষ্টা করে তার তাড়াতাড়ি যাওয়াটা জরুরী, ততই ছেলেগুলো তার সাথে তর্ক করে। শেষে একটি ছেলে বলেই বসলো- ওই পিচ্ছি মাইয়ার কাছে যাস, নাকি বুড়িটার কাছে? এতো ঘনঘন এদিকে কি তোর?
মাশকুরের আর বুঝতে বাকী রইলো না, এরা কারা? কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে মাশকুর দেখলো একটি মাইক্রো তাদের ক্রস করে যাচ্ছে। মাইক্রোর ভেতর থেকে কে যেন মাথা বের করে একবার তাকালো মাশকুরের দিকে। এরই মধ্যে রাস্তায় মোটামুটি জটলা হয়ে গেল। ততক্ষণে যুবকগুলো কথা তুলল, এই ছেলেটা বস্তিতে গিয়ে মেয়ে-মহিলাদের সাথে ফস্টিনস্টি করে। এরে মেরে থানায় দেয়া উচিত। উপস্থিত কেউ কেউ এই কথায় সায় দিল, দুয়েকজন পুরো বিষয়টা জানতে চাইলো। কিন্তু কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকে কিল-ঘুঁষি দিতে থাকলো ছেলেগুলো। মাশকুর রাস্তায় পড়ে গেল। মাশকুরের চোখের সামনেই মাইক্রোটি বস্তির দিকে মোড় নিয়ে ঢুকে গেল।
মাশকুর মাটিতে শুয়ে বস্তির দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখ ঝাপসা হয়ে আসলো এক পর্যায়ে। ছেলেগুলো তাকে পাঁছাকোলা করে আবার রিক্সায় উঠিয়ে উল্টো দিয়ে নিয়ে গেল।